সংকট মোকাবেলায় রিজার্ভ বাড়ানোর কৌশল নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

কাঁচামাল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং পণ্য জাহাজীকরণের খরচ বাড়ায় বেড়েছে ব্যবসার ব্যয়। ডলার সংকটের প্রভাবে বেড়েছে আমদানি ব্যয়ও। মূল্যস্ফীতির চাপে সংকুচিত হয়েছে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এসব সংকট আরো দীর্ঘায়িত হয়ে ওঠারও আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সংকট মোকাবেলায় লভ্যাংশ কমিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর কৌশল নিচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।

দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যা ১৩। এর মধ্যে আটটি কোম্পানি সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ হিসাব বছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) বাড়লেও আগের বছরের তুলনায় ঘোষিত লভ্যাংশের পরিমাণ কমেছে। পাঁচটি কোম্পানির ইপিএস কমার পাশাপাশি লভ্যাংশের পরিমাণও কমেছে। অন্যদিকে একটি কোম্পানির ইপিএস ও ঘোষিত লভ্যাংশ দুটোই বেড়েছে।

কোম্পানির রিজার্ভের অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে সংরক্ষিত আয় (রিটেইনড আর্নিংস)। লভ্যাংশ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটি জমা হয় সংরক্ষিত আয় হিসেবে। বিএটিবিসির সংরক্ষিত আয় ২০২২ হিসাব বছর শেষে ৩ হাজার ৫৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় ছিল ৩ হাজার ১৩২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশের সংরক্ষিত আয় ২০২২ হিসাব বছর শেষে ১৮৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের হিসাব বছরে তা ছিল ১৭৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা। 

২০২২ হিসাব বছরে গ্রামীণফোন কর-পরবর্তী নিট মুনাফার ৯৮ দশমিক ৭২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আগের হিসাব বছরে এর পরিমাণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। অবশ্য ২০২২ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় কিছুটা কমে ২ হাজার ৪৮৫ কোটি ৩০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা এর আগের হিসাব বছরে ছিল ২ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় সেগুলোর সংরক্ষিত আয়ের তথ্য পাওয়া যায়নি।

খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেড সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ২৪০ শতাংশ নগদ ও ৬০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটি ৪৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ৬০ টাকা ৬৪ পয়সা, যা এর আগের হিসাব বছরে ছিল ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা।

জানতে চাইলে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ারের চেয়ারম্যান মাসুদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সবাই নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মুনাফা বাড়লেও সেটি কতদিন টেকসই হবে জানি না। মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ভোক্তাদের মধ্যে বড় প্যাকেটের পণ্যের পরিবর্তে ছোট প্যাকেটের পণ্য কেনার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়েছে। এসব কারণে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা লভ্যাংশ কমিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এতে সংকটকালীন কোম্পানির জরুরি তহবিলের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে যদি আমরা ব্যবসা বাড়াতে চাই, সেক্ষেত্রেও এটি সাহায্য করবে।’

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটিবিসি) সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ হিসাব বছরে অন্তর্বর্তীকালীন ও চূড়ান্ত মিলিয়ে ২০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটি ২৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। অবশ্য লভ্যাংশ কমলেও ২০২২ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস বেড়ে ৩৩ টাকা ১০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ২৭ টাকা ৭২ পয়সা।

বিএটিবিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে এরই মধ্যে ঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে পাঠানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বিদ্যমান সংকটের সময় বেশি লভ্যাংশ দিলে বেশি পরিমাণে ডলার দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি তামাক রফতানি আরো বাড়ানোর বিষয়ে কোম্পানি চেষ্টা করছে। এজন্য ভবিষ্যতে কোম্পানির অর্থের প্রয়োজন হবে। এসব কারণেই মুনাফা বাড়লেও আগের বছরের তুলনায় লভ্যাংশের পরিমাণ কমানো হয়েছে। এতে কোম্পানির রিজার্ভও কিছুটা স্ফীত হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ হিসাব বছরে আরএকে সিরামিকস লিমিটেড বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটি ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস কমে ১ টাকা ৫৭ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ২ টাকা ১২ পয়সা।

২০২২ হিসাব বছরে সিঙ্গার বাংলাদেশের ইপিএস হয়েছে ৭৩ পয়সা। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ৫ টাকা ২০ পয়সা। ইপিএসে ধস নামার কারণে আগের বছরে কোম্পানিটি ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও এবার এটি কমে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

জ্বালানি খাতের কোম্পানি লিন্ডে বাংলাদেশ ২০২১ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের ৫৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। সর্বশেষ ২০২২ হিসাব বছরে কোম্পানিটি নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ৪২০ শতাংশ। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৫৮ টাকা ৪ পয়সা, যা এর আগের হিসাব বছরে ছিল ৮০ টাকা ৫৫ পয়সা।

২০২২ হিসাব বছরে রেকিট বেনকিজার ৯৮০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যেখানে এর আগের বছরে ১ হাজার ৬৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস কমে দাঁড়িয়েছে ১৩৯ টাকা ৫০ পয়সা। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ১৭১ টাকা ৩ পয়সা। 

টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোন সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ হিসাব বছরে ২২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যেখানে এর আগের বছরে ২৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল কোম্পানিটি। ২০২২ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ২২ টাকা ২৯ পয়সা, যা এর আগের হিসাব বছরে ছিল ২৫ টাকা ২৮ পয়সা।

টেলিযোগাযোগ খাতের আরেক কোম্পানি রবি আজিয়াটা ২০২২ হিসাব বছরে ৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটি ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। লভ্যাংশের পাশাপাশি কোম্পানিটির ইপিএসের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে ২০২২ হিসাব বছরে ৩৫ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ৩৪ পয়সা।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই উচ্চহারে লভ্যাংশ ঘোষণা করে থাকে। এমনকি কোনো কারণে কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে গেলেও তারা আগের বছরের লভ্যাংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এবারের সংকটের মাত্রা ভিন্ন। এ কারণে যেসব কোম্পানির মুনাফা কমেছে তারা যেমন লভ্যাংশ কমিয়েছে, তেমনি যাদের মুনাফা কমেনি বরং বেড়েছে তারাও লভ্যাংশ কম দিয়েছে। সবার মধ্যেই একটি কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি দেখা যাচ্ছে।

দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট নাসের এজাজ বিজয় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লভ্যাংশ ঘোষণার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পর্ষদের। কোম্পানিগুলোর পর্ষদে বিভিন্ন পক্ষের শেয়ারহোল্ডারদের উপস্থিতি রয়েছে এবং তাদের অনেকেই বিদেশী। চেম্বার হিসেবে আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি না। যা-ই হোক, আমি যতটুকু জানি এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো নির্দেশনা কিংবা বিধিনিষেধ নেই।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন