চীন : পরাশক্তির বিবর্তন

বিপ্লবী ক্ষমতার শুরু

আনু মুহাম্মদ

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিচ্ছেন মাও সে তুং

পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইরান, ভারত, ইনকা, মায়ার মতো প্রাচীন চীনের সভ্যতা। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর এক নতুন চীনের যাত্রা হয়। নানা রকম সংস্কার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম এক পরাশক্তি। জিডিপির হিসাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়া চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে চীনের শক্তি-দুর্বলতা, সাফল্য-ব্যর্থতা ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেও কমিউনিস্ট পার্টির বিস্তৃতি থামেনি। ১৯৪৩ সালে চৌ এন লাই পার্টির সদস্য সংখ্যা জানান আট লাখ। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সদস্য সংখ্যা জানানো হয় ১২ লাখ। এর বাইরে বিভিন্ন গণ শ্রেণী সংগঠনে, মুক্তিফৌজে সদস্য সংখ্যা ছিল কয়েক গুণ। কংগ্রেসে লিউ শাউ চির বক্তব্য তখন খুবই আলোচিত হয় যে, মাও সে তুং মার্ক্সবাদের চীনা অথবা এশীয় ধরন সৃষ্টি করেছেন। নয়া গণতন্ত্রের ধারণা ততদিনে অনেক প্রচারিত জনপ্রিয়। মুক্ত অঞ্চল তখন চীনের প্রায় ১০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।

পরের বছর লিউ শাও চি আনা লুই স্ট্রংয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, মাও সে তুংয়ের বড় অবদান হলো মার্ক্সবাদকে ইউরোপীয় থেকে এশীয় পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করা।... চীন হলো আধা সামন্তবাদী আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ এক টুকরো জমি নিয়ে প্রায় অনাহারে থাকে। অধিকতর শিল্পায়িত অর্থনীতি হিসেবে এর রূপান্তরের পথে চীন অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চাপের মধ্যে পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও একই রকম পরিস্থিতি। চীন যে পথে যাচ্ছে, তা তাদের সবাইকে প্রভাবিত করবে।

১৯৪৫ সালে সোভিয়েত লালফৌজ জাপানের দখল থেকে চীনের মাঞ্চুরিয়া মুক্ত করে। অঞ্চলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত-ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষের কাছে জার্মানি-জাপান অক্ষের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত হয় বছরেই। এরপর কুওমিনটাংয়ের সমর্থনে সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মাঞ্চুরিয়া কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা চিয়াং বাহিনীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৪৮ সালের শেষদিকে একটি নির্ধারক যুদ্ধে মুখোমুখি হয় দুই বাহিনী। চিয়াং বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তখন ছিল ৪৩ লাখ, যার মধ্যে ২২ লাখ ছিল উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর বিপরীতে চীনা গণমুক্তিফৌজের নিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। এর বাইরে যুদ্ধে আরো অংশ নেন আধা সামরিক প্রায় ২৭ লাখ।

নির্ধারক যুদ্ধে চিয়াং বাহিনীর পরাজয় ঘটে, যা নতুন পর্বে চীনের প্রবেশ আরো ত্বরান্বিত করে। বিজয়ের পর পার্টি মুক্ত অঞ্চলে বিপ্লবী ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি গ্রহণ করে। জেনারেল লিন পিয়াওয়ের নেতৃত্বে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য চীনা গণমুক্তি ফৌজ জনযুদ্ধের কৌশলের বাইরে গিয়ে প্রথাগত যুদ্ধের মাধ্যমেও মোকাবেলা করে শত্রুপক্ষকে।

১৯৪৯ সালের প্রথম দিকেই চিয়াং কাই শেকের সামগ্রিক পরাজয় নিশ্চিত হয়ে পড়ে। দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, নিপীড়ন রাজনৈতিকভাবে  শাসকগোষ্ঠীকে ক্রমান্বয়ে জনগণ এমনকি তার একসময়ের সমর্থক মধ্যবিত্ত থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। সামরিক পরাজয়ের মাধ্যমে এদের তাই চীন থেকে সামগ্রিক উচ্ছেদ ঘটে। জানুয়ারিতে চিয়াং কাই শেক আপসরফার প্রস্তাব দিয়ে পদত্যাগ করেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে। যদিও ক্ষমতা তার হাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির কারো কারো মধ্যে এমনকি সোভিয়েত নেতাদের মধ্যেও  রকম একটি মত শক্তি পেতে থাকে যে  মুহূর্তে চীন বিভক্ত করে (উত্তর  দক্ষিণ) ক্ষমতা নেয়ায় সম্মতি দেয়া দরকার। কেননা আরো অগ্রসর হলে যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী হামলা চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও আসলে এটাই চাচ্ছিল। চিয়াংয়ের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের কাছাকাছি প্রস্তাবমালা পাঠান মাও সে তুং। তা মেনে না নেয়ায় এপ্রিলের ২১ তারিখ সামগ্রিক অভিযান শুরু হয়। চিয়াং সরকারের রাজধানী নানকিংয়ের পতন ঘটে তার দুদিনের মধ্যে। অন্যান্য অঞ্চলেও আত্মসমর্পণ শুরু হয়। নভেম্বরের মধ্যে পুরো দেশ উল্লেখযোগ্য কোনো বাধা ছাড়াই পার্টি এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সংগঠনের কর্তৃত্বে চলে আসে।

এর আগে একই বছরের জুনে পার্টি আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে, চীনের নতুন শাসনব্যবস্থা শুরুর কাজে সমর্থক, সহযোগী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সংগঠন  বিভিন্ন ব্যক্তিকে যুক্ত করার চেষ্টা করে। ১৯৪৬ সাল থেকেই যাদের সঙ্গে পার্টি সম্মিলিত কাজের প্রক্রিয়া তৈরি করেছিল, তাদেরসহ অন্যদের নিয়ে ‘নয়া রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনেরডাক দেয়া হয়। এর প্রস্তুতি কমিটির সভায় মাও সে তুং বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা এবং তার প্রতিনিধিত্বের জন্য একটি গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকার গঠনের জন্য  সম্মেলন প্রয়োজন। তিনি তখন  বিষযটিও পরিষ্কার করেন যে, ‘এর মধ্য দিয়ে আধা-উপনিবেশ আধা-সামন্তবাদী অবস্থায় আটকে থাকার নিয়তি থেকে আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত হবে এবং গ্রহণ করবে স্বাধীনতা, মুক্তি, শান্তি, ঐক্য, সমৃদ্ধি  ক্ষমতার পথ।মাওয়ের ‘জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বধারণাটি ততদিনে অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণের বিপ্লবী সুফলকে ধরে রাখার এবং দেশী  বিদেশীদের ক্ষমতায় ফিরে আসার সব চক্রান্ত মোকাবেলার প্রধান হাতিয়ার।

১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর চীনা জনগণের ‘নয়া রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনেরঅধিবেশন শুরু হয়। এতে অংশ নেন ১৪টি রাজনৈতিক দল ছাড়াও বিভিন্ন গ্রুপ, সংগঠন এবং দীর্ঘ বিপ্লবী সংগ্রামের সহযোগী ব্যক্তিরা। এর মধ্যে অনেকেই কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের অংশীদার ছিলেন। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ দিন ধরে পরিচালিত বিভিন্ন অধিবেশনে পরবর্তী সরকার  আশু কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়। মাও সে তুং নতুন সরকারের প্রধান নির্বাচিত হন, উপপ্রধান হন মিসেস সান ইয়াৎ সেন ছাড়াও অন্য কয়েকটি দলের প্রতিনিধি। 

১৯৪৯ সালের  অক্টোবর তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে মাও সে তুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। 

সন্ত্রাসী ঘাঁটি: তাইওয়ান  যুক্তরাষ্ট্র

চীনে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যদিকে  সরকারকে স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ভারতসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র। বিপ্লবের পরই প্রথম বিদেশ সফরে যান মাও সে তুং, আর তা সোভিয়েত ইউনিয়নে। সে সময়ই স্বাক্ষরিত হয় চীন-সোভিয়েত চুক্তি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ততদিনে বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভরকেন্দ্র বদলে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ বিধ্বস্ত। ব্রিটেনের পক্ষে আর নেতৃত্বদানের অবস্থা ছিল না। ওদিকে প্রবল শক্তি নিয়ে বিশ্ব দরবারে হাজির সোভিয়েত ইউনিয়ন।  পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের উত্থানের কারণে, বিশ্বজুড়ে হুমকির মুখে পতিত পুঁজিবাদী শক্তিকে সমর্থন দেয়ার অর্থনৈতিক  সামরিক সামর্থ্য থাকার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হয়ে উঠল পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন কেন্দ্র, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নতুন নেতা। 

চীন বিপ্লবের পর তাই  অঞ্চলে তাইওয়ান  কোরিয়া হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য সৃষ্টির প্রধান অবলম্বন। এর আগে কুওমিনটাংয়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা কোনো কাজে দেয়নি। চিয়াং কাই শেক, তার নেতৃত্বাধীন কুওমিনটাং বাহিনী  তার সমর্থক ধনিক গোষ্ঠী মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় তারা ঘাঁটি গাড়ে ফরমোজা দ্বীপে, যা পরে তাইওয়ান নামে পরিচিতি পায়।  দ্বীপ চীনের অংশ ছিল বহুকাল আগে থেকে, সপ্তদশ শতকে কিং সম্রাটের সময় এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চীনা সাম্র্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উনিশ শতকের শেষে জাপান এটি দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর আবার তা চীনের কর্তৃত্বে ফেরত আসে। জাপানি উপনিবেশকালে ব্যাপক নির্যাতন  হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় সেখানে বসবাসরত চীনা মানুষেরা। তবে  উপনিবেশকালেই  দ্বীপে শিল্পায়ন, রেলপথ  অন্যান্য পরিবহনের বিস্তার, সুসংগঠিত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবকাঠামো গড়ে ওঠে। 

প্রথমদিকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও এবং বিরক্তি দেখালেও যুক্তরাষ্ট্র তার আঞ্চলিক কৌশলের অংশ হিসেবেই চিয়াং  তার সহযোগীদের পুনর্বাসনে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে। বিপ্লবী সরকারও তাদের আর তাড়া করেনি, কিন্তু বরাবর তারা  দ্বীপকে চীনের অংশ বলে দাবি করে এসেছে। তাইওয়ান নামে পরিচিত হলেও সরকারিভাবে এর নাম ‘রিপাবলিক অব চায়না তাইওয়ানে আগে থেকেই জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ লাখ। তার সঙ্গে যোগ হলো চিয়াং কাই শেকের সঙ্গে যাওয়া ২০ লাখ। এর প্রধান অংশ ছিল সেনাবাহিনীর লোকজন। এছাড়া ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদরাও ছিল। আগত লোকজনের সঙ্গে এরপর স্থানীয় মানুষজনের সংঘাত তৈরি হয়েছে প্রায়ই। চিয়াং সেখানে সামরিক শাসনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। তাদের জন্য মার্কিন সামরিক  আর্থিক সহায়তা ছিল অঢেল। মার্কিন পরিকল্পনা ছিল একদিকে সামরিক শক্তি হিসেবে এটিকে গড়ে তোলা, একে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা এবং তাইওয়ানে প্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজ নিশ্চিত করে পাল্টা একটি মডেল দাঁড় করানো। সে অনুযায়ী, তাইওয়ানে শিল্পায়নের ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়। চীনবিরোধী আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক তত্পরতায় যুক্তরাষ্ট্র অনেকখানি ভর করে  দ্বীপরাষ্ট্রের ওপরই। 

তাইওয়ানে ১৯৪৯ সালে প্রবর্তিত সামরিক শাসন অব্যাহত থাকে দীর্ঘকাল, ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। চিয়াংয়ের পর তার পুত্র দেশের প্রধান হন। নিজেদের শাসন ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৯ থেকে কয়েক বছরে পুরো দ্বীপে ব্যাপক নির্যাতন, নিপীড়ন  হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়। কমিউনিস্টপন্থী বা কুওমিনটাংবিরোধী কাউকে মনে হলেই তার বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হতো।  অপরাধে এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে প্রায় দেড় লাখ মানুষকে খুন অথবা কারাবাসের শিকার হতে হয়।  পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য, এসব নির্যাতিত পরিবারের প্রতি  ‘শ্বেতসন্ত্রাসকালে যে অন্যায় করা হয়েছে, তার জন্য প্রায় ৬০ বছর পর, মাত্র গত ২০০৮ সালে, তাইওয়ান সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে। 

চীনে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সালে কোরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর  দক্ষিণ কোরিয়া যুদ্ধের আড়ালে এটি পরিণত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন-সোভিয়েত যুদ্ধে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান চীনকে মোকাবেলার জন্য সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেন তাইওয়ান প্রণালিতে। অবশ্য তাইওয়ানকে ভর করে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার মিত্র দেশের অনেকেই একমত ছিল না। 

মার্কিনি  যুদ্ধবাজ ভূমিকা বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সে সময়টি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও শ্বেত সন্ত্রাস, যা ম্যাককার্থিজমের কাল। বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা, মিডিয়া, সাহিত্য, সংগীত, গবেষণা এমনকি হলিউডে চলচ্চিত্র জগতে তখন ‘বামবা ‘কমিউনিস্টবিরোধী চিরুনি অভিযান চলছিল। শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন, জেলে ঢুকেছেন, উধাও হয়ে গেছেন, অপদস্থ হয়েছেন, কুৎসা, অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন। এগুলো করা হয়েছে খুবই গোছানো সুসংগঠিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সিআইএ এফবিআই তখন  কাজে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী। 

চীন নিয়ে লেখালেখি  গবেষণার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তিও এর শিকার হন।  রকম একজনের নাম উইলিয়াম হিনটন। যাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফানশেন চীনের বিপ্লবী রূপান্তর বোঝার জন্য অবশ্যপাঠ্য। [চলবে]

 

আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন