তামাক ব্যবহারের অভ্যাস
বড়জোর ৫০০ বছরের। অতীতের
সমাজ ব্যবস্থায়
নেশার প্রচলন
ছিল। কিন্তু
‘ড্রাগস’ বা ‘মাদক’ নামে হালে নেশার
সর্বগ্রাসী যে রূপ আমরা দেখছি, যেমন অ্যালকোহল, হেরোইন,
মরফিন, প্যাথেডিন,
লাইসারজিক অ্যাসিড
ডায়াথিলামাইড (এলএসডি)
নানা মাদকের
আবির্ভাব হয়েছে
বড়জোর ৫০ বছর। আর এখন এসবের
বিস্তৃতি ও ব্যাপকতায় দেশ-জাতি-শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক মরণনেশার চক্রে
পড়েছে। অকালে
নিঃশেষিত হচ্ছে
হাজারো সম্ভাবনাময়
জীবন। বিশ্বের
সব সমাজ ব্যবস্থাতেই ব্যক্তিসত্তার বিবেক, বুদ্ধি, বিচারক্ষমতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব,
আদর্শ সবকিছু
লোপ পাচ্ছে।
প্রশ্ন
হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উত্কর্ষের এ যুগে মানুষ
কেন আত্মধ্বংসী এ মরণনেশায় মেতে
উঠল? কী এর কারণ?
নিগূঢ় সত্য
হলো, অর্থ-পুঁজি-বৈষম্য
নিয়ন্ত্রিত বতর্মান
নব্য উদারবাদী
অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায়
মানুষ অর্থের
পেছনে ছোটাছুটি
করে ক্রমে
একা হয়ে যাচ্ছে, পারস্পরিক
সব বন্ধনই
ছিন্ন করে মানুষ হচ্ছে
সমাজচ্যুত। একপর্যায়ে
নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা
ব্যক্তিজীবনকে অসহায়
করে তুলছে,
নিস্তার পেতে
নেশার রাজ্যে
হারিয়ে যাচ্ছে।
পুঁজিবাদের মূল পাদপীঠ আমেরিকা, যে কিনা যুদ্ধ বাধানো আর মুনাফা ছাড়া কিছুই বোঝে না, সে-ও এখন মাদকের দংশনে বিপর্যস্ত। নিজ স্বার্থ হাসিলে এ দেশটির নেতৃত্বাধীন সম্প্রসারণশীল ধনতন্ত্রই বিশ্বব্যাপী মাদক বিস্তারে মূল ভূমিকা রেখেছে। ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের আনাচে কানাচে তামাক-পপি-অপিয়ামসহ ভয়াবহ সব মাদকের চারা ব্রিটিশ-আমেরিকান বাণিজ্য দলই রোপণ করেছে। বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী সরকারকে ঘায়েল করতে এসকোবার-নরিয়েগাদের মতো মাদকসম্রাট-স্বৈরাচার এরাই সৃষ্টি করেছে। আবার নিজ স্বার্থে এরা নির্দ্বিধায় তাদের হত্যাও করেছে।
উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ও গভীর বিশ্লেষণধর্মী একটি গ্রন্থ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির নাম মাদক-ড্রাগস: ভেষজবিজ্ঞান ও সামাজিক অবক্ষয়। গ্রন্থটির লেখক ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল সংবিধানে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম ডা. এমএ কাসেম; যিনি ১৯৯৪ সালে প্রয়াত হন। গ্রন্থটির কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, এটির রচনাকাল এখন থেকে ৩০-৪০ বছর আগে। মোট ৬০৪ পৃষ্ঠার এ গবেষণা গ্রন্থ পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটি অধ্যায়ের অধীনে রয়েছে সংখ্যাভিত্তিক একাধিক উপ-অধ্যায়। কৃতজ্ঞতা স্বীকার, তথ্যপঞ্জি, নির্ঘণ্ট, সারণি, চিত্রসহ এ গ্রন্থের শুরুতেই লেখকের পাঁচ পুত্র রচিত তাদের মা-বাবার (মা বেগম নুরুন নাহার এবং বাবা ডা. এমএ কাসেম) সম্পর্কে একটি স্বরূপ অণ্বেষণধর্মী লেখা সংযোজিত হয়েছে, যা পড়ে কৌতূহলী পাঠক লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ পাবেন। এছাড়া এ গ্রন্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিক ফুটনোট সংযোজন করা হয়েছে।
গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে প্রসঙ্গ কথা দিয়ে, যেটি মূলত একটি চিঠি। এ অধ্যায়েই আলোচিত হয়েছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে লেখকের ছোটবেলায় কলকাতা ভ্রমণকালে বেথুন কলেজের সামনে রাস্তায় দেখা নেশাগ্রস্ত এক লোকের আচরণ ও কথাবার্তা। যার সূত্র ধরে লেখক পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন বাংলা ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু অজানা ইতিহাস। গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে মাদক-ড্রাগসের ভেষজবিজ্ঞান ও সামাজিক অবক্ষয় বিষয়ে। এ অধ্যায়ের শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে নেশার প্রথম উপাদান তামাক নিয়ে। তামাকের উদ্ভব ও ইতিহাস, তামাকের উদ্ভিজ্জ শ্রেণীবিভাগ, তামাক খাওয়ার ইতিহাস, তামাকের রাসায়নিক পদার্থগুলোর বর্ণনা মেইন স্ট্রিম, সাইড স্ট্রিম, তামাক থেকে নিকোটিন বের করার ইতিহাস, শরীরের বিভিন্ন অংশের ওপর তামাকের বিষক্রিয়া ও প্রভাব, প্যাসিভ স্মোকিং, কেন ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করা শক্ত কাজ, ধূমপানে ভোগান্তি ও মৃত্যু, তৃতীয় বিশ্বে ধূমপান, সাহায্যদাতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ধূমপান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ মতামত; ধর্মীয় দৃষ্টিতে তামাক, স্ববিরোধী আচরণ, বাংলাদেশে তামাক চাষ, বিজ্ঞাপন, মদ-সুরা-অ্যালকোহল, অ্যালকোহল: বিপাক এবং জারণ, অ্যালকোহল নিষ্কাশন, খাদ্যমান, ঘুণে ধরা গ্রামীণ সমাজ, মদ্যপানে সমস্যা, পরিপাকতন্ত্রের ওপর মদের প্রভাব, হূিপণ্ডে ও রক্ত সংবহনে প্রভাব, মস্তিষ্কের ওপর মদের প্রভাব, শ্বসনকেন্দ্রের ওপর প্রভাব, মদ্যপের আচরণ, মদ পরমায়ু, নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য, সেক্স, মদ্যপ নারীর গর্ভধারণ ও গর্ভস্থিত সন্তানের ভবিষ্যৎ, ড্রিংক বনাম ইন্ডাস্ট্রি, অ্যালকোহল ও ক্রাইম, মদ্যপ গণবক্তা ও বক্তৃতা, ড্রিংক বনাম ডেমোক্রেসি, ড্রিংক ও ড্রাইভিং, মদ ও মেদ, মদ্যপান একটি সামাজিক রীতি, মদ্যপানে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, বর্তমান বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের চিত্র, পশ্চিমবঙ্গের শহর নগর শিল্পাঞ্চল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত রাশিয়ার অভ্যন্তরে, মদ্যপ, তার পরিবার ও তার সম্মান, মদ্যপাননির্ভরতা সিনড্রোম, সুরাসক্তের বংশগতি অন্বেষণ, মদ্যপানে বিষক্রিয়া মনোবৈকল্য বিকার, বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারক, আফিম-মরফিন-হেরোইন।
গ্রন্থটির
তৃতীয় অধ্যায়ে
আলোচনা হয়েছে
গ্লোডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ওয়েজ, গোল্ডেন
ক্রিসেন্ট ও এশিয়ায় ড্রাগের
মহামারী সম্পর্কে।
মাদক-ড্রাগস
ও মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে
আলোচনা করা হয়েছে গ্রন্থটির
চতুর্থ অধ্যায়ে।
এ অধ্যায়ের
উপ-অধ্যায়ে
আলোচনা হয়েছে
মাদক সাম্রাজ্যের নিপুণ কারিগর কলম্বিয়ার
এক মাফিয়া
ব্যারন সম্পর্কে।
এছাড়া মাদক
বিস্তারে সিআইএ
ও নরিয়েগার
বিচার নিয়ে
আলোচনা রয়েছে
এ অধ্যায়ে।
পঞ্চম ও শেষ অধ্যায়ে
আলোচনা হয়েছে
আন্তর্জাতিক মাদক
প্রতিরোধী সংস্থাগুলোর স্বরূপ নিয়ে। এ অধ্যায়ের উপ-অধ্যায়ে ভূমিকাসহ
তুলে ধরা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্বরূপ; ‘মাফিয়া-মানি’ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি,
যেন ভুলে
না যাই এবং মাদকের
রাজনীতি ও মার্কিন সরকার
বিষয়ে।
বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ ও গবেষণাধর্মী এ গ্রন্থ রচিত হয়েছে প্রচুর তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে, যা এর একটি শক্তিশালী দিক। তবে গবেষণাধর্মী হলেও লেখক অনেক জটিল বিষয় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। গল্প বলার ভঙ্গিতে লেখক তুলে ধরেছেন মাদক সম্পর্কিত দেশ-বিদেশের নানা কাহিনী, ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়। এক কথায় বলতে গেলে শুধু মাদকের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণই নয়, এ বইয়ে বিধৃত হয়েছে মাদকের পেছনের রাজনীতি-অর্থনীতিসহ বাংলাদেশ ও বিশ্বের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়। এ গ্রন্থে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গ্রন্থ, জার্নাল ও পত্রপত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক তার সুগভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোনো বিষয়কে সহজে বোধগম্য করতে লেখক দেশী-বিদেশী প্রখ্যাত কবি ও লেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এক কথায় বলা যায়, মাদক সম্পর্কে এটি একটি আকর গ্রন্থ; যা চিকিৎসক, চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র-ছাত্রী, বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানীসহ সর্বস্তরের মানুষের জন্য অবশ্য পাঠ্য বলে মনে করি। গ্রন্থটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্ম এটি পাঠে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
সেই সঙ্গে গ্রন্থটি পাঠে মাদকের অন্দর-বাহির এবং সমাজ ও পরিবারে এর প্রভাব সম্পর্কে বিজ্ঞ পাঠক বিস্তারিত ধারণা পাবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যখন তথ্যপ্রবাহ এত সহজ ছিল না, তখন প্রত্যন্ত কুষ্টিয়া শহরে অবস্থান করে, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও তথ্য সংগ্রহ করে, অত্যন্ত পরিশ্রম করে লেখক মাদক সম্পর্কে তথ্যবহুল যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন, তা এক কথায় অমূল্য। বর্তমান সময়ে শহর থেকে গ্রামাঞ্চল অবধি মাদকের যে বিস্তৃতি আমরা দেখছি তা ৪০ বছর আগেই লেখক এ গ্রন্থে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। আশা করি, বিজ্ঞ পাঠক গ্রন্থটি পাঠ করে উপকৃত ও সচেতন হবেন।
ড. মতিউর রহমান: গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা