মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজটি আমার প্রথম ইনস্টলেশনধর্মী প্রদর্শনী

নিজের স্টুডিওতে কর্মরত শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান ছবি: মাসফিকুর সোহান

আধুনিক চিত্রশিল্পী কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান। তিনি স্থানিক ভাবনার শিল্পচর্চা আন্দোলনের অন্যতম সূত্রধর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে স্নাতক শেষে চীনের পিকিং ফাইন আর্টস একাডেমিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। প্রায় ২৫ বছর কাটিয়েছেন জার্মানির বার্লিনে। আশির দশকে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা চিত্রকলার আন্দোলন সময় গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের একজন

আপনার শিল্পচর্চার শুরুটা কীভাবে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুলে পড়তাম। একটু একটু ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল। শিক্ষক ফজলুল রহমান শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরির কাজটি করেছেন। আশির দশকে চারুকলায় ভর্তি হই। তখন আমরা সমমনা একদল মানুষ একত্র হতে পেরেছিলাম। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাজী আবদুল বাশেত, রফিকুন নবী, শহিদ কবির স্যারদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবও আছে। কবিবন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মইনুদ্দীন খালেদ আর চলচ্চিত্রের বন্ধুদের মধ্যে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনির আসত। সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। বন্ধুদের মধ্যে শাহাদুজ্জামান আজ বিখ্যাত লেখক। খসরু ভাইয়ের (মুহম্মদ খসরু) কথা উল্লেখযোগ্য। তার মাধ্যমে আমরা যত বই পড়েছি, চলচ্চিত্র দেখেছি, সে ঋণ শোধের নয়। তখনকার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশসব মিলিয়ে আমি মনে করি ওই সময়টা ভীষণ সমৃদ্ধ।


সময় নামে আপনাদের ভিজুয়্যাল আর্ট মুভমেন্টের নেপথ্যের ভাবনাগুলো শুনতে চাই

আমাদের আলাপ হতো বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পচর্চা নিয়ে। আমরা মূল্যায়নের চেষ্টা করতাম আমাদের অঞ্চলের শিল্প কেমন হওয়া উচিত, দৃশ্যশিল্পে আমাদের নিজস্ব ভাষা তৈরি করা যায় কিনা কিংবা আমাদের চিত্র, রূপ বা উপস্থাপনা কী হবেএসব চিন্তা থেকে সময়-এর শুরু। ঢাকা চারুকলার বাইরে চট্টগ্রাম চারুকলার শিক্ষার্থী ঢালী আল মামুন দিলারা বেগম জলি মিলেই আমাদের যাত্রা। সময় গ্রুপের ১৪টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা আমাদের চিন্তার খানিকটা প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলাম, যার কিছুটা প্রভাব হয়তো বর্তমানের শিল্পীদের মধ্যে পড়েছে। আমরা চেয়েছিলাম তৎকালীন শিল্পচর্চা বিশ্লেষণ করে নিজেদের চিন্তার উপস্থাপন বা ভাবনাটাকে প্রকাশ করতে।

চারুকলা থেকে চীন, এরপর জার্মানিআপনার চিন্তার জগেক কীভাবে প্রভাবিত করে?

চীনের চিত্রকলা নিয়ে আমার খুব বেশি ধারণা ছিল না। আমরা সবসময় ইউরোপিয়ান আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। চীনে গিয়ে দেখলাম ওদের সভ্যতা ইউরোপের চেয়েও পুরনো। বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বুড্ডিজমের প্রভাব রয়েছে। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও ট্র্যাডিশনাল ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার ব্যবহার রয়েছে, আমার চিন্তাভাবনায় যা বড় ধরনের প্রভাব রাখে, সমৃদ্ধ করে। তাছাড়া চীনে সমাজতান্ত্রিক চর্চা ছিল। আমরা সবাই বাম রাজনীতি কিংবা লেফট অ্যাস্থেটিক দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। সে জায়গা থেকে সশরীরে তা পর্যবেক্ষণ করাটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় বিষয়। চীন থেকে ঢাকায় ফিরে কিছুদিন পর আবার জার্মানিতে চলে যাই। ঐতিহাসিকভাবে বার্লিন খুব গুরুত্বপূর্ণ শহর আবার রাজনৈতিক কারণেও তখন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি শীতল যুদ্ধের সময় বার্লিনের একটা বিশেষ অবস্থান ছিল। বিভিন্ন দেশের নিগৃহীত শিল্পী অ্যাক্টিভিস্টরা বার্লিনে জড়ো হয়েছিলেন, বসবাস করতেন। সব মিলিয়ে বার্লিনের পরিবেশ ছিল বৈচিত্র্যময়। বার্লিন ওয়ালের পতন রাজনৈতিকভাবে গোটা ইউরোপের বাঁকবদল ঘটায়। বিষয়গুলো আমার চিন্তার জগেকও প্রভাবিত করে।


ঢাকা আর্ট সেন্টারের পর কলাকেন্দ্রশিল্পচর্চায় কী ধরনের ভিন্নতা অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলেন?

জার্মানিতে থাকাকালীন প্রায় প্রতি বছর আমি দেশে এসেছি, প্রতিবার একটি করে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। প্রদর্শনীর ধারাবাহিকতা যদি লক্ষ করা যায় তাহলে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। ১৯৯৪-৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজটি আমার প্রথম ইনস্টলেশনধর্মী প্রদর্শনী। ইউরোপে আমি ধরনের কাজ দেখেছি। ভাষা আঙ্গিককে আমাদের কনটেক্সটে ব্যবহার করে উপস্থাপনাই ছিল উদ্দেশ্য। দেশে ফিরে দেখলাম আমার বন্ধুরা এখানে ঢাকা আর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে এক ধরনের শিল্পচর্চা চলছে। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হলাম। বার্লিনে দেখে এসেছিলাম, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে শিল্প বিস্তার উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিউরেশন জোরালো ভূমিকা পালন করছে। ঢাকা আর্ট সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আমি প্রদর্শনী ডিজাইন, বিশেষভাবে উপস্থাপন যোগাযোগের আরো কিছু মাত্রা তৈরির কাজগুলোর সঙ্গে যুক্ত হই। বিভিন্ন কারণে একটা সময় ঢাকা আর্ট সেন্টার বন্ধ করতে হয়। ২০১৫ সালে কলাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা। এটি মূলত আর্টিস্ট রান স্পেস বাংলাদেশে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে যারা ভিন্নতার খোঁজ করতে চায়, কলাকেন্দ্র তাদের সঙ্গে দেয়। তাদের কাজকে উপস্থাপন করে। কলাকেন্দ্রের ৫২টি প্রদর্শনীর মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের শিল্পীদের নিয়ে করা। অর্ধেকের বেশি নারী শিল্পীর কাজ রয়েছেযদিও আমরা পরিকল্পনা করে করিনি। একাডেমিক শিল্পী নয়এমন শিল্পীদের নিয়ে অন্তত পাঁচটি প্রদর্শনী হয়েছে। একাডেমি-নন-একাডেমি আমাদের জন্য ভূমিকা পালন করে না, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর নিষ্ঠাবোধ চেষ্টা। শিল্পচর্চার জন্য একাডেমি একটি দিক, তবে এখন আমরা যে তথ্যপ্রযুক্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তাতে আর্টিস্ট হওয়ার জন্য একাডেমিতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এছাড়া শিল্পচর্চা হতে পারে এবং ভালোই হতে পারে।

আশির দশকের শিল্পচর্চার যে পরিবেশ ছিল এখন তা কতটা পরিবর্তিত হয়েছে?

২০ বছরের পরিবর্তনটা বিভিন্নভাবে দৃশ্যমান। শিল্প-সংগ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে। বেশকিছু ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে, যারা বাংলাদেশী শিল্পীদের নিয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছে। সম্ভব হয়েছে ভার্চুয়ালি বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা, যার ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক আর্ট মার্কেট থেকেও কেউ কেউ বাংলাদেশের কাজের ব্যাপারে উৎসাহী। কর্মচাঞ্চল্যটা খুবই ইতিবাচক। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থ আর্টের পেছনে বিনিয়োগ করা হয়, তা বিরাট কিছু নয়।

 

সাক্ষাৎকার: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন