ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন

বর্জ্যবাহী ৩৩০ গাড়ির ২০৮টিরই মেয়াদ নেই

আল ফাতাহ মামুন

রাজধানীর প্রতিদিনকার বর্জ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের মোট ৩৩০টি গাড়ি। ময়লার গাড়ি হিসেবে পরিচিত বাহনগুলো রোজ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তের বর্জ্য সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট ভাগাড়ে পৌঁছে দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই এগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত গতি, চালকের অদক্ষতা, অপেশাদার চালক দিয়ে কাজ চালানোর মতো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। তবে গত সপ্তাহে পরপর দুদিন দুটি দুর্ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় আসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী এসব গাড়ি। জানা যায়, বহরের অধিকাংশ গাড়িই মেয়াদোত্তীর্ণ, নেই পর্যাপ্ত দক্ষ বৈধ চালকও।

গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্জ্যবাহী গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যু হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্জ্যবাহী আরেক গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবীর খান। সিটি করপোরেশনের গাড়িগুলোর দুর্ঘটনার আরো ইতিহাস রয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে মিরপুরে ডিএনসিসির ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় আবদুল খালেক হাওলাদার নামে একজন ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতা মারা যান। তার আগের বছর বংশালে ডিএসসিসির বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান নূরজাহান বেগম।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটানো এসব গাড়ির বেশির ভাগেরই ফিটনেস নেই। দুই সিটিতে চলাচলরত ৩৩০টি ময়লাবাহী গাড়ির মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ২০৮টি।

একটি সূত্র জানিয়েছে, দুই সিটি করপোরেশনের নিবন্ধিত মোট গাড়ির সংখ্যা ৯৪২। এর মধ্যে ডিএনসিসির মোট গাড়ির সংখ্যা ৩৩৩টি, যার মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহূত হয় ১৪৭টি এবং ডিএসসিসির মোট গাড়ির সংখ্যা ৬০৯টি, যার ১৮৩টি ব্যবহূত হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। সব মিলিয়ে দুই সিটির মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ২৭২। হিসেবে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ৯০ শতাংশই বর্জ ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহূত ভারী যান।

বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভারী যানের অধিকাংশেরই মেয়াদ ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তার ওপর যারা এগুলো চালাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ অপেশাদার। ফলে এতে দুর্ঘটনা প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে বেপরোয়া গতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু বারবার দুর্ঘটনার পরও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ডিএসসিসির মোট যানবাহনের সংখ্যা ৬০৯টি। তবে সংস্থাটির নিবন্ধিত চালক রয়েছেন মাত্র ১৪৭ জন। পাশাপাশি ২০০টি গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালকদের দিয়ে। ডিএসসিসির একটি সূত্র বলছে, তাদের অধিকাংশই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। যাদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ বা ড্রাইভিং লাইসেন্স। ডিএসসিসির বাকি ১৬৬টি গাড়িও চলে অদক্ষ অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। ফলে গাড়িগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়। দক্ষিণ সিটির পরিবহন বিভাগ সূত্র বলছে, যে গাড়ির চাপায় নাঈম হাসান নিহত হয়েছেন সেটি ভারী যান। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহারের জন্য এমন ৩১৭টি ভারী যান আছে। কিন্তু চালক আছেন মাত্র ৮৬ জন। অর্থাৎ বেশির ভাগ ভারী যানই চালাচ্ছেন অদক্ষ অপেশাদার চালকরা।

ঘাটতি মেটাতে গত বছর স্থানীয় সরকারের কাছে ১০৭ জন চালক নিয়োগের চিঠি দেয় ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। জবাবে ৫০ জন চালক নিয়োগের অনুমিত পায় সংস্থাটি। গত ২৯ জানুয়ারি এসব চালক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কেবল ১৯ জন চালক নিয়োগ দিতে পেরেছে ডিএসসিসি। একই চিত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বেলায়ও। উত্তর সিটির ৩৩৩টি গাড়ির মধ্যে ১৪৭টি বর্জ্যবাহী ট্রাক। কিন্তু সংস্থাটির নিয়োগপ্রাপ্ত ড্রাইভার সংখ্যা ৩৪।

দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত নিয়মিত সেবা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের গাড়ি চালাতে হয়। কারণ চালকের অপেক্ষায় থাকতে গেলে সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ বর্জ্যই সময়ের মধ্যে অপসারণ করা যাবে না।

গাড়ি সংকটের কারণে সেবা অব্যাহত রাখার জন্যই পুরনো গাড়ির মধ্যে যেগুলো চলনসই, সেগুলো সড়কে চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক মো. মিজানুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, পাশাপাশি নতুন গাড়িও নামানো হচ্ছে। তবে যেহেতু সংকট রয়েছে, তাই কিছু পুরনো গাড়িও চালানো হয়।

রাজপথে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী সব যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন ফিটনেস থাকতে হবে। তা সে সরকারি হোক বা বেসরকারি। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলোর যদি নিবন্ধন না থাকে অথবা চালকের লাইসেন্স না থাকে, তাহলে অবশ্যই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হবে। বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন