প্রবাসে
বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী কর্মী কর্মরত। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তথ্য বলছে, প্রবাসে মোট বাংলাদেশী শ্রমশক্তি সাত মিলিয়নেরও বেশি। তারা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। তারা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কয়েকটি দেশেও অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে উপস্থিত।
কভিড-১৯ মহামারীর কারণে অবশ্য গত দুই অর্থবছরে এ প্যারাডাইমের মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেছে। এটা অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাওয়া মানুষ এবং শিল্প খাতগুলোয় কাজ পেতে সমর্থ হওয়া উভয় দিক থেকে আর্থসামাজিক প্রভাব ফেলেছে।
তবে সব ধরনের বিবর্তনশীল জটিলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চমত্কার পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। রেমিট্যান্সের আন্তঃপ্রবাহ ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যা ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। বছরভিত্তিক তুলনায় রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হার ছিল ৩৬ শতাংশ।
অবশ্য সিপিডি এটিও উল্লেখ করেছে যে চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) জুলাইয়ে আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য এটি একটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে।
কিছু পর্যবেক্ষক বলেছেন, ধীরে ধীরে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এটি হতে পারে। দেশকে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী কর্মীকে ফেরার সঙ্গেও মানিয়ে চলতে হয়েছে। এই বিবর্তনশীল পরিস্থিতি আংশিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে তারা কাজ করছিল, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। আর বাকিটা গত কয়েক বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাজ করা মন্দার কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
উল্লিখিত বিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকেরই বুঝতে হবে যে রেমিট্যান্সে অব্যাহত বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থের অধিকতর ভালো, দক্ষ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কারণে। এটি আরো ইঙ্গিত দেয় যে অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের সঞ্চয় বাংলাদেশে পাঠাতে আগের হুন্ডি ব্যবস্থার চেয়ে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোকে বেছে নিচ্ছে। এখানে একটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে বাংলাদেশ ব্যাংক সূচিত চমত্কার ব্যাংকিং ব্যবস্থা আমাদের কর্মীদের আগের অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল থেকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
এ প্রক্রিয়া আরো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এ কারণে যে সুবিধাভোগীর কাছে অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের ডেলিভারি চ্যানেল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সহায়ক পদক্ষেপ এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে উন্নয়ন ঘটেছে। বেশি রেমিট্যান্স আন্তঃপ্রবাহের আরেকটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে ডলার ও টাকার স্থিতিশীল বিনিময় হার।
এ দিকটিতে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করেছে, ‘ধারাবাহিক
উদ্যোগের অংশ হিসেবে আমরা স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে এক্সচেঞ্জ হাউজ প্রতিষ্ঠার এবং অভ্যন্তরমুখী রেমিট্যান্স আনতে সহায়তার জন্য বিদেশে ড্রইং অ্যারেঞ্জমেন্টের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ।’
চলমান জটিলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদরা এখন আশা করছেন সামনের মাসগুলোয় রেমিট্যান্সের আন্তঃপ্রবাহ আরো বাড়বে, যখন ব্যক্তি খাতের উদ্যোগে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি পুনরায় শুরু হবে এবং সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমিক নিয়োগ আবার চালু হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা দেশটিতে কাজের সন্ধানে যাওয়া প্রবাসী কর্মীদের আকামা (কাজের অনুমতি), টিকাদানের
শর্তপূরণ করে সেখানে প্রবেশ এবং আনুষঙ্গিক কোয়ারেন্টিন পদক্ষেপের ব্যাপারে বাংলাদেশকে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনে সমর্থ করে তুলেছে।
বর্তমানে এ খাতের মধ্যে আমারা নানা জটিলতার মুখোমুখি। তবে এর মানে এই নয় যে চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে না। বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এসব অ্যাপ্রোচের ফলে একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়ে বাংলাদেশ ৪৮ বিলিয়নের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিতি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা বিশ্বে রেমিট্যান্সগ্রহীতার শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় উন্নীত হয়েছি।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বাইরে নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের চেষ্টা করে আসছে। এ প্যারাডাইমের মধ্যে, বিশেষ করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে স্কিল ফ্যাক্টর বাড়াতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এটি কেবলই সম্ভব হবে যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানোন্নয়নের পাশাপাশি সম্পর্কিত দক্ষতাগুলো উন্নয়ন সঠিক পদক্ষেপ নিই। স্কুলে মাধ্যমিক স্তর থেকে দক্ষতা উন্নয়ন উদ্যোগ এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করতে হবে।
জাপান এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে এসেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে উন্নয়নের দক্ষতাগুলো বাংলাদেশীদের মধ্যে উদ্যোক্তার সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলবে। অনেক বাংলাদেশী কারিগরি ইন্টার্নরা শিক্ষানবিশী কর্মসূচির মাধ্যমে জাপানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারা তা-ই করছেন প্রশিক্ষণকালে একটা আর্থিক বৃত্তির অধীনে। এটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে ওই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সফলভাবে শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করার জন্য তাদের আর্থিক সহায়তা ও প্রয়োজনীয় সম্পদ দেয়া হবে। ভুললে চলবে না, এসব সহযোগিতার প্রভাব হবে বহুমুখী।
বৈধ চ্যানেলগুলো স্ট্রিমলাইন করা হচ্ছে। সমরূপভাবে সম্পন্ন করার মাত্রা ও বৈচিত্র্যের পরিধি যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু অভিবাসী কর্মীদের বিদেশী শেখার ব্যাপারেও জোর দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইন উভয় দেশই এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ অধিক দক্ষ নারী কর্মী তৈরিরও চেষ্টা করছে।
সম্ভাব্য কোন কোন দেশে বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো যেতে পারে, সেটি চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোও ব্যবহার করছে। এসব বাজার গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ, বিশেষ করে পোল্যান্ড, আলবেনিয়া ও রোমানিয়া। এশিয়ার মধ্যে নজর দেয়া হয়েছে উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার দিকে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোও (বিএমইটি) ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড আধুনিকায়ন করতে প্রয়োজনীয় তদারকি বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে তারা প্রবাসী শ্রমিকদের একটি ডাটাবেজ তৈরি এবং সেটি হালনাগাদ রাখারও চেষ্টা করছে। আশা করা হচ্ছে যে এই মিথস্ক্রিয়ামূলক ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া কেবল আমাদের প্রবাসী কর্মীদের কর্মকাণ্ডের তদারকিই বাড়াবে না, কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের সহযোগিতাও করবে।
তার পরও মুদ্রার উল্টো পিঠের ভয়ংকর দিকগুলোও উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা গত দুই বছরে মানব পাচার সম্পর্কিত বিষয়গুলোর মাধ্যমে সামনে এসেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় প্রতারক দালালদের হাত ধরে হাজারো দারিদ্র্যতাড়িত মানুষ কীভাবে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী হিসেবে প্রবেশের চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরসংলগ্ন উপকূলীয় জঙ্গলের বর্বর
ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার করা এবং তাদের স্বপ্নভঙ্গের দৃশ্য টেলিভিশনে দেখাটা সত্যিই হূদয়বিদারক।
আপাতভাবে মনে হয়, এসব মানব পাচারের অপকর্মের মাত্রা গত চার বছরে বেড়েছে, যখন পাচারকারীরা কেবল মুসলিম রোহিঙ্গা ও পরিবারকে মিয়ানমারে বসবাসের একটি নির্মম বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে নয়, উপরন্তু অবৈধভাবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় প্রবেশে চেষ্টারত বাংলাদেশীদেরও টার্গেট করেছে।
তাদের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে যেমনটা এসেছে, মালয়েশিয়ার সরকার ওই দেশে অবৈধ বিদেশী কর্মীদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ অভিযান চালানোর চেষ্টা করছে। পরবর্তী সময়ে বলা হয়েছে, এ পদক্ষেপ বাংলাদেশ থেকে নিম্ন দক্ষ কর্মী নিয়োগের দিকে চালিত হবে। এটা হবে বিজনেস টু বিজনেস (বি-টু-বি) ম্যাকানিজম কাঠামোর মধ্যে, যা বেসরকারি রিক্রুটমেন্ট/এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় অবৈধ মানব পাচার কমাতে পারে।
সার্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের ভালোটাই আশা করতে হবে এবং বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে কানাডা একটি ভালো অপশন হতে পারে। যেখানে শ্রমনিবিড়, নার্সিং, প্রৌঢ়দের সেবা, রিটেইল ওয়ার্ক এবং নির্মাণ প্রকল্পের মতো সেবাধর্মী কাজের বিপুল চাহিদা রয়েছে। সত্য যে সেখানে যেতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে উচ্চতর দক্ষতা লাগবে, তবে বাংলাদেশ সরকার কানাডীয় কর্মপরিসরের সঙ্গে উপযোগী সফট স্কিল উন্নয়নে কর্মীদের প্রশিক্ষিত করতে বিশেষ কর্মসূচি বিবেচনা করতে পারে। এ ধরনের চাহিদাভিত্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি কার্যক্রমে উভয় দেশই উপকৃত হবে। এটি আমাদের রেমিট্যান্স ফ্যাক্টরেও সাহায্য করবে।
এগিয়ে যেতে আমাদের নিজেদের ওপরই নিজেদের বিশ্বাস করতে হবে। বাংলাদেশের অভিবাসন সম্ভাবনা সম্পর্কেও এটি প্রযোজ্য। এটি যথেষ্ট বিকশিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সময়ান্তরে আমরা বিশেষ করে বাইরের নির্মাণ, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা এবং সেবা খাতে একটা বিশেষ জায়গা দখল করতে সমর্থ হব। যথাযথ বৃত্তিমূলক ও ডিজিটাল প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা বৈদ্যুতিক মেরামত, প্যারা মেডিকেল সহায়তা, পানি, গ্যাস, স্যানিটেশন লাইন সংস্কার এবং হিসাববিদ্যায় আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান খুঁজতে সমর্থ হব। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা ও আগল ভাঙতে সাহায্য করবে।
মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত; আন্তর্জাতিক বিষয়াদি, তথ্য অধিকার ও সুশাসনসংক্রান্ত বিষয়ের বিশ্লেষক