অবাধ পতনে অর্থনীতি

বিনিয়োগকারীদের দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে মিয়ানমারের পরিবেশ

বণিক বার্তা ডেস্ক

নেপিদোর কেম্পেনস্কি হোটেল ছবি: মিয়ানমার নাউ

২০১৪ সালে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোয় বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল খুলেছিল জেনেভাভিত্তিক লাক্সারি হোটেল চেইন প্রতিষ্ঠান কেম্পেনস্কি। ১৩ অক্টোবর থেকে হোটেলটির কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কেম্পেনস্কি গ্রুপ। একসময় দেশটিতে মিয়ানমারে ঘুরতে আসা বিদেশী পর্যটকদের জন্য বড় আকর্ষণ ছিল হোটেলটি। কভিডের ধাক্কা কাটিয়ে হোটেলটির ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাজনিত অনিশ্চয়তার মধ্যে মিয়ানমারে সাড়ে কোটি ডলারের বিনিয়োগ আটকে না রাখাতেই মঙ্গল দেখতে পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

একইভাবে মিয়ানমার ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোও (বিএটি) কোম্পানিটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ দেশটি থেকে কার্যক্রম পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে ব্যবসার এক দশক পূর্ণ হওয়ার আগেই। ২০১৩ সালে কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে মিয়ানমারে কার্যক্রম শুরু করেছিল বিএটি।

কেম্পেনস্কি গ্রুপ বা বিএটির মতো বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মিয়ানমারের পরিবেশ এখন ব্যবসা চালানোর পুরোপুরি অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই দেশটির পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। অবাধে পতন ঘটছে অর্থনীতির। জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক মরিয়া ভাবও প্রকট। খাদ্যপণ্যের মূল্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মূল্যস্ফীতি লাগামহীন। সর্বশেষ শুধু গত মাসেই মুদ্রাবাজারে বর্মি কিয়াতের অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। যদিও সাধারণ জনগণের হাতে নগদ মুদ্রার সরবরাহ নেই বললেই চলে। প্রতিদিনই অর্থ উত্তোলনের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ছে এটিএম বুথগুলোর সামনে। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে নজিরবিহীন এক বিশৃঙ্খলা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দেশটিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া অর্থবছরে জিডিপির সংকোচন হয়েছে ১৮ শতাংশ। দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে অর্থনীতির এত বড় ধস আগে কখনই দেখা যায়নি।

পরিস্থিতি থেকে কবে নাগাদ পরিত্রাণ মেলার সম্ভাবনা রয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ বা পর্যবেক্ষকদের কারো কাছেই সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। বরং দেশটির আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার দুর্বিপাক আরো জোরালোভাবে চেপে বসার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন তারা। যেকোনোভাবে হোক গোটা মিয়ানমারে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর সামরিক জান্তা। এজন্য ব্যাপক আকারে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর। অন্যদিকে বর্মি সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) বিরুদ্ধে চলছে সশস্ত্র প্রতিরোধও। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকাসহ সীমান্ত এলাকাগুলোয় তাতমাদোর সঙ্গে বিরোধী সশস্ত্র সংঘাত দিন দিন চরম আকার নিচ্ছে। বিশেষ করে চিন প্রদেশে এখন সংঘাত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না সামরিক জান্তা।

অস্থিতিশীলতার মধ্যে দেশটিতে জ্বালানি নিত্যপণ্যের দাম ক্রমে বেড়ে চলেছে। ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে মিয়ানমার অনেকটাই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মুদ্রার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন রিজার্ভ সংকট দেশটির জন্য পর্যাপ্ত মাত্রায় পণ্য আমদানি প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশটিতে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। শুধু মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণেই পণ্যভেদে ২০-৫০ শতাংশ বেড়েছে খাদ্য আমদানি ব্যয়। গত এক মাসে দেশটিতে আলুর দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ইয়াঙ্গুনের ট্যাক্সিচালকরা এখন একপ্রকার কর্মহীন। সামরিক অভ্যুত্থানের আগে দেশটিতে এক লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৭০০ কিয়াত। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় হাজার কিয়াতে। যে কয়টি ট্যাক্সি চলাচল করছে, সেগুলোর মরিয়া চালকদের পক্ষে যাত্রীদের কাছ থেকেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। আয়ে চাপ পড়েছে সবারই।

কৃষি খাতের অবস্থাও টালমাটাল। সারসহ কৃষিতে অপরিহার্য সরঞ্জাম উপকরণের দাম এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার বলছে, কৃষিতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন খরচও। বাজার পরিস্থিতি অনিশ্চিত। কৃষকদের হাতে নগদ টাকা নেই। যদিও শুধু সারেরই দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশিতে। প্রয়োজনমতো সার, কীটনাশক প্রয়োগ করতে না পারায় এবার দেশটিতে চালের উৎপাদন কমারও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সব মিলিয়ে মিয়ানমারের অর্থনীতির প্রতিটি খাত-উপখাতের দুর্দশা এখন চরমে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটিতে বিনিয়োগ আটকে রাখা আর নিরাপদ মনে করছেন না বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। যদিও নিক্কেই এশিয়ান রিভিউতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিদেশীরা দ্রুত বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে চাইলেও তা তাদের জন্য খুব একটা সহজ হবে না। কারণ স্থানীয় পর্যায়েও এখন মূলধনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। ব্যাংক খাতও চাপে। অবস্থায় প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া যতটা সহজ, বাস্তবায়ন করা তার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে।

এর বড় উদাহরণ হলো নরওয়েভিত্তিক টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট টেলিনর। সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেই মিয়ানমারে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। দেশটিতে টেলিনরের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ডলারেরও বেশিতে। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি স্থানীয় পর্যায়ে নিজ মালিকানাধীন সম্পদ বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে পায়নি। এছাড়া সম্পদ বিক্রির জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পরিবহন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং মিয়ানমার ইনভেস্টমেন্ট কমিশনেরও অনুমোদন পেতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে তা বিক্রি করা সম্ভব হবে না।

যদিও এসব প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল সেখানকার ব্যবসায়িক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে। বিষয়ে সম্প্রতি দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এক জাপানি ব্যবসায়ীর বক্তব্যে বলা হয়, দ্রুত ফিরে যাওয়ার জন্য নয়, এসব কোম্পানি মিয়ানমারে ভবিষ্যতে নিজেদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পেয়েই বিনিয়োগ নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন সেই ভবিষ্যৎ আর নেই।

ওই ব্যবসায়ী নিজেও একসময় এশিয়ার লাস্ট ফ্রন্টিয়ার মার্কেট হিসেবে খ্যাত মিয়ানমারে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন। ২০১৫ সাল থেকে ব্যবসার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার মূল্যায়ন, বর্তমানে এখানে কয়েক মাস পরপর কোনো না কোনো বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিষয়টি ব্যবসা চালানোর জন্য খুবই বিপজ্জনক। ধরনের অনিশ্চিত পরিবেশে কোনো ধরনের পরিকল্পনা করাটাও বেশ কঠিন। আমরা অতীতে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করা নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু এখন এখানে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে উঠেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন