সময়ের ভাবনা

উচ্চশিক্ষা কমিশন কেন গঠন করা গেল না?

তৌফিকুল ইসলাম

উচ্চশিক্ষার প্রসারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ভূমিকা রাখছে। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারিকুলাম পরিচালনার অনুমোদন দেয় ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন অব বাংলাদেশ (ইউজিসি)। ১৯৭৩ সালে যখন ইউজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মাত্র ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৩ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৯টি।

বিশ্ববিদ্যালয় বেড়ে যাওয়ায় যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউজিসি গঠিত হয়েছিল, সেটি ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। সে কারণে ২০১২ সালের ৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন, উৎকর্ষসাধন এবং বিস্তৃতির লক্ষ্যে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। তখন বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন ২০১২-এর খসড়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের মন্তব্যসহ মতামত দেয় ইউজিসি।

২০১৩ সালের ১০ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। নীতিগত অনুমোদনের জন্য খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপিত হলে সেটি ফিরিয়ে দিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর নানা প্রক্রিয়া শেষে ফের সচিব কমিটিতে তোলা হলে আইনটি অনুমোদন পায়। পরে আইনটি আবারো মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর হয়নি।

বর্তমানে ইউজিসি উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকলেও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রভৃতি কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার ইউজিসির হাতে নেই। আবার ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে যে বর্তমানে বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থেকে যায়। সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিত বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক প্রবণতা প্রভৃতি ইস্যু শিক্ষার সার্বিক মানের আলোচনায় রসদ জোগালেও এক্ষেত্রে ইউজিসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার যে ধারণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর যে আস্থা রেখে ইউজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা এখন নেই। এজন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, এক যুগ হতে চললেও সেটি বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে উচ্চশিক্ষার জন্য হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া রয়েছে। দেশটিতে ২০১৮ সালে রিপিল অব ইউজিসি অ্যাক্ট অনুযায়ী এ কমিশন গঠন হয়েছে। ভারতেও দীর্ঘ সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসি ছিল। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুমোদন দিত এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে অর্থ সাহায্য করত। এর কাজ ছিল ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সংহতি স্থাপন, মান নির্ণয় ও পরিচর্যা। কিন্তু আমাদের দেশের মতো ভারতেও ইউজিসির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যে কারণে ২০০৯ সালে দেশটির কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জানান, সরকার ইউজিসি তুলে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে তিনি অবহিত করেন। ইউজিসির পরিবর্তে উচ্চতর ক্ষমতার একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা চালু করার পরিকল্পনাও তুলে ধরেন। দীর্ঘ নয় বছর পর ভারতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।

বস্তুত উন্নত দেশগুলোয় যেভাবে উচ্চশিক্ষা কমিশন পরিচালনা করা হয়, দেশে সেভাবে কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান হায়ার এডুকেশন কমিশন রয়েছে। দেশটির কমিশনের লক্ষ্যই হলো সবার জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। কমিশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত উন্নত মান অর্জনে সহায়তা করে। এর উদাহরণও দেখতে পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন, পেনসিলভানিয়া, শিকাগো, ইয়েল, কলম্বিয়া, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বিশ্বের মেধাবী তরুণরা মুখিয়ে থাকেন।

পাকিস্তানেও হায়ার এডুকেশন কমিশন (হেক) রয়েছে। উচ্চশিক্ষা কমিশনের যাবতীয় কাজ তারা সম্পন্ন করে। এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। হায়ার এডুকেশন কমিশন অর্ডিন্যান্স, ২০০২ অনুযায়ী হেক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

কিন্তু বাংলাদেশে কেন উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা গেল না, এর নেপথ্য কারণ খুঁজতে গেলে জানা যায়, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয় চায় না তাদের কর্তৃত্ব হ্রাস পায় এমন উচ্চশিক্ষা কমিশন গড়ে উঠুক। কিন্তু ইউজিসির সাবেক এক চেয়ারম্যানের ভাষ্য অনুযায়ী, মন্ত্রণালয় দুটোর অভিপ্রায় বজায় থাকলে উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ সম্ভব হবে না। উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনের খসড়ায় প্রায় ৩০টি উপধারায় কার্যপরিধি নির্ধারিত হয়েছে। সেখানে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা উল্লেখ রয়েছে। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং যেমন জানা যাবে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও তুলনা করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা নির্ণয় করা যাবে। এতে শীর্ষে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এ কমিশন গঠন করতে পারলে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যথেচ্ছ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, উচ্চশিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নীতিনির্ধারণ সম্ভব হবে।

উচ্চশিক্ষা কমিশন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ক্যাম্পাস, শিক্ষা কার্যক্রম, সংরক্ষিত তহবিল, সিন্ডিকেটের কর্মপরিধি, নিয়োজিত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর যোগ্যতা, টিউশন ফি, অডিট, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, চাকরির প্রবিধানমালা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিক্ষকদের শিক্ষা ছুটি, পাঠ্যক্রম কমিটি, অর্থ কমিটি, নিয়োগ কমিটি, শৃঙ্খলা কমিটি ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্ধারণ করবে। অনিয়ম হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যেতে পারবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি ফিলিপাইন, শ্রীলংকা উচ্চশিক্ষা কমিশনের সুফল পাচ্ছে। এশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সে তালিকায় স্থান পেয়েছে শ্রীলংকা, এমনকি পাকিস্তানের মতো দেশও। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। এজন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনকে শুধু ইউজিসির নাম পরিবর্তন নয়, বরং ইউজিসিকে নতুন করে ‘স্বশাসন’ দেয়ার মাধ্যমে যদি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা যায়, তাহলেই এর উপযুক্ত ফল পাওয়া সম্ভব হবে।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন