চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে আরো বাণিজ্যভার বহন সম্ভব না

বদরুল আলম

দেশে পণ্য আমদানি-রফতানির প্রধান কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দর দিয়েই দেশের ৯০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য হয়। গত অর্থবছর শেষে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গতকালই রফতানি নীতি ২০২১-২৪-এর অনুমোদন দিয়েছে। এতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এর সঙ্গে আমদানি মিলিয়ে ২০২৪ সাল শেষে দেশের মোট বাণিজ্যের আকার হবে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সংশ্লিষ্টদের মতে, ৯০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যেই ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের অতিরিক্ত সক্ষমতা। ফলে বিদ্যমান সক্ষমতায় আরো নতুন বাণিজ্যভার বন্দরটির পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না।

চট্টগ্রাম বন্দরের যাত্রাকালে মৌলিক নকশায় পণ্য বহনে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ছিল ২০ লাখ টিইইউ (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার। ২০০৯ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৯৯৯ টিইইউ। ২০১৬ সালেই যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর কনটেইনার হ্যান্ডেল হয় ২০ লাখ ২৪ হাজার ২০৭ টিইইউ। সমাপ্ত ২০২১ সালে যা ৩২ লাখ ছাড়িয়ে গিয়ে কনটেইনার হ্যান্ডেল হয়েছে রেকর্ড ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৮ টিইইউ। হিসাবে মূল সক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি কনটেইনার বহন হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।

বাণিজ্য-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির বর্তমান গতিতে এরই মধ্যে সক্ষমতার অনেক বেশি বোঝা বহন করছে চট্টগ্রাম বন্দর। বাণিজ্যের বর্তমান গতিতে চলতি বছর বন্দর জট আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বক্স ফ্যাসিলিটি হিসেবে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে আরো লাখ টিইইউ কনটেইনার সক্ষমতা যোগ হবে।

তবে সক্ষমতার ঘাটতি রাতারাতি পূরণ করা সম্ভব নয় বলছেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে এখনো বছরের বেশির ভাগ সময় জাহাজজট লেগে থাকার কারণ হলো বন্দরটিতে সক্ষমতার চেয়ে বেশি পণ্য আসে। ভবিষ্যৎ চাপ সামাল দিতে বন্দরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো বে টার্মিনাল। অথচ এখন পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণের কাজই শেষ হয়নি প্রকল্পটির। প্রকল্পের সঙ্গে সড়ক, অভ্যন্তরীণ নৌপথ রেলে পণ্য পরিবহনের সহজ যোগাযোগের সুবিধা রয়েছে। কিন্তু টার্মিনালের কার্যকারিতা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। সব মিলিয়ে রফতানি আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন যে বাণিজ্যভার আসন্ন, তা বহনের সক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের নেই। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই প্রতিনিধিরা বলছেন, রফতানি পণ্য বন্দরে পৌঁছে নানা জটিলতা পেরিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে, নদীপথএসব বিষয়ে একযোগে কাজ করতে না পারলে আরো জটিল পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে। এখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম সড়কপথে যেতে গড় গতি ৪০ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে।

এত সময়ক্ষেপণের পর পণ্য বন্দরে আনা সম্ভব হলেও পড়তে হয় বন্দর জটে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেমিক্যাল পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণসহ নানা কারণে এখন বন্দরে জট লেগেই থাকে। এখন প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি হচ্ছে, যখন ৮০ বিলিয়ন ডলার রফতানি হবে, তখন ৮০ বিলিয়ন ডলার রফতানির অবকাঠামোও প্রয়োজন হবে। বর্তমান সক্ষমতা একদিকে অপ্রতুল, যা আছে তা প্রতি মুহূর্তে হারাচ্ছে। অবস্থায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির জন্য যেখানে যেখানে ঘাটতি আছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে দূর করতে হবে।

এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ৮০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের নেই। এর পাশাপাশি আছে নানা প্রতিবন্ধকতা, এগুলো দূর করতে হবে। তাহলে আমাদের সক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। বন্দরে পণ্য পরিবহন নিয়ে নানামুখী বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয় আমদানি-রফতানিকারকদের। অনেকগুলো জটিলতা আছে আমাদের, যেগুলো থেকে মুক্ত হতে হবে। পানগাঁওয়ে বন্দর করা হয়েছে, সেটা কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না। কার্যকর করতে যে নদী শাসন দরকার, ড্রেজিং দরকার তা আমরা কেন করছি না। গভীর সমুদ্রবন্দর হয়েছে পায়রায়, মাতারবাড়ীতে, কেন কাজে লাগাচ্ছি না। বে টার্মিনালের কার্যকারিতাও দেখছি না। এগুলো সবই পরিকল্পনা করে করা হয়েছে, তার পরও কাজে দিচ্ছে না। এগুলো করার উদ্দেশ্যই হলো আরো বড় পরিমাণে বাণিজ্য, তা ৮০ হোক বা ৩০০ বিলিয়ন হোক সেই জন্য। সক্ষমতা বৃদ্ধির যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। রফতানি বৃদ্ধির জন্য যেসব লজিস্টিকস লাগবে, সাপ্লাই চেইন লাগবে, সেগুলোকে ঠিক করতে হবে। এগুলো সবই একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্দরের মাধ্যমে পণ্য ওঠানামা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেয়ায় প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের মতো। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র বলছে, কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরুর পর থেকে ২০২১ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড গড়েছে। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৮ টিইইউ রফতানি, আমদানি খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২০ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউ। চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে জেটির পাশাপাশি পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল এবং ঢাকার কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে লোড-আনলোড করা কনটেইনারের সংখ্যা যুক্ত করে চিত্র পাওয়া গেছে।

শুধু কনটেইনারেই নয়, কার্গো জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও সদ্য শেষ হওয়া ২০২১ সালে সর্বোচ্চ। বছর কার্গো হ্যান্ডলিং হয় ১১ কোটি ৬৬ লাখ ১৯ হাজার ১৫৮ টন। এর আগে ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৩২ লাখ হাজার ৭২৪ টন। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ সালে হাজার ৭২৮টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করলেও ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার ২০৯টিতে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা বেড়েছে। জাহাজের ওয়েটিং টাইম জিরো হওয়ায় এখন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। বিশ্বে করোনা মহামারীতে বন্দরগুলো বন্ধ রেখে তাদের কার্যক্রম সংকুচিত করেছে। অথচ সময়ে একদিনের জন্যও বন্ধ রাখা হয়নি চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম। ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি কনটেইনার পরিবহন শুরু করেছি আমরা। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে সম্প্রতি সার্ভিস জেটি, ওভার ফ্লো ইয়ার্ড নির্মাণের পাশাপাশি নতুন টাগ বোট সংগ্রহ করা হয়েছে। গেন্ট্রি ক্রেন বাড়ানোসহ ইয়ার্ডের স্পেস বাড়ানোয় প্রডাক্টিভিটি বহুগুণ বেড়ে গেছে। পিসিটি, বে টার্মিনাল, মাতারবাড়ীর কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল খুব দ্রুতই উদ্বোধন করা যাবে। এতে বন্দরের সক্ষমতা আরো অনেক বাড়বে।

আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণে দেখা যাচ্ছে ২০২৬ সাল নাগাদ বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন হবে ৩৪ লাখ হাজার একক। ২০৪১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৯ লাখে। বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়তে থাকায় এককভাবে চাপও বাড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, তেল শোধনাগার, জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ফলে সময়মতো অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়ায় বছরের স্বাভাবিক সময়ে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনের চাপ নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে জাহাজজট হয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে ব্যয় বাড়ে ব্যবসায়ীদের।

বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কনটেইনার পরিবহনে গত বছর রেকর্ড হয়েছে এটা ভালো খবর। তবে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সময় কমিয়ে এনে চট্টগ্রাম বন্দরে উৎপাদনশীলতা বা সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমদানি রফতানি উভয়ই বাড়তে থাকবে। জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিংয়ের গবেষণা বলছে, ২০৩৬ সালে ২০ ফুট দীর্ঘ ৫৬ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে। ভারত দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন শুরু হওয়ায় চাপ আরো বাড়বে। ফলে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয় সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বে টার্মিনাল নির্মাণে গড়িমসি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ অধিক জেটি অধিক টার্মিনাল স্থাপন ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সমুদ্রবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এটা করা গেলে দেশে ব্যবসার খরচ কমে আসার পাশাপশি বিদেশী উদ্যোক্তারাও দেশে বিনিয়োগের জন্য আরো বেশি আগ্রহী হবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন