হঠাৎ করেই আমরা আর্থিক খাতে অভিভাবকহীন হয়ে গেছি

দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন পাশাপাশি তিনি ইস্পাত শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) প্রেসিডেন্ট। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গ্রুপের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

বস্ত্র, ইস্পাত, সিমেন্ট, পলিমার, গ্যালভানাইজিং, পাট, আবাসন, অবকাঠামো, আর্থিক, আসবাব অটোমোবাইল খাতে আনোয়ার গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে। বর্তমানে আপনাদের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?

বর্তমানে অর্থনীতি একটু চাপের মধ্যে আছে। আমরাও সেই চাপটা অনুভব করছি। আমি ব্যবসায় যোগ দিয়েছি ৩০ বছর। এই প্রথম আমার কাছে মনে হচ্ছে চাপটা চতুর্দিক থেকে আসছে। আমরা একটা চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যে আছি। তবে সেটিকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি। সামনে হয়তো টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় পণ্যের নতুন রফতানি বাজার তৈরির চেষ্টা করছি। পাশাপাশি যতটা সম্ভব নিজেদের উৎপাদিত পণ্য গ্রুপের কোম্পানিগুলোর প্রয়োজনে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের দক্ষতাকে আরো শাণিত করছি। আমাদের গ্রুপের ১৪ হাজার কর্মী বাহিনীকে নিয়েই আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাই।

কোন খাতের ব্যবসা থেকে আনোয়ার গ্রুপের সবচেয়ে বেশি আয় আসে?

আমাদের গ্রুপের মূল আয় আসে বস্ত্র খাতের ব্যবসা থেকে। এছাড়া তিন বছর ধরে আমরা আবাসন খাতের ব্যবসায় ভালো প্রবৃদ্ধি করছি। সিমেন্ট ইস্পাতের ব্যবসায় ভালো আয় হলেও মুনাফার ওপর কয়েক বছর ধরে বেশ চাপ যাচ্ছে। গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দুই বছর ধরে সিমেন্ট ইস্পাত খাতে ভালো ব্যবসা করেও আমরা সুফল পাচ্ছি না। আমাদের ১৮ মেগাওয়াটের একটি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে গত দুই বছরে আমরা গড়ে কেন্দ্র থেকে ছয়-সাত মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারিনি। এতে আমাদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সক্ষমতায় উৎপাদন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে হঠাৎ করেই আমাদের পলিমার পণ্যের চাহিদা একেবারেই কমে গিয়েছে।

বস্ত্র খাতের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?

খাতের ব্যবসা কিছুটা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্পিনিং ব্যবসায় সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের ব্যবসা নিম্নমুখী। আমরা অনেকাংশেই তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। কারণ খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমরা সরবরাহ করি। ফলে আমাদের বস্ত্র খাতের ব্যবসাও স্বাভাবিকভাবেই নিম্নমুখী।

ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্যে এর কী প্রভাব পড়েছে?

যে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, তা বর্তমানে ১০৭-১০৮ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে ব্যবসার খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। ডলারের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়বে। মূলত ডলারের দাম বাড়ার কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কভিডের সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেলেও কিন্তু আমাদের এখানে সেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অবস্থায় আমাদের অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় কমাতে হবে। বিলাসপণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। আগামী এক বছর আমাদের জন্য কঠিন পরীক্ষার সময়। বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে আমি মনে করি তারা সঠিক পথেই রয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্যপণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশের পোলট্রি খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ। গবাদিপশুর চাহিদাও আমরা মেটাতে সক্ষম। তাই আমাদের এখানে আমিষের ঘাটতি হবে না। যে পণ্য বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে একই ধরনের পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিং রোধের উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা গ্যালভানাইজড ফিটিংস তৈরি করি। দুই বছর ধরে আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি যে গ্যালভানাইজিং পণ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে আমদানিতে একটি ট্যারিফ নির্ধারণ করে দেয়ার কথা আমরা বলেছি। অথচ বিষয়ে এখনো কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ দেখা যায়নি। এবার যদিও তারা এর ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে, কিন্তু এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। এতে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে এনবিআরের কারণে আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিং হয়ে যায়। যেমন ধরেন সিমেন্টের অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম যখন ৪৮ ডলার ছিল তখন এনবিআর এটি অ্যাসেস করত ৬০ ডলারে। অর্থাৎ ১২ ডলার বেশিতে তারা অ্যাসেস করত। ফলে যারা স্মার্ট তারা কিন্তু ৪৮ ডলারে ইনভয়েস না করে ৬০ ডলারে ইনভয়েস করে সেই অর্থ হয়তো বিদেশে নিয়ে গিয়েছে।

সিমেন্টের কাঁচামাল হিসেবে আমরা লাইমস্টোন আমদানি করি। আবার কিছু কোম্পানি আছে যারা লাইমস্টোন আমদানি করে সেটাকে এগ্রিগেটস হিসেবে রেডি মিক্স প্লান্টে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে এটিকে পাথর হিসেবে অ্যাসেস করা হলে শুল্কের পরিমাণ তিন গুণ বেড়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, এনবিআর আমার ওপরও একইভাবে তিন গুণ বেশি শুল্কারোপ করেছে। অথচ আমি কী পরিমাণ লাইমস্টোন ব্যবহার করি সেটা কিন্তু ঘোষণা করা আছে। যদি আমি এর বেশি আমদানি করি তাহলে সেটির ওপর আপনি শুল্ক আরোপ করতে পারেন। অর্থাৎ আমার ওপর এক ধরনের অন্যায় করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যারা অন্যায় করছে তাদের কম ধরছেন আর যারা আমার মতো বোকাসোকা মানুষ তাদের চেপে ধরছেন। আপনি যদি আমার সঙ্গে ন্যায় না করেন তার অর্থ হলো আপনি কোনো না কোনোভাবে আমাকে দিয়ে অন্যায় করিয়ে নেবেন।

আরেকটি বিষয় হলো হঠাৎ করেই আমরা আর্থিক খাতে অভিভাবকহীন হয়ে গিয়েছি। মুহিত সাহেব যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন তার কাছে গেলে আমাদের কথা শুনতেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, আবার নিজে খবরও নিতেন। আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রী একটু অসুস্থ। বিষয়ে আমি পুরোপুরি সহানুভূতিশীল। এক্ষেত্রে ওনার একজন সহকারী নিয়োগ দেয়াটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চ্যালেঞ্জিং সময়টাতে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। যাতে আমাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার মতো একটা জায়গা থাকে।

ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

তিন সপ্তাহ ধরে আমাকে বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে ধরনা দিতে হচ্ছে এলসি খোলার জন্য। আমি বুঝতে পারছি তাদের সমস্যা। কিন্তু এভাবেই চলতে হচ্ছে। যে জায়গায় ১০ টাকার এলসি খোলা দরকার সেখানে টাকার খুলতে পারছি। বাকিটার জন্য আবার ধরনা দিতে হচ্ছে, অপেক্ষা করতে হচ্ছে। মুশকিল হলো আমি যে এলসিগুলো খুলতে পারিনি তার জন্য আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে।

সামনের বছর দেশের অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন যাবে বলে মনে হয়?

কভিডের শেষের দিক থেকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটা ফোরামে বলে আসছি যে অতিমারী চলে যাবে, কিন্তু এরপর বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে তিন-পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। যদিও অনেকেই এটিকে অগ্রাহ্য করেছেন। যদি আমরা ডলারের সংকট কাটাতে না পারি তাহলে আগামী বছরটা বেশ কঠিন যাবে। গণমাধ্যমের বরাতে আমরা অর্থ পাচারের বিভিন্ন নজির দেখতে পাই। ধরনের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পুরোটাই যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনবোধে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কোন দেশে কতজন প্রবাসী রয়েছেন এবং সেখান থেকে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা আর বাস্তবে কী পরিমাণ আসছে সেটি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ডলার পাচারের রাস্তা বন্ধ করতে পারলে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।

আরেকটি বিষয় আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটি আমাদের লাইফলাইন হিসেবে কাজ করবে। কৃষির পরই শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ খাতে অনেকের কর্মসংস্থান জড়িয়ে আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা যারা মাঠপর্যায়ে ব্যবসা করছি তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। হাতে গোনা পাঁচ-ছয়জন বড় ব্যবসায়ী মানেই পুরো বাংলাদেশ নয়। সব ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সবাইকে নিয়েই আমাদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন