শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ

বেশি আক্রান্ত হয় শিশু ও বৃদ্ধরা

ডা. মো. খায়রুল আনাম জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের বিষয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা, গবেষণা চিকিৎসাসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। শ্বসনতন্ত্রের রোগ, সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ, চিকিৎসা দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

চিকিৎসকরা শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ বলতে কী কী বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন?

শ্বসনতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি শ্বাসতন্ত্র বা রেসপিরেটরি ট্রাক্ট। এর সংক্রমণ অনেকভাবেই হয়। সাধারণত আমরা শ্বাসনালির মাধ্যমে বাইরের বায়ু গ্রহণ করি এবং পরে ফুসফুস থেকে দূষিত বাতাস ছাড়ি। বায়ু গ্রহণের সময় বায়ুতে অবস্থিত জীবাণু শ্বসনতন্ত্রে ঢুকতে পারে। সাধারণত আমরা যেসব শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ দেখি তার মধ্যে অন্যতম নিউমোনিয়া। অনেক জীবাণুর মাধ্যমে নিউমোনিয়া হতে পারে। ভাইরাস বা ফাঙ্গাসের কারণেও শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ হতে পারে। আমাদের দেশে আরেকটি রোগ হচ্ছে টিউবারকিউলোসিস অর্থাৎ টিবি বা যক্ষ্মা। যক্ষ্মা রোগেও শ্বসনতন্ত্রে সংক্রমণ হয়ে থাকে। দরিদ্র দেশ বা ঘনবসতিপূর্ণ দেশ যেমন বাংলাদেশেও রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। জীবাণু ছাড়া যেখানকার বাতাসে ধুলাবালি বা কেমিক্যাল বা রাসায়নিক বেশি থাকে সেসব শ্বসনতন্ত্রে ঢুকে প্রদাহ করতে পারে। সেটাকে আমরা সংক্রমণ বা ইনফেকশন বলি না, প্রদাহ বলি।

কভিড-১৯ মহামারীর সময়ে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের বিষয়টি বেশি শোনা গিয়েছে। এই সময়ে সংক্রমণ বেশি হওয়ার কারণ কী?

কভিড-১৯ একটি ভাইরাসজনিত রোগ। আমি জানিয়েছি যে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ বায়ুতে থাকা যেকোনো জীবাণু দিয়েই হতে পারে। ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাতাসে করোনার জীবাণু সার্স কভ- খুব বেশি পরিমাণে অবস্থান করছিল। আর ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি বা বিস্তার করতে পারে। একজন থেকে অন্যজনেও খুব অনায়াসে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। এভাবেই সারা দেশ বা বিশ্বব্যাপী খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়েছিল করোনাভাইরাস। সেই সময়ে অন্যান্য জীবাণুর কারণেও সংক্রমণ হয়েছে। কিন্তু করোনার এত বেশি বিস্তারের মধ্যে সেটা আর দৃষ্টিগোচর হয়নি। তখন করোনাজনিত রোগের চিকিৎসা নিয়েই আমাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। পাশাপাশি করোনা আসার কিছুদিন পরে স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থা নেয়া মেনে চলার জন্য করোনা সংক্রমণের মতোই অন্যান্য জীবাণুর সংক্রমণও প্রশমন করেছে।

নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ কেন বেশি দেখা যায়?

এর একটিই কারণ, ঘনবসতি। একই ঘরে বা সীমাবদ্ধ জায়গায় নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ বাস করে। সংক্রমিত মানুষের হাঁচি কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে সেই জীবাণু অন্যকেও সংক্রমিত করে। সেই কারণেই সেখানে সংক্রমণের হার বেশি।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে শিশু বৃদ্ধদের। এর কারণ কী?

এটা আমরা সবাই জানি বুঝি যে শিশু অতি বয়স্করা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে আসা একটা বয়সে বাস করে। ফলে অন্যান্য রোগের মতো তাদের শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণও বেশি হয়ে থাকে।

বায়ুদূষণ ছাড়া আর কী কী দূষণ শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের জন্য দায়ী?

যানবাহন, কলকারখানা আর ইটের ভাটার কারণে বায়ুদূষণ হয়। আমাদের দেশে অন্যান্য অনেক দেশে অল্প জায়গায় অনেক মানুষ কাজ করে। আমাদের দেশে বা অন্যান্য দেশে অনেক মানুষ কলকারখানায় চাকরি করে। যেখানে সীমাবদ্ধ জায়গায় অনেক মানুষ বাস করে। কিন্তু সেখানে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী বায়ুদূষণ যাতে না ঘটে, বা যে দূষণ হচ্ছে সেটা হ্রাস করার জন্য কাঠামোগত বা কারিগরি কোনো ব্যবস্থা সুনির্দিষ্টভাবে নেই। ফলে ওই সব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে।

এই শ্বসনতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ কোনো রোগকে প্রভাবিত করে কি?

অবশ্যই করে। শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণে টিবি বা যক্ষ্মার কথাই ধরেন, দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের কারণে ফুসফুসের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়। ফুসফুস শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শ্বাসের মাধ্যমে আমরা বিশুদ্ধ বাতাস বায়ুথলিতে নিই। রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে সেই বাতাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অক্সিজেন সারা শরীরে যায়। সেটা যায় বলেই অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া এনার্জি বা শক্তি আমাদের শরীরে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে নানা কাজ করার সুযোগ তৈরি করে। যদি ফুসফুসের মাধ্যমে সারা দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ না হয় তাহলে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। এভাবেই দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ সারা শরীরেই প্রভাব ফেলে।

শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণে চিকিৎসা কি দীর্ঘমেয়াদি?

বিষয়টা ঠিক তা নয়। নিউমোনিয়া, ভাইরাস ইনফেকশন হয় অনেকের। কিন্তু যদি আমরা তা দ্রুত চিহ্নিত করতে পারি সঠিক মাত্রায় সঠিক ওষুধ দিতে পারি তাহলে থেকে ১০ বা ১৪ দিনে সমস্যা হ্রাস করা সম্ভব। তবে যদি যক্ষ্মা রোগ হয় তাহলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দিতে হয়। যক্ষ্মা হলে প্রথমবার কমপক্ষে ছয় মাসের ওষুধ দিয়ে তার চিকিৎসা করতে হয়। তাছাড়া আর এত দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না।

দেশে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের রোগ নির্ণয় চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কী?

দেশে সীমাবদ্ধতা খুব যে প্রকট তা নয়। এর সংক্রমণ অন্যান্য দেশের মতো খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব এবং তা হচ্ছেও। তবে আমাদের জনগণের সবাই যে চিকিৎসাসেবার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে পারে তা তো না। আমাদের জনবলও সীমিত। শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ চিহ্নিত করা সেবা দেয়ার জন্য যে জনবল দরকার, যে কাঠামোগতভাবে জনবিন্যাস বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিন্যাস দরকার তা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এটা ঠিক যে বর্তমান সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে কাঠামোগত পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনছে, তাতে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণসহ আরো অন্যান্য রোগ চিহ্নিত করা, নির্ণয় করা চিকিৎসা করা খুব সহজেই সম্ভব হবে। তাতে ধীরে ধীরে আমাদের সীমাবদ্ধতা কমে আসবে।

জনস্বাস্থ্যের জন্য শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ কতটুকু উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?

জনস্বাস্থ্যের জন্য শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ অবশ্যই উদ্বেগজনক। এর একটি উদাহরণ করোনাভাইরাস সংক্রমণ। তা যখন মহামারী অতিমারী হিসেবে বিশ্বে দেশে দেখা দিল তখন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা গেছে। বিশেষ করে যারা বেশি বয়স্ক বা যারা ক্রনিক রোগে আক্রান্ত তারা বেশি ভুগেছেন মৃত্যুর হার বেশি ছিল। তখন সব বয়সীর স্বাস্থ্যকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল এবং সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছিল সংক্রমণ। তাই যে সংক্রমণই হোক তা যদি অতিমাত্রায় হয় এবং ঠিকমতো চিকিৎসার আওতায় না আসে তাহলে অবশ্যই সেটাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে আমরা চিহ্নিত করে থাকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন