রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি

স্কুল বন্ধ থাকায় কাজ নিয়েছিল অনেক শিশু

আল ফাতাহ মামুন

শিল্প খাতে শিশুশ্রমের অন্ধকার দিকটিকে আবারো সামনে এনেছে হাসেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ড ছবি: মো. মানিক

দেশের শিল্প খাতে শিশুশ্রমের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ওই ঘটনায় মৃতদের মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। তবে আহতদের মধ্যে বড় একটি অংশের বয়স ১৪-এর নিচে। করোনায় স্কুল-মাদ্রাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তাদের অনেকেই কারখানায় কাজ নিয়েছিল।

গত রোজার ঈদের পর বোনের কাছে বেড়াতে এসেছিল বরিশালের কিশোরী নাদিয়া (১২) বর্তমানে রূপগঞ্জের ইউএস বাংলা হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে তার। ঘরে অভাব নেই। উপার্জনের তাগিদও ছিল না তার। বরিশালের স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নাদিয়া অনেকটা শখের বশেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় যোগ দেয়। নাদিয়ার ভাষ্যমতে, এক মাস হলো কাজে যোগ দিয়েছি। যখন আগুন লেগেছে তখন জুসের বোতল ঠিক করছিলাম। হঠাৎ গোলমাল শুরু হয়। দিশেহারা হয়ে জানালা দিয়ে লাফ দিই। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। পা মেরুদণ্ডের হাড়ে আঘাত পেয়েছি।

রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল বিকাল পর্যন্ত হাসেম ফুড কারখানার অগ্নিকাণ্ডে আহত সাতজন চিকিৎসাধীন ছিল। তাদের মধ্যে ছয়জনের বয়স ১৪-এর কম বা কাছাকাছি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, অগ্নি দুর্ঘটনার পরপর মোট ২১ জন ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে তিনজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে গিয়েছে। বাকিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। ইউএস-বাংলা হাসপাতালের রেকর্ড থেকে জানা যায়, মোট ভর্তি হওয়া ২১ জনের ১৮ জনই শিশু শ্রমিক।

রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানার দুই-আড়াই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাতাসে পোড়া মরদেহের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সরেজমিন দেখা গিয়েছে, গতকাল বিকালেও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভবনের ধ্বংসস্তূপের ওপর অনবরত পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিলেন। সোনারগাঁ ফায়ার সার্ভিস ইউনিটের কর্মী আবু বকর সিদ্দিক বলেন, রকম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কমই দেখেছি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরও আমরা ধ্বংসস্তূপে পানি ছেটানো অব্যাহত রেখেছি, যাতে আর কোনো দাহ্য পদার্থ থাকলে তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

ভবনের ফ্লোরগুলোয় ঘুরে দেখা গিয়েছে, ফাইল, জুস, জুসের বোতল, উৎপাদনের বিভিন্ন সরঞ্জাম পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। ভবনটিতে সিঁড়ি একটিই। জরুরি অবস্থায় বের হওয়ার জন্য কোনো সিঁড়ি ওই কারখানায় ছিল না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কারখানাটিতে মোট তিন হাজার শ্রমিক কাজ করত। এর মধ্যে বেশির ভাগই ১২-১৪ বছরের কিশোর-কিশোরী।

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চলতি বছরের শুরুতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু জুসের কারখানাটিতে যোগ দেয়। প্রসঙ্গে নাসের হোসেন নামে কিশোর শ্রমিক বলে, অগ্নি দুর্ঘটনার সময় আমার ডিউটি চলছিল। চারতলায় ডিউটি থাকলেও ওই সময় আমি নিচতলায় মূল গেটে ছিলাম। আগুনের খবর শুনে তড়িঘড়ি বাইরে বেরিয়ে আসি।

তিনি বলেন, আমার সঙ্গে কাজ করত ইয়াসিন। সে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল। তিন-চার মাস হলো আমরা দুজনে কাজে যোগ দিয়েছি। অগ্নি দুর্ঘটনায় ইয়াসিন মারা গিয়েছে বলে আশঙ্কা করছি। তার মরদেহ এখনো নিখোঁজ। আমরা যারা কাজে যোগ দিয়েছি, তারা হয় টাকার জন্য, নয়তো অবসর সময় কাজে লাগানোর জন্য জুসের কারখানায় যোগ দিয়েছি।

অগ্নি দুর্ঘটনায় আহত মানিকের পিতা ওই কারখানার নিরাপত্তাকর্মী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমার ছেলে নয় মাস হলো কাজে যোগ দিয়েছে। লকডাউনে বিদ্যালয় বন্ধ। সময় খারাপ সঙ্গ, মাদক কিশোর গ্যাং আতঙ্ক বেড়ে যাওয়ায় তাকে কারখানায় এনে কাজে দিই।

অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা আরেক কর্মী আশরাফুল ইসলাম (২৬) জানান, চার মাস হলো আমি এখানে যোগ দিয়েছি। আমি আসার পরেও দেখেছি, অনেক শিশু শ্রমিক যোগ দিয়েছে। আমার দেখা আশি শতাংশ শ্রমিকেরই বয়স আঠারো বছরের নিচে।

অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, কম বয়সী শিশুদের বয়স বেশি দেখিয়ে কাজে নিয়োগ দিত হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। কারখানায় কাজ করা একাধিক শিশু বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, নিয়োগের সময় তাদের বয়স বাড়িয়ে লিখতে বাধ্য করা হতো। ইউএস-বাংলা হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি সাতজনের মধ্যে ছয়জনই কিশোরী। হাসপাতালের রেকর্ডেই তাদের বয়স ১৪ ১৫ বছর করে লেখা ছিল। কিন্তু তারা সবাই বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই বয়স ১২-১৪ বছরের মধ্যে। কারখানাটিতে প্রত্যেক শিশু মাসে হাজার ৭০০ টাকা বেতনে ঘণ্টা করে কাজ করত। অতিরিক্ত আরো চার ঘণ্টা কাজ করলে মাস শেষে বাড়তি টাকা পাওয়া যেত মাত্র ৩০০ করে।

ব্যাপারে কথা বলার জন্য হাসেম ফুডের ব্যবস্থাপক মো. হান্নান রানাকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। তবে কারখানার তিনতলার একজন কর্মকর্তা (উৎপাদন) বণিক বার্তাকে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, করোনার দেড় বছরে আমাদের কারখানায় শিশু শ্রমিক বেড়েছে। আগে নারী শ্রমিক বেশি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে শিশু শ্রমিক বিশেষ করে কিশোরীরা কারখানায় যোগ দিয়েছে বেশি।

এর আগে গত জুন শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কারখানাটি পরিদর্শন শেষে বেশকিছু অনিয়ম-ত্রুটি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কারখানাটিতে কডিভকালীন স্বাস্থ্যবিধি, অগ্নি সচেতনতা, বায়ু নির্গমন যথাযথ হওয়া এবং শিশু শ্রমিক আছে কিনা বিষয়গুলো কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাছাড়া কারখানার বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি আছে কিনা এগুলোও পরীক্ষা করে দেখেছেন কর্মকর্তারা।

প্রসঙ্গে শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, কভিডকালেও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে কভিডকালে পুরোপুরিভাবে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিদর্শনে গিয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খুঁটিনাটিসহ দেখছি। আইন লঙ্ঘনের বিষয়গুলো হাসেম ফুড কারখানা পরিদর্শনের সময় আমরা দেখতে পেয়েছি। এটা নিয়ে আমরা শ্রম আইনে মামলা করেছি। লকডাউনের কারণে মামলার কার্যক্রম ধীর হয়ে পড়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন