অভিমত

অবকাঠামোর আলোকচ্ছটা ও মাথাপিছু আয় কি উন্নয়নের মানদণ্ড?

আবু তাহের খান

ছবি : বণিক বার্তা

ঢাকায় গত ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের প্রথম দিনের মূল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) চিত্রে রাতের আকাশের আলো পরিমাপ করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উন্নয়নের স্তর বা পরিমাণ নির্ধারণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়নের এ যুগে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে উন্নয়নের পরিমাপ নিরূপণের এ ধারণাকে চট করে বেশ আগ্রহোদ্দীপক ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে, উপগ্রহ থেকে গৃহীত ছবিতে চিহ্নিত আলোকোজ্জ্বল স্থানগুলোকে উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি হিসেবে গণ্য করাটা শুধু ভুলই নয়, গবেষণার ফলাফলকে গভীরতর নৈকট্য ও মাঠভিত্তিক বাস্তবতা দিয়ে উপস্থাপনের ধারণার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক, যে বিষয়টি ওই সম্মেলনেই চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (সমকাল, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। 

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার আলোচনায় সুস্পষ্ট উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, উপগ্রহ থেকে মধ্যরাতে তোলা আলোঘন বা উজ্জ্বল আলোর ছবি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন উন্নয়নের পরিবর্তে বরং অনুন্নয়নকেই নির্দেশ করে। প্রচণ্ড যানজটের কারণে মাঝরাতেও ঢাকার রাস্তা যখন আলোক বিচ্ছুরণকারী অসংখ্য মোটরযানের আলোয় ঝলমল করে, তখন উপগ্রহ থেকে সে আলোকোজ্জ্বল ছবি তুলে সেটিকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করলে সেটি যে বাংলাদেশের অপরিকল্পিত পরিবহন অবকাঠামো, অদক্ষ সড়ক ব্যবস্থাপনা ও নাজুক ট্রাফিক কার্যক্রমের ফলশ্রুতি, সে বাস্তব ঘটনাটি ঢাকা পড়ে যায়। তাছাড়া এটি এ-সংক্রান্ত প্রকৃত পরিস্থিতির পরিবর্তে এমন এক বিপরীত ও অসত্য চিত্র তুলে ধরছে, যা দেশ ও বিদেশের মানুষকে শুধু বিভ্রান্তই করছে না, সত্যানুসন্ধানী সচেতন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশাও তৈরি করছে। অধিকন্তু এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে ভুল গতিপথ নির্দেশের পাশাপাশি এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে গুণগত মান রক্ষার চেয়ে চটকদারিত্বের প্রতি অধিক পরিমাণে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

বিদ্যুৎ প্লান্ট, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য স্থাপনার আলোয় রাতের সুন্দরবন আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠাকে হতাশাজনক হিসেবে উল্লেখ করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিবেচনা থেকে অধ্যাপক মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, রাতের সুন্দরবনে আমরা আলো দেখতে চাই না। অর্থাৎ সেখানে আলোহীন অন্ধকারময় রাতের পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখতে পারাটাই টেকসই উন্নয়নের মূল রক্ষাকবচ। সুন্দরবনকে আসলে বাঁচাতে হবে দিনের আলোয়, যাতে সেখানকার প্রাণিকুল নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন নৈশনিদ্রা ও বিশ্রামের সুযোগ পায়। কিন্তু দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা কি আদৌ সে পথে এগোচ্ছে? মোটেও নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই দেশজুড়ে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণের যথেচ্ছ উৎসব। আর যথেচ্ছ কায়দায় উদ্দেশ্যবিহীনভাবে নেয়া এসব উৎসবমুখর মেগা-অমেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঘোষিত উদ্দেশ্য তো হাসিল হচ্ছেই না, উল্টো এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের অবহনযোগ্য বোঝা। এ অবস্থায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কিংবা এগুলোর বাস্তবায়ন-উত্তর সময়ে এসবকে ঘিরে আলোর যে ফোয়ারা তৈরি হচ্ছে, সেটিকে উন্নয়নের সমার্থক হিসেবে গণ্য করা মোটেই সমীচীন হবে না। 

অধ্যাপক মাহমুদ তার আলোচনায় ফসল-মাঠের উন্নয়ন বোঝার জন্য সেখানকার দিবাকালীন উপগ্রহের ছবি ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের ওপরও সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন যে, এটি করা না হলে ফসলের খেত, জলাভূমি বা পরিবেশের বর্তমান অবস্থা ও প্রবণতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়, বাংলাদেশের কৃষিজমিতে যথেচ্ছ পরিমাণে ইউরিয়া সার, বিষাক্ত কীটনাশক ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে এর মাটির গুণগত মান ব্যাপক পরিসরে ও দ্রুত গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। এছাড়া শিল্পবর্জ্য ও অন্যান্য দূষণযুক্ত পদার্থ অনবরত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কৃষিজমিতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণেও জমির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া খরা, ভূমণ্ডলের সার্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ভূ-উপরিস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ নানা কারণেও কৃষিজমির গুণগত মান ব্যাপক নিম্নগামী হয়ে পড়ছে এবং এ প্রবণতা দিন দিনই বাড়ছে। কিন্তু জমি, বায়ু, জলাশয় ও পরিবেশের এ ক্ষতিমুখী প্রবণতা বন্ধে শুধু স্যাটেলাইট থেকে গৃহীত ছবি ও এ-সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করলেই হবে না, চোখে দেখে বাস্তব অবস্থা নিরূপণ বা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

সানেমের সেমিনারে কানাডীয় অর্থনীতিবিদ জন লাও-ইচ আরকান্ড উপগ্রহ থেকে রাতের কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট আলোর ছবি নিয়ে উন্নয়নের পর্যায় চিহ্নিতকরণ বিষয়ে যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, ওই আলোচনার সূত্র ধরে এখানে বলতেই হয় উপগ্রহ থেকে এভাবে চিহ্নিত আলোর পরিমাপ করে তা দিয়ে কিছুতেই উন্নয়নের প্রকৃত স্তর নির্ধারণ সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন উন্নয়নের সংজ্ঞা, পরিমাপক বা মানদণ্ড নিয়ে যুগে যুগে নানা বিতর্ক হয়েছে। একসময় মনে করা হতো, যার সার্বিক সম্পদের পরিমাণ যত বেশি, সে দেশ তত বেশি উন্নত। কিন্তু সে ধারণা খুব বেশি দিন টেকেনি এবং সহসাই তার স্থলাভিষিক্ত হয় রাষ্ট্রের নাগরিকদের গড় মাথাপিছু আয়ের ধারণা। কিন্তু একুশ শতকের গোড়ায় এসে সে ধারণাও অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই তার গ্রহণযোগ্যতা হারায় এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে এক্ষেত্রে প্রবর্তিত হয় বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই), যার উদ্‌গাতা হচ্ছেন পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক। বস্তুত এর ভিত্তিতেই এখন বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন পরিমাপের কাজটি চলছে, যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিকরা তাদের উন্নয়নের জৌলুস বোঝানোর জন্য এখনো দেড় দশক আগে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া মাথাপিছু আয়ের পুরনো কাসুন্দিই ঘাঁটছেন।

এদিকে উন্নয়নের সংজ্ঞা পরিবর্তন ও সমন্বয়ের নতুন দাবিও উঠতে শুরু করেছে, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও উন্নয়ন পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ উন্নয়নের সংজ্ঞা ও মানদণ্ড হিসেবে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনঘনিষ্ঠতার দাবিটি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে উপগ্রহ থেকে রাতের আলোর ছবি তুলে উন্নয়ন পরিমাপের বিষয়টি যতই প্রযুক্তিনির্ভর হোক না কেন, জনগণের প্রকৃত স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাবিহীন বিধায় সে আলো কোনো অবস্থাতেই উন্নয়নের সমার্থক হতে পারে না। তার চেয়ে বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, দার্শনিক আকাঙ্ক্ষা, জীবনঘনিষ্ঠ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্তর ইত্যাদি কোন পর্যায়ে আছে, সেটিই হবে উন্নয়নের প্রকৃত নির্দেশক। আর প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সেসব নিশ্চিতকরণে কোন রাষ্ট্র কতটা ভূমিকা রাখছে, তার ওপরই নির্ভর করছে সে রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রচেষ্টার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যাবলি।

সব মিলিয়ে উল্লিখিত আলোচনার সারাৎসার তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, আলোর বিস্তার ও ঘনত্ব কখনো কখনো উন্নয়নের ইঙ্গিত প্রদান করলেও সেটাই উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি নয়—একমাত্র মাপকাঠি তো নয়ই, বরং কখনো কখনো কোনো কোনো আলো অনুন্নয়ন ও অদক্ষতারই প্রতিফলন, যে ধরনের আলো মধ্যরাতের যানজটে ঢাকার রাজপথে আটকে পড়া মোটরযান থেকে বিচ্ছুরিত হতে দেখা যায়, যা আমাদের কাম্য নয় কিছুতেই। একইভাবে রাতের সুন্দরবন যখন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তখন সেটি উন্নয়নের নামে ধ্বংসযজ্ঞের খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব মানতেই হবে স্যাটেলাইট থেকে দেখা ভূপৃষ্ঠের সব আলো যেমন উন্নয়নের প্রতীক নয়, তেমনি সব অন্ধকারও অনুন্নয়ন নয়। কিছু কিছু অর্থপূর্ণ অন্ধকার এ ধরিত্রী ও তার প্রাণিকুলের স্বার্থেই প্রচণ্ডভাবে কাম্য, যে ধরনের অন্ধকার আমরা চাই সুন্দরবনে, ভাওয়াল ও মধুপুরের গড়ে কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিবিড় বনাঞ্চলে। মোটকথা, একচ্ছত্র আলো বা একচ্ছত্র অন্ধকার নয়, চাই আলো ও অন্ধকারের এমন এক সুষম মিশ্রণ যা মানুষের জীবনকে শুধু বৈষয়িক সমৃদ্ধিই দেবে না, চিন্তা ও মননের নিগুঢ়তায়ও ভরিয়ে রাখবে।

আবু তাহের খান: গবেষক ও প্রাবন্ধিক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন