রুগ্ণ ১৩৩ শিল্প-কারখানা

৬৮৬ কোটি টাকা ঋণ মওকুফে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ বিজিএমইএ

মেসবাহুল হক

২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে মোট ২৭৯টি রুগ্ণ তৈরি পোশাক কারখানার ঋণ সুদ পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু নানা জটিলতায় তখন ১৩৩টি কারখানা সুবিধা নিতে পারেনি। পরে ঋণদাতা ব্যাংকগুলো তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করলে বেশকিছু ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ জারি হয়। এসব কারখানার উদ্যোক্তাদের অনেকেই মানসিক শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৩৩ কারখানার কাছে ব্যাংকের পাওনা ৬৮৬ কোটি টাকা মওকুফে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে তৈরি পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে -সংক্রান্ত এক চিঠিতে বলেছেন, ১৯৮৫ সাল থেকে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবিশ্বাস্য যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে ১৯৮৫ থেকে ২০০৫ সালে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ অগ্রগামী ভূমিকা পালনকারী বিজিএমইর ২৭৯টি পোশাক কারখানা রুগ্ণ বন্ধ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় ২০১০ থেকে ২০১২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ জাতীয় সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবসায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার কারণে ২৭৯টির মধ্যে ১৩৩টি রুগ্ণ শিল্পের অবসায়ন সম্ভব হয়নি।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিজিএমইএর সভাপতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩৩টি রুগ্ণ শিল্পের মোট ঋণ ৬৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা মওকুফের পক্ষে মতামত দিয়েছে। এসব কারখানার মালিকদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। রুগ্ণ শিল্পোদ্যোক্তাদের বর্তমান অবস্থা খুবই করুণ। অনেকেই কর্মহীন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটিও ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। এসব উদ্যোক্তার বেশির ভাগের বিরুদ্ধে ব্যাংকের অর্থঋণ আদালতের মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানাসহ অনেকেই মানসিক শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অবস্থায় তাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে তাদের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ অগ্রগামী ভূমিকা পালনকারীদের ৬৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা মওকুফ করার জন্য আপনার কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

চিঠির একটি করে অনুলিপি অর্থমন্ত্রী অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছেও পাঠানো হয়েছে। তবে বিষয়ে অর্থ বিভাগ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। বিষয়টি তারা পর্যালোচনা করে দেখছে।

বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি এসএম মান্নান কচি বণিক বার্তাকে বলেন, হয়তো পাঁচ হাজার পোশাক মালিক ভালো করেছেন কিন্তু কিছু উদ্যোক্তা ভালো করতে পারেননি। অন্যান্য দেশে যেসব উদ্যোক্তা সফল হতে পারেন না তারা সহজেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারেন। এজন্য আলাদা আইন রয়েছে। কিন্তু দেশে ব্যবসা থেকে এক্সিটের কোনো সুযোগ নেই। তাই সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বিষয়ে কথা বলেছি আমরা। এছাড়া বিজিএমইএর ১৩৩টি রুগ্ণ শিল্পের ৬৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা মওকুফের বিষয়টি কয়েক বছর থেকেই বলে আসছি, আবারো বলেছি। তারা বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে এসব কারখানা মালিকের বকেয়া ঋণ মওকুফ চেয়ে বিজিএমইএ তত্কালীন সভাপতি রুবানা হক গত বছর সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের কাছে আবেদন জানান। ওই আবেদনের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ডিসেম্বর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত চায়। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেহেতু গ্রাহকের আমানত দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেহেতু ধরনের ঋণ অবসায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নির্দেশনা দেয়ার এখতিয়ার নেই। তবে সরকার চাইলে রুগ্ণ শিল্পগুলোর ঋণ অবসায়নে দায় নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চিঠি পাওয়ার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে রুগ্ণ শিল্প কারখানাগুলোর ঋণের তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন ১৩৩টির মধ্যে দুটি বাদে ১৩১টি তৈরি পোশাক কারখানার ঋণের তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। তাতে দেখা যায়, কারখানাগুলোর মূল ঋণ ছিল ৫৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, আয় খাতে নিট সুদ বাবদ দায় ১৪৭ কোটি লাখ টাকা এবং মামলা খরচ কোটি ৫৭ লাখ টাকাসহ ব্যাংকগুলোর মোট দায় দাঁড়িয়েছে ৬৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মতামতে জানিয়ে দিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের ওই রুগ্ণ কারখানাগুলোর সার্বিক ঋণ অবসায়ন করতে হলে ৬৮৬ কোটি টাকার দায় সরকারকে মেটাতে হবে।

এদিকে এসব রুগ্ণ শিল্পের ঋণ মওকুফের জন্য গত বছর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছেও আবেদন করে বিজিএমইএ। পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের অক্টোবরে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিষয়টি পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেয়ার জন্য কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দুই মাসের মধ্যে সুপারিশসহ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটি দুটি বৈঠক করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কারখানাগুলো রুগ্ণ হওয়ার কারণ হিসেবে কমিটি বলেছে, এগুলো ভাড়াবাড়িতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাংকিং নিয়ম-কানুন, আন্তর্জাতিক ব্যবসার নিয়ম-কানুন অধিকাংশ উদ্যোক্তারই অজানা ছিল। এছাড়া নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, বাড়িভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল পরিশোধেও অসমর্থ হয়ে পড়ে। এজন্য রুগ্ণ বন্ধ এসব কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

কমিটির মতে, বৈশ্বিক মন্দায় ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্য সময়মতো জাহাজীকরণে ব্যর্থ হওয়ায় এসব কারখানা মালিক ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। বকেয়া বাড়িভাড়া ইউটিলিটি বিলের কারণে মেশিনারিজ নিয়ে নেয়াসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য ২০১২ সালে সরকারের দেয়া এক্সিট সুবিধা নিতে সেগুলো অসমর্থ হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কমিটি কারখানা মালিকদের দীর্ঘদিনের কষ্ট হয়রানি বিবেচনায় ১৩৩টি কারখানার ঋণ হিসাব পর্যায়ক্রমে অবসায়নের সুপারিশ করে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন