ওষুধ শিল্পের বিকাশে অগ্রণী

নীতি কাঠামোয় জাফরুল্লাহ, ব্যক্তি খাতে স্যামসন-সালমান

বদরুল আলম

মাসেই পূর্ণ হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। মুক্তির সুবর্ণজয়ন্তীর কালে এসে দেশের নানা সফলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিয়মিত আয়োজন থাকছে বণিক বার্তায়। আজকের উপস্থাপনাটি আয়োজনেরই অংশ

স্বাধীনতার সময় দেশের ওষুধ শিল্প ছিল অবিকশিত একটি খাত। আমদানিনির্ভরতা ছিল অনেক বেশি। সে সময় ওষুধের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করতে হয়েছে আমদানির মাধ্যমে। ব্যয় করতে হয়েছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বঙ্গবন্ধু বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার সুফলও আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আবারো সে পুরনো ধারাতেই ফিরে যায় দেশের ওষুধ খাত।

পরিস্থিতি বিরাজ করে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত। ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করা হয় দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ঔষধ নীতিমালা। ওই নীতিমালাই শিল্প খাতটিতে ব্যক্তি উদ্যোগের বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর নীতিমালা প্রণয়ন বাস্তবায়নে সফল ভূমিকার কৃতিত্ব অনেকটাই গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর।

সংশ্লিষ্টদের অভিমত, নীতিমালাটি প্রণয়নের আগে দেশের ওষুধ শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগের আধিপত্য ছিল একচ্ছত্র। অসম প্রতিযোগিতায় স্থানীয় উদ্যোগ টিকিয়ে রাখাই অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণে এটি প্রণয়নের সময়ে নানা দিক থেকে বিরোধিতারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। নীতিমালাটি প্রণয়নের পর চিত্র পুরোপুরি উল্টে যায়। ভিত শক্ত করে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পায় দেশী ওষুধ কোম্পানিগুলো। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সামনে তৈরি হয় লাভজনক বিনিয়োগ ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ। একপর্যায়ে দেশীয় উদ্যোক্তারাই শিল্পটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নিতে সক্ষম হন।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ওষুধ শিল্পে এখন যেসব প্রতিষ্ঠানকে জায়ান্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগেরই বিকাশ ঘটেছে প্রধানত ১৯৮২ সালের পরে। বিষয়ে জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬ প্রণয়ন-সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ফারুকের বক্তব্য হলো, ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিটি ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ওষুধনীতি। এটি ছিল অত্যন্ত সফল শিল্পবান্ধব। দেশের মানুষকে ক্ষতিকর অপ্রয়োজনীয় ওষুধের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পকে পুনরায় প্রণোদনা দিতে এটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে যখন নীতিটি প্রণয়ন করা হয়, তখন ওষুধ খাতের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বড় জোরালো অবস্থান নেয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। তবে নীতি প্রণয়নের পর তা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে ওষুধ শিল্পের বিকাশ ঘটে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এতে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। যেমন স্কয়ার, বেক্সিমকো, অপসোনিন ইত্যাদি।

ওষুধ শিল্পের বিকাশে প্রথম জাতীয় ওষুধ নীতিমালার ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশীয় ওষুধ শিল্পের বিকাশের কারণ ছিল সরকারি নীতি। সরকার প্রকৃত নীতিমালা করলে সবাই সুবিধাভোগী হয়। ওই সময় যে ওষুধ কোম্পানির বার্ষিক বিক্রি ছিল যৎসামান্য, এখন ওই কোম্পানিটি হয়তো ঘণ্টায় সেই পরিমাণের চেয়েও বেশি ওষুধ বিক্রি করে। ওই সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের কারণেই দেশে উৎপাদিত ওষুধের বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হয়েছে।

বাংলাদেশ এখন ওষুধ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর। মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন কার্যক্রমে অনুসরণ করা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংজ্ঞায়িত আদর্শ উৎপাদন চর্চার (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি) এজন্য স্কয়ার, বেক্সিমকোসহ বেশকিছু ওষুধ কোম্পানি এরই মধ্যে নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে বৈশ্বিক ওষুধ খাতের বড় কিছু সনদ অর্জন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপের ইইউ, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ, উপসাগরীয় দেশগুলোর জিসিসি, ব্রাজিলের আনভিসা ইত্যাদি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বিদেশেও। এক্ষেত্রে নীতিমালার পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের উদ্যোগও সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে অভিমত খাতসংশ্লিষ্টদের।

তাদের ভাষ্যমতে, যৎসামান্য থেকে শুরু হওয়া ওষুধ শিল্পের অর্জনের পেছনে ১৯৮২ সালের নীতিমালাটি যেমন গুরুত্ববহ, তেমনি উল্লেখ করতে হয় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অবদানও। এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন দুজন উদ্যোক্তা। তারা হলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী সালমান এফ রহমান। তাদের প্রতিষ্ঠিত ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন শুধু দেশের বাজারেই জায়ান্ট হয়ে ওঠেনি, একই সঙ্গে বিদেশেও রফতানি করছে কোটি কোটি টাকার ওষুধ।

বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনাটা লিমিটেডের সিইও এমডি সৈয়দ এস কায়সার কবিরের মূল্যায়ন, ১৯৮২ সালের ওষুধনীতির জন্য আমরা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে ঋণী। আমাদের ওষুধ বাজারে এখন স্থানীয় কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ওই নীতির কারণেই। নীতি প্রণয়নের কয়েক বছরে অনেক সন্দেহ বিরাজ করছিল যে স্থানীয় কোম্পানিগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে কিনা। এটা যে সম্ভব, তা দৃশ্যমান হয় স্কয়ার বেক্সিমকোর নেতৃত্বে।

অথচ ষাটের দশকেও ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডে ওষুধ কোম্পানি ছিল না বললেই চলে। হাতে গোনা কিছু ওষুধ কোম্পানির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অপসোনিন, একমি স্কয়ার। এর মধ্যে স্কয়ারের প্রতিষ্ঠা ১৯৫৮ সালে। কয়েক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠা করেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। সে সময়ের ছোটখাটো উদ্যোগ আজ অনেক বড় এক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ২৮ হাজারেরও বেশি মানুষের। বাংলাদেশের বাইরে কেনিয়ায়ও ওষুধ উৎপাদনকারী কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে স্কয়ার।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, সেই সময় প্রফেসর নুরুল ইসলাম, ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো অনেকের সহযোগিতায় ওষুধনীতিটি প্রণয়ন হয়। ওই সময় আধিপত্যে থাকা বহুজাতিক কোম্পানির জন্য নীতিমালাটি ছিল বড় ধরনের শক আমাদের চিকিৎসকরাও বিশ্বাস করতে চাইতেন না যে ওষুধের মতো একটি পণ্য বহুজাতিক ছাড়া স্থানীয় কোম্পানি উৎপাদন করতে পারে। সে বিশ্বাসটি তৈরিতে ভূমিকা রাখে ওষুধনীতি। বাজারে ওষুধের মূল্যে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, নীতিমালাটির পরে নিয়ন্ত্রণ আসে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে তখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। স্কয়ার, বেক্সিমকো, একমি, অপসোনিন তখন সক্রিয়ভাবে ওষুধ শিল্প বিকাশে এগিয়ে আসে। ১৯৮২-এর যথাযথ ওষুধনীতির সুফল হিসেবেই এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের বিকাশ ঘটছে। যার কারণে স্থানীয় বাজারে ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে এখন রফতানিও হচ্ছে।

ওষুধ শিল্পের জায়ান্ট বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের যাত্রা ১৯৭৬ সালে সালমান এফ রহমানের উদ্যোগে। ১৯৮০ সালে ওষুধ উৎপাদনে আসে বেক্সিমকো। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ উৎপাদন বিপণনকারীর প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বেক্সিমকো। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে বাংলাদেশে ব্যবসা করা একাধিক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। বেক্সিমকোর বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে শিল্পটিতে উন্নত পশ্চিমা বিশ্বেও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রথম ওষুধ কোম্পানি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ওষুধ শিল্পের আজকের অবস্থানের নেপথ্যে মূল ভূমিকায় ছিলেন এখানকার সক্রিয়, কঠোর পরিশ্রমী দূরদর্শী উদ্যোক্তারাযেমন স্যামসন এইচ চৌধুরী। শুধু তিনিই নন, আমরাও ছিলাম। একমি অপসোনিনও ছোট থেকে পর্যায়ক্রমে বড় হলো। ওষুধনীতি মূলত আমাদের সাহস দিয়েছে। নীতিটির আগে বাংলাদেশের ওষুধ খাতে আধিপত্য ছিল বহুজাতিক কোম্পানির। ৯০ শতাংশই ছিল বহুজাতিক কোম্পানির বাজার। ওষুধনীতিতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। সরকার অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে এবং তত্কালেও দিয়েছে। কিন্তু যদি কোম্পানিগুলোর যোগ্যতা না থাকত তাহলে তো সে সুবিধা কাজে লাগানো সম্ভব হতো না। একদিকে ওষুধনীতি হলো, অন্যদিকে আমরা আমাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হলাম। এসব মিলিয়েই বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এখন অনেক শক্তিশালী।

ওষুধের বিক্রি ধরন নিয়ে নিয়মিত জরিপ চালায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ক্লিনিক্যাল গবেষণার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ। প্রতি প্রান্তিকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওষুধের বিক্রির তথ্য সংকলন পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি। আইকিউভিআইএর হিসাব বলছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশে স্থানীয় বাজারে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। দেশের মোট ওষুধ বিক্রির ৭০ শতাংশই করে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইকিউভিআইএ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ অনুযায়ী শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো. হেলথকেয়ার, অপসোনিন, রেনাটা, এসকায়েফ, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, এসিআই অ্যারিস্টোফার্মা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন