রুয়েটের অনিয়ম নিয়ে মন্ত্রণালয়ে ইউজিসির প্রতিবেদন

‘ভাইবোন, শ্যালক ও গৃহকর্মীকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেন উপাচার্য’

সাইফ সুজন

চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজশাহী প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) তত্কালীন উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। ভাইবোন, শ্যালক, গৃহকর্মী গৃহকর্মীর স্বামীকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে নানা মহল থেকে। অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয় সরকার। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির গোটা নিয়োগ কার্যক্রম নিয়ে আরো বেশকিছু গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি গতকাল ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউজিসি সচিব . ফেরদৌস জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ইউজিসির সম্মানিত সদস্য অধ্যাপক . মো. আবু তাহেরের নেতৃত্বে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সম্প্রতি কমিটি তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনটি কমিশনের উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই চার বছরের জন্য রুয়েটের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ। নিয়োগ পাওয়ার পরের বছর তিনটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রুয়েটে বিভিন্ন পদে ১৩৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। আর নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয় গত বছরের মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২তম সিন্ডিকেট সভায়। নিয়োগ অনুমোদনের পর অভিযোগ ওঠে, উপাচার্য স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে তার সহোদর মো. মুকুল হোসেনকে সেকশন অফিসার, আরেক সহোদর লেবারুল ইসলামকে জুনিয়র সেকশন অফিসার, শ্যালক সোহেল আহমেদকে পিএ টু ডিরেক্টর, চাচাতো বোন মাছুমা খাতুনকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, গৃহকর্মী লাভলী আরাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কুক, গৃহকর্মী লাভলীর স্বামী এনামুল হককে উপাচার্যের গাড়িচালক এবং স্ত্রীর ফুফাতো ভাই মেহেদী হাসানকে কেয়ারটেকার পদে নিয়োগ দেন। এছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে বেশি জনবল নিয়োগ দেয়ারও অভিযোগ ওঠে।

অবস্থায় গত ২০ মার্চ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ঘটনা অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ইউজিসির ওপর। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ খুঁজতে গিয়ে আরো বেশকিছু বিষয় উঠে আসে ইউজিসির তদন্ত কমিটির সামনে। কমিটির প্রতিবেদনে গোটা নিয়োগ কার্যক্রমের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির সংবিধি অনুযায়ী, নিয়োগ কমিটির সভাপতি হবেন উপাচার্য। তবে বহুল প্রচলিত নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রার্থীদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন থাকলে উপাচার্য তা ঘোষণা করে সিন্ডিকেটে অনুমোদন নিয়ে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে তার দায়িত্বে নিয়োগ দেবেন।

এক্ষেত্রে রুয়েট আইনে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে দুটি জায়গায় নির্দেশনা রয়েছে। ১০ (৩০) ধারায় বলা হয়েছে, উপাচার্যের পদ শূন্য হলে বা ছুটি, অনুপস্থিতি, অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো কারণে তিনি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে শূন্য পদে নবনিযুক্ত উপাচার্য কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিংবা উপাচার্য পুনরায় নিজ দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত এবং উপাচার্যের ভিন্ন সিদ্ধান্ত না থাকা সাপেক্ষে উপ-উপাচার্য উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন। আর ১১ () ধারায় বলা হয়েছে, উপাচার্য তার বিবেচনায় প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো ক্ষমতা দায়িত্ব, সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে অর্পণ করতে পারবেন।

উপাচার্যের আত্মীয়স্বজনদের যে বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়, তার প্রধান করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারকে। যদিও দায়িত্বভার প্রদানের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের অনুমোদিত নয়। যেহেতু নিয়োগ বোর্ডটি আইনসম্মত উপায়ে গঠিত হয়নি, সেহেতু ওই বোর্ড পরিচালিত নিয়োগ কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই অবৈধ বলে বিবেচিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।

রেজিস্ট্রারকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান করার বাইরেও -সংক্রান্ত আরো বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্যবিদায়ী উপাচার্যের মেয়াদে দেয়া ওই নিয়োগ কার্যক্রমের সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এমপিকিউর (ন্যূনতম নির্ধারিত যোগ্যতা) বাইরে গিয়ে অনেককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগপত্র ইস্যু করার সময় যে রেজিস্ট্রারে তথ্য সংরক্ষণের কথা, সেখানে নিয়োগপ্রাপ্তদের কোনো নাম বা পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া যে সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়, সে সভার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যদের সভার কার্যবিবরণী জানানো এবং অনুমোদনের কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। বরং এক বছর পরে কয়েকটি সিন্ডিকেট সভার পর সেটি সিন্ডিকেট সদস্যদের জানানো হয়। এছাড়া নিয়োগের লিখিত মৌখিক পরীক্ষায় নানা ধরনের ঘষামাজা অসংগতির তথ্যও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

নিয়োগ কার্যক্রমে উঠে আসা এসব অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এর মধ্যে উপাচার্যসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া অনিয়মে জড়িত থাকায় রুয়েটের রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।

ইউজিসির তদন্ত কার্যক্রম চলমান অবস্থায় গত ৩০ জুলাই উপাচার্য পদে মেয়াদ শেষ হয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখের। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য রেজিস্ট্রারের সেলফোনে কল দিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি।

এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগ কার্যক্রমে স্বজনপ্রীতি অনিয়ম করার অভিযোগ উঠেছে প্রমাণ মিলেছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক . মুহাম্মদ আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ঘোষণা দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে নিয়ম মেনে অন্য কাউকে নিয়োগ করেন। এমনকি ক্লাসেও কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে সংশ্লিষ্ট কোর্সের প্রশ্ন প্রণয়ন পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নৈতিক প্রচলন রয়েছে। এখন যা দেখছি বা শুনছি, তা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখজনক।

খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আরো বলেন, উপাচার্যের প্রধান দায়িত্ব কর্তব্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, সংবিধি বিধানের সংরক্ষণ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কঠিন হলেও এমন সংকল্পে দৃঢ় থাকতে হয় উপাচার্যদের। তাহলে কোনো ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। অন্যথায় যদি উপাচার্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা বা স্বার্থ হাসিল করেন তখন অধীনস্থরাও একই পথে হাঁটেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন