বিষণ্নতা

শরীর আর মনকে আমরা বিচ্ছিন্ন বিবেচনা করি

অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যাডাল্ট সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনা, গবেষণা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। বিষণ্নতার কারণ, সামাজিক সচেতনতা, চিকিৎসা সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

বিষণ্নতাকে সাধারণ মানসিক ব্যাধি হিসেবে কেন অভিহিত করা হয়?

রোগটির প্রাদুর্ভাব খুব দেখা যায় সেই অর্থে সাধারণ বললে ঠিক আছে। কিন্তু যদি রোগটিকে খুবই সামান্য মনে করি বা তুচ্ছ আকারে ধরি তাহলে কিন্তু ঠিক হবে না। মানসিক যেসব ব্যাধি রয়েছে তার মধ্যে বিষণ্নতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাধি। 

বিষণ্নতা কত ধরনের হয়?

বিষণ্নতা হালকা, মাঝারি তীব্র মাত্রার হতে পারে। বিষণ্নতার কতগুলো লক্ষণ আছে। যেমন সে ভালো বোধ করে না। যেগুলোতে আনন্দ পেত সেগুলোতে আনন্দ পায় না। মনোযোগ দিতে পারে না। তার মধ্যে সবসময় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা আসে। কখনো কখনো নিজেকে অপরাধী মনে করে, আত্মহত্যার চিন্তাও আসতে পারে, এমনকি সেই চেষ্টাও করতে পারে। বিষণ্নতা যেহেতু মানসিক অসুখ তাই তার একটা শারীরিক দিক থাকে। কারণ আমাদের শরীর মন ইন্টিগ্রেটেড। একটার ক্ষতি হলে অন্যটারও হতে পারে। বিষণ্নতার কিছু শারীরিক লক্ষণও আছে। যেমন ঘুম হয় অথবা হয় না, রুচি বেড়ে যায় বা কমে যায় ইত্যাদি। রোগে মন শরীর দুটিই আক্রান্ত হয়। কিন্তু সব লক্ষণ সবার থাকে না। কারো যদি তিন বা চারটা লক্ষণ থাকে এবং যদি দুই-তিন সপ্তাহ ভোগে তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি বিষণ্নতায় ভুগছেন।

বিষণ্নতাকে নির্ণয় (ডায়াগনোসিস) কীভাবে করা হয়? দেশে বিষণ্নতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি রয়েছে কি?

দুই ধরনের উপায়ে বিষণ্নতা নির্ণয় করা হয়। একটা স্কেল ব্যবহার করে দেখা হয় বিষণ্নতার মাত্রা কেমন আছে। পদ্ধতি বেশি ব্যবহার হয় গবেষণায়। ক্লিনিক্যালি রোগ নির্ধারণ করতে এর খুব একটা দরকার পড়ে না। কারণ ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসিস করার জন্য আমাদের কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে। সেটা সারা বিশ্বের জন্য একরকম। আমরা ডাক্তাররা রোগীর কথা তার স্বজনদের কথা শুনে বিষণ্নতা নির্ণয় করতে পারি নির্ভুলভাবেই। রোগ নির্ণয়ে আমাদের প্রথম সীমাবদ্ধতা সচেতনতা নেই। মন খারাপ লাগে কিন্তু আমরা কারণ খুঁজি পাই না। কখনো কখনো মন খারাপকে গুরুত্বই দিই না। ঘুম হচ্ছে না, রুচি নেই, দুর্বল দুর্বল লাগে। তখন শরীর খারাপ ভেবে ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার যদি সচেতন থাকেন তখন ডায়াগনোসিস করেন বিষণ্নতা আছে কি না। আবার পরিবারের কাউকে বললে হয়তো বলবে, মন চাঙ্গা করো, ঘোরাঘুরি করো। সেসব কাজে দেয় যখন বিষণ্নতা রোগ না। কিন্তু রোগ হয়ে গেলে এসব খুব একটা সাহায্য করতে পারে না। আবার কেউ বলেন, তোমার তো কোনো সমস্যাই দেখি না। তোমার এত মন খারাপ হওয়ার কারণই নেই। ফলে চিকিৎসা হয় না। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী শারীরিক মানসিক অক্ষমতার প্রধান কারণ বিষণ্নতা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন।

সারা বিশ্বে নিয়ে বড় বড় জরিপ আছে। দেখা গিয়েছে শারীরিক কারণে মানুষ যত না কাজ করতে অক্ষম থাকে তার থেকে বেশি বিষণ্নতার কারণে হয়। একজন যখন বিষণ্ন বোধ করে তখন তার কিছুতেই ভালো লাগে না, মনোযোগ দিতে পারে না ফলে কাজ করতে পারে না। তাই কাজ করতে না পারার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে বিষণ্নতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করছে, আগামী কয়েক বছরে এটা কর্মক্ষেত্রে সমস্যার এক নম্বর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বিষণ্নতা বেশি। কেন?

বিষণ্নতার জরিপে আমরা দুই ধরনের পার্থক্য দেখি। এক নারী-পুরুষের পার্থক্য। সেখানে নারীদের আমরা বেশি পাই আর দেখি সমাজভেদে পার্থক্য। সব সমাজে বিষণ্নতার উপস্থিতি এক নয়। বিষণ্নতার ক্ষেত্রে দুই ধরনের কারণ আছে। এর একটি হল বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক কারণ। কিছু কিছু মানসিক অসুখ আছে যেটা সবখানে একই মাত্রায় পাওয়া যায়। আরেকটি কারণ হলো আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক কারণ। সেটা দেশভেদে সমাজভেদে ভিন্ন হয়। একই সমাজে দুই ধরনের লিঙ্গ একইভাবে এই আর্থসামাজিক কারণে প্রভাবিত হয় না। তাই একটি লিঙ্গে আমরা বেশি পাই, আরেকটি লিঙ্গে কম।  আমাদের দেশে মেয়েরা অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যে থাকে, তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।

বিষণ্ন ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এর কারণ কী?

যারা বিষণ্নতা রোগে ভোগে তাদের ১০-১৫ শতাংশ আত্মহত্যা করে এবং যারা আত্মহত্যা করে তাদের ৭০ শতাংশ আত্মহত্যার সময়ে বিষণ্নতায় ভুগছিল। ফলে আত্মহত্যার সঙ্গে বিষণ্নতার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কারণ আর কোনো রোগেই বিষণ্নতার মতো আত্মহত্যা করে না।

বিষণ্নতার সঙ্গে জীবনাচারের সম্পর্ক রয়েছে কি?

জীবনাচার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনাচারের সঙ্গে পার্সোনালিটি প্রটেক্টিভ রিস্ক ফ্যাক্টর দুই দিকেই কাজ করতে পারে। যার পার্সোনালিটি সহনশীল ব্যালান্স সে যেভাবে বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে পারবে; অন্যরা তা পারবে না, চাপে পড়বে। যার লাইফস্টাইল সুন্দর স্বাস্থ্যকর তার মধ্যে কিন্তু ট্র্যাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। এর ফলে বিষণ্নতা তৈরি হওয়া থেকে মুক্তি মিলবে।   

দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে মৌলিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত? মানসিক স্বাস্থ্যের কর্মসূচিগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছে কি?

আমরা দীর্ঘদিন একটা ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়ে আসছি। আর সেটা হল মন শরীরকে আমরা খুব বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। কিন্তু মনটা তো আমাদের ব্রেনেরই ফাংশন। ব্রেনই পুরো শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে আমরা মনকে শরীর থেকে আলাদা করি কীভাবে? এই ভুলটা আমাদের মধ্যে গেড়ে বসে আছে। এটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। ডব্লিউএইচও তিনটা ডাইমেনশনে স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করেফিজিক্যাল, মেন্টাল সোশ্যাল। তিনটা ডাইমেনশনে মানুষ সুস্থ থাকলে তাকে সুস্থ বা স্বাস্থ্য বলা যাবে। আমাদের দেশে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই গড়ে উঠেছে শারীরিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে। মনটা বাদ পড়ে গেছে। এখন সেটাকে যুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের চিন্তাকেও পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যদি এভাবে বুঝে নিই যে শরীর মন আলাদা না, তাহলে ব্যাপারটা আরো এগিয়ে যাবে। সচেতন হলে এসব উদ্যোগ আরো বেগবান হবে। বোধগম্য হলে উদ্যোগ আরো জোরদার হবে এবং আমরা দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কর্মসূচি খুবই সীমিত। কিন্তু যেগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলো কমবেশি ফলপ্রসূ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন