অত্যধিক ব্যাংকনির্ভরতা অর্থনীতিতে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে

শক্তিশালী বিকল্প গড়ে তোলা হোক

শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণে বড় পরিমাণ পুঁজি জোগানের জন্য দেশে ব্যাংক ছাড়া বিকল্প কোনো উৎস নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা দুর্বল। বড় বিনিয়োগের সক্ষমতা তাদের নেই। শেয়ারবাজার এখনো ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারেনি। এখান থেকেও বড় অংকের পুঁজি তোলার সুযোগ নেই বললে চলে। সমবায়ী ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোয় বড় অংকের পুঁজির জোগানে সক্ষমতা নেই। দেশের বন্ড মার্কেটও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারছে না। নানা উদ্যোগের পরও মিলছে না কোনো সুফল। ফলে বড় অংকের ঋণের জন্য সরকার বা উদ্যোক্তারা এখনো ব্যাংকমুখী। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বড় ঋণের জোগান দিতে পারে না। মোটা অংকের ঋণ হলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দ্বারস্থ হতে হয়। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। এর মধ্যে বিপুল খেলাপি ঋণ তৈরি হওয়ায় ব্যাংকগুলো রয়েছে সংকটে। শুধু তা- নয়, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নেও সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ছে। হাউজিং ঋণ, অবকাঠামো নির্মাণে ঋণ থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য ঋণেও অতিমাত্রায় ব্যাংকনির্ভরতা বিদ্যমান। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অর্থায়নের বিকল্প উৎস অনুসন্ধান এবং সেগুলো সৃজনে আরো মনোযোগী হতে হবে।

অর্থনীতিতে পুঁজির মূল জোগান আসে শেয়ারবাজার থেকে। উদ্যোক্তাদের পুঁজি গঠনে গড়ে ওঠে বন্ডের বাজার। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য থাকে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আর দৈনন্দিন সেবা দেয়ার পাশাপাশি ট্রেড ফাইন্যান্সে ভূমিকা রাখে ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশের সব কর্মকাণ্ডই ব্যাংক খাতকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। অর্থায়নের নিয়মানুযায়ী বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেবে। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চলতি মূলধনের জোগান দেবে। শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক ছিল। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা। দুটিকে এক করে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়ন করতে রয়েছে বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তহবিল সংকটের কারণে তারাও এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদি বড় অংকের ঋণ দিতে পারছে না।  পুঁজিবাজার প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের সব উন্নত দেশে। উন্নত বিশ্বের মতো অনেক আগে থেকেই অনেক উন্নয়নশীল দেশও ব্যবসায় সহজ দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চাহিদা মেটাতে সে পথে হাঁটছে। এক্ষেত্রে এখনো ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হাউজিং ঋণের ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ সংগ্রহ করে বন্ড বাজার থেকে। বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফান্ড পরিচালনা করছে। এতে ব্যয় বেড়ে উঠছে। এসএমই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও ব্যাংকনির্ভরতা বিদ্যমান। ভোগ্যপণ্য ঋণসহ যাবতীয় কার্যক্রম ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি সরকারও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। অথচ বন্ড বা বিকল্প উৎসের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় বিকল্প আর্থিক উৎস গড়ে উঠছে না, যা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।

যতদিন পর্যন্ত ব্যাংকঋণই হবে শিল্পায়ন বাণিজ্যের একমাত্র উপায়, ততদিন খেলাপি ঋণের বোঝা কমানো সম্ভব নয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করছেন। কথা সবারই জানা, বাংলাদেশ ব্যাংক-ফাইন্যান্স লেড গ্রোথ মডেল অনুসরণ করছে। চীন, ভারত পূর্ব এশীয় দেশগুলোও তাই। যারাই মডেল অনুসরণ করছে, তাদেরই খেলাপি ঋণ সংকট প্রকট। প্রতিবেশী ভারত থেকে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে বহু শিল্পপতি ব্যবসায়ী উধাও হয়ে গিয়েছে। চীনের সব টাকা সরকারি ব্যাংকের। তাদের হিসাব তারা ছাড়া কেউ জানে না। তবে কথা বলাই বাহুল্য, তাদের খেলাপি ঋণ সমস্যা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো নয়। জাপানও প্রথম অবস্থায় ব্যাংকের টাকায় উন্নয়ন করেছে। বাংলাদেশও একই পথ অনুসরণ করেছে। কিন্তু জাপান ঋণখেলাপি বন্ধে এক সময় কঠোর হলেও বাংলাদেশ এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

অতিমাত্রায় ব্যাংকনির্ভরতার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। যদি কোনো কারণে ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে পুরো অর্থনীতি জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়বে। বিশ্বে এমন উদাহরণের অভাব নেই। আশির দশকের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের সেভিংস অ্যান্ড লোন ক্রাইসিস, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ব্যাংকিং ক্রাইসিস প্রভৃতির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র অনুযায়ী সব ডিম যেমন এক ঝুঁড়িতে রাখতে হয় না, তেমনি দেশের পুরো আর্থিক ব্যবস্থাপনা শুধু ব্যাংকনির্ভর করতে হয় না। এতে একটি খাতের সংকট পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে সব অর্জন ম্লান করে দিতে পারে। বেশির ভাগ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরেই খেলাপি ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। ফলে নতুন ঋণপ্রবাহ আরো সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হবে বিবেচনায় নিলে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, যা সামাজিক স্থিতাবস্থার জন্য হয়ে উঠতে পারে হুমকিস্বরূপ।

পুঁজি সংগ্রহের জন্য মূলধন বাজার তৈরি করা প্রয়োজন। মূলধন বাজার পরিচালিত হবে একটি আইনের আওতায়। এতে কীভাবে বাজার থেকে পুঁজি নেয়া যাবে এবং কীভাবে পরিচালিত হবে, সেসব বিষয়ে বিস্তারিত বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে। উদ্যোক্তাদের পুঁজির প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করবে। কোম্পানি কত সুদে কী পরিমাণ পুঁজি তুলতে চায়, কত দিনের জন্য, সেটি উল্লেখ থাকবে আবেদনে। কর্তৃপক্ষ পর্যালোচনা করে বন্ড ছাড়ার অনুমোদন দেবে। অভিহিত মূল্যের ভিত্তিতে বন্ডগুলো বিভক্ত হবে। এসব বন্ড যেকোনো ব্যক্তি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিনতে পারবে। বন্ডে বিনিয়োগকারীদের অর্থের প্রয়োজন হলে সেগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটে বিক্রি করে টাকা তুলে নিতে পারবে। বছর শেষে কোম্পানিকে নির্ধারিত হারে মুনাফা দিতে হবে। মুনাফার হার হবে বাজারভিত্তিক। ভালো কোম্পানি কম মুনাফা দিয়ে পুঁজি নিতে পারবে। দেশে প্রচলিত শেয়ারবাজারের সঙ্গে এর পার্থক্য থাকবে, শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি নেয়া সময়সাপেক্ষ। এতে খরচও বেশি। বছর শেষে কোম্পানি মুনাফা দিতেও পারে আবার নাও দিতে পারে। এতে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। কিন্তু মূলধন বাজার থেকে দ্রুত কম খরচে পুঁজি নেয়া যাবে। বছর শেষে নির্ধারিত হারে মুনাফা দিতে হবে। এতে ঝুঁকির মাত্রা কম হবে। কেননা, খ্যাতিমান সম্ভাবনাময় ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানি বাজার থেকে পুঁজি নিতে পারবে না। আর মুনাফার হার নির্ধারিত বলে সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের দাম বেশি হারে ওঠানামার সুযোগ থাকবে না। বর্তমানে যে বন্ড মার্কেট রয়েছে, এতে বিনিয়োগ করার পদ্ধতি বেশ জটিল। একই সঙ্গে মুনাফা কর কাঠামোও জটিল। যে কারণে এর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই। আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মূলধন বাজারে নানা ধরনের উপকরণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্ড, ট্রেজারি নোট, জিরো কুপন বন্ড, প্রিমিয়াম বন্ড, ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, কারেন্সি বন্ড প্রভৃতি। এগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন কোম্পানির নামে ইস্যু করা। আবার করপোরেট কোম্পানিগুলোও এতে বিনিয়োগ করে। পাশাপাশি ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পরবর্তী ধাপের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করছে, সেখানে মূলধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেক্ষেত্রে কার্যকর মূলধন বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্বের প্রতিটি শক্তিশালী অর্থনীতির পেছনে সে দেশের পুঁজিবাজার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের গতিপ্রকৃতির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। উদ্যোক্তা পর্যায়ে শিল্পের সম্প্রসারণ বা যেকোনো ধরনের স্বল্প দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জন্য তাই ব্যাংক বা আর্থিক খাতই প্রধান নির্ভরতার জায়গা। বিকল্প উৎস না থাকার ফলে ঋণ পাওয়ার অসম প্রতিযোগিতা খাতে বিদ্যমান, যা খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা অতি জরুরি, অন্যথায় আগামী দিনগুলোয় পুঁজির সংকটে ব্যবসায়িক সক্ষমতা হারিয়ে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে শিল্প খাত, নতুন উদ্যোক্তা সংকটে অস্বাভাবিকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে শ্রমবাজার এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই এর রেশে আর্থিক খাতের দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আরো দুর্বল হয়ে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে।

সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই পুঁজিবাজারে গতিশীলতা আনার বিকল্প নেই। কথাও সত্য, পুঁজিবাজার বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখানে বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়েই বিনিয়োগ করেন। বাজারসংশ্লিষ্টরা তাই ঘন ঘন নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিবর্তনকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য অন্তরায় মনে করেন। কারণে শুধু অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়াস বা বিনিয়োগের জন্য শর্তগুলো ক্ষেত্রবিশেষে সহজ করা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি খাতের বৃহৎ বিনিয়োগ সবসময় বাজারে দেখা যায় না, যার প্রমাণ দেশের পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরে দেখা গিয়েছে। তাই আর্থিক প্রণোদনা নয়, বরং মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি জুতসই নীতিসহায়তা এবং বিদ্যমান আইনের নির্মোহ প্রয়োগই জাগিয়ে তুলতে পারে দেশের পুঁজিবাজারকে, যা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। বন্ড বাজারও গড়ে তোলা আবশ্যক। এখান থেকে অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বিনিয়োগের তহবিল সংগ্রহ সম্ভব। প্রত্যাশা থাকবে, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক দ্রুতই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন