স্কুলের ধুলা-মাটিতে সহনীয় মাত্রার বেশি ভারী ধাতু

শ্লথ হচ্ছে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার গতি

জেসমিন মলি

গত কয়েক দশকে ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার মানিয়ে দেবে যেকোনো তত্ত্বকে। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শহরের শিল্পসহ অন্যান্য অবকাঠামো। বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যাও। তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে ঢাকার মাটি-পানি-বাতাসে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে শহরের আনাচে-কানাচে। রেহাই পায়নি স্কুলগুলোও। সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, বড় রাস্তার পাশে অবস্থিত স্কুলগুলোর ধুলা-মাটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি কপার, সিসা, জিংকের মতো ভারী ধাতু মিলছে। এসব ধাতুর উপস্থিতি শ্লথ করে দিতে পারে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার গতি। হতে পারে কিডনি রোগ বা ক্যান্সার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

ডিসাইফেরিং দ্য অরিজিন অব কপার, লিড অ্যান্ড জিংক কন্টামিনেশন ইন স্কুল ডাস্ট অ্যান্ড সয়েল অব ঢাকা, মেগাসিটি ইন ঢাকা শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের ধুলা মাটিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতির তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা স্প্রিঙ্গারে ইনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চে ২০২১ সালের মার্চের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণার জন্য ঢাকা শহরের ১১টি স্কুল ভবনের জানালা থেকে ধুলার নমুনা নেয়া হয়েছে। মাটির নমুনা নেয়া হয়েছে উপরিভাগের এক সেন্টিমিটার আস্তরণ সরিয়ে তিন সেন্টিমিটার মাটি থেকে। যেসব স্কুল থেকে নমুনা নেয়া হয়েছে তার মধ্যে আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুল কলেজ, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, মিরপুর গভর্নমেন্ট প্রাইমারি স্কুল, ধানমন্ডি বয়েজ গভর্নমেন্ট স্কুল, ন্যাশনাল বাংলা কলেজ হাই স্কুল, ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ উল্লেখযোগ্য।

বিষয়টি নিয়ে গবেষক দলের প্রধান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা . মো. শফিউর রহমান বলেন, ঢাকার শিল্প-কারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ার ফলে বাতাসে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশে যায়। এছাড়া নির্মাণ সামগ্রীর মাধ্যমে দূষণের বিস্তার ঘটে। এসব দূষণের শিকার হচ্ছে ঢাকার স্কুলগুলোও। গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল স্কুলগুলোতে দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা। বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা দূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্প এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া নির্মাণ সামগ্রীর দূষণের মাধ্যমে শহরের আবাসস্থলের মাটিতে মিলছে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত জৈব, বাতাসে মিলছে বিভিন্ন ক্ষতিকর কণা। দীর্ঘমেয়াদি দূষণের কারণে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। স্কুলগামী শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তারা বেশি শ্বাস নেয় এবং তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম। শ্রেণীকক্ষ স্কুলের মাঠ থেকে শিশুরা ধুলা মাটির সংস্পর্শে এসে দূষণের স্বীকার হয়। খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে এমনকি চামড়া দিয়ে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে। বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শে শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা তাদের বেড়ে ওঠার গতি কমিয়ে দেয়। হতে পারে কিডনি রোগ এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার। ঢাকা শহরের ধুলা মাটির দূষণ প্রতিরোধে বিশেষ করে স্কুলসংশ্লিষ্ট এলাকাতে যাতে কম দূষণ হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে বলে প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন মালিকদের হিসাবে রাজধানী ঢাকায় কম-বেশি পাঁচ হাজার পাবলিক বাস চলে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার রাস্তায় এমন বাস নামানো হয়, যেগুলোর বিনিয়োগ খরচ এরই মধ্যে উঠে এসেছে। পুরনো হয়ে যাওয়ায় এসব বাসের রক্ষণাবেক্ষণও মালিকরা ঠিকমতো করেন না। ফলে নতুন গাড়ির তুলনায় পুরনো গাড়িগুলো দূষণ

ছড়াচ্ছে নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেক বেশি। এসবের বাইরে মাইক্রোবাস, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংক, হিউম্যান হলার, মোটরসাইকেল, লরিসহ বিভিন্ন ধরনের হালকা ভারী মোটরযান থেকেও ক্ষতিকর উপাদান নির্গত হচ্ছে সমানতালে। বাংলাদেশে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত নিম্নমানের ডিজেলও দূষণের পাল্লা ভারী করছে বলে উঠে এসেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে।

ঢাকার পরিবেশ দূষণের আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইটভাটা। ঢাকার চারপাশে চার থেকে পাঁচ হাজার ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার চিমনি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। অতিরিক্ত কাঠ কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার নাইট্রোজেন অক্সাইড, যা বায়ুমণ্ডল দূষিত করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকায় বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫৪ শতাংশ ইটভাটা থেকে হয়, যা দূষিত করে চলেছে ঢাকার মাটিও।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, খাবারের মাধ্যমে এসব ভারী ধাতু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলে। প্রথমত, এসবের কারণে ত্বকের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে কিডনি, ফুসফুস মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া এসব ধাতু মানবদেহে ক্যান্সারের মতো রোগও সৃষ্টি করতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর -১২ হাজার শিশু-কিশোর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যান্সারের মূল কারণ হচ্ছে জিনগত পরিবর্তন। এছাড়া ভেজাল খাদ্য, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বায়ুদূষণ বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে শিশুদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন