বিএফআইইউর অনুসন্ধান

করোনাকালে তৎপরতা বেড়েছে অনুমোদনহীন এমএলএমের

নিহাল হাসনাইন

করোনা মহামারীতে কর্মহীন হয়েছেন অনেকেই। আবার ব্যবসাতেও টান পড়েছে কারো কারো। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি শ্লথ হওয়ার প্রেক্ষাপটে আয় কমেছে মানুষের। পরিস্থিতিতে দ্বিগুণেরও বেশি লভ্যাংশ প্রাপ্তির প্রলোভনে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠেছে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায় যুক্ত অনুমোদনহীন বেশকিছু কোম্পানি। বেশি মুনাফার প্রত্যাশায় ব্যাংক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ তুলে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিলেন গ্রাহকরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য বলছে, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস সোপান প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ আট বছর চাকরি করা আজমাইন মাহাতাব বেকার হয়ে পড়েন করোনা মহামারীতে। তিন ছেলেমেয়ের সংসার। বিকল্প কোনো কর্মসংস্থানও মেলাতে পারছিলেন না। অবলম্বন বলতে ছিল কেবল স্ত্রীর নামে একটি বেসরকারি ব্যাংকে রাখা ১০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত। পুরনো এক বন্ধুর পরামর্শে ব্যাংক থেকে তুলে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে। প্রতি মাসে মুনাফার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল তাকে। এক মাস পর মুনাফা আনতে গিয়ে আজমাইন জানতে পারেন প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান।

বিএফআইইউর অনুসন্ধান বলছে, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেড মূলত একটি অনুমোদনহীন এমএলএমভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অস্বাভাবিক লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তা আত্মসাৎ করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠানটির তিনজন পরিচালক মো. আল আমিন, শারমিন আক্তার মো. ইশাক গ্রাহকদের জামানতের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তাদের নামে থাকা সর্বমোট ৩৭টি ব্যাংক হিসাব বিকাশে গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা জমা হয়েছে। তোলা হয়েছে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারীদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব বিকাশে ৩১ কোটি ১৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে এসব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে তদন্ত-পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করা হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ অক্টোবর থেকে নভেম্বর অভিযান চালিয়ে এসপিসির এমডি সিইওসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। বন্ধ করা হয় এসপিসি ওয়ার্ড এক্সপ্রেসের অ্যাপস। এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লি. এক বছরে দেশের ৬৪ জেলার পাশাপাশি বিশ্বের ১৭টি দেশে ২২ লাখ সদস্য সংগ্রহ করে হাতিয়ে নিয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা।

করোনাকালে অস্বাভাবিক লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত্কারী আরেকটি প্রতিষ্ঠান সোপান প্রোডাক্টস লিমিটেড। লাখ টাকা বিনিয়োগে প্রতিদিন হাজার ৩০০ টাকা মুনাফা প্রদানের ঘোষণা দিয়ে তারা আট মাসে হাজার ৪২৭ গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পরে অভিযোগ পেয়ে চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)

বিএফআইইউর অনুসন্ধান বলছে, পণ্যভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার আড়ালে অনুমোদনহীন অন্য আরেকটি এমএলএম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোপান প্রোডাক্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটিও অস্বাভাবিক লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ জামানত নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছে। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের ৬৯টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে ২১টি হিসাবে কোটি ১৩ লাখ টাকা স্থিতি রয়েছে। ব্যাংক হিসাবগুলো স্থগিত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

এদিকে, এমএলএম ধারায় সমবায় সমিতি পরিচালনা করে গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন মাল্টিপারপাস কোম্পানি। চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যক্রম অনুসন্ধান শেষে বিএফআইইউ বলছে, মজিবুর রহমান তার সহযোগীদের নিয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসব টাকা দিয়ে নামে-বেনামে জমি কেনা এফডিআর করাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে স্থানান্তর রূপান্তর করার দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। প্রাথমিক পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যায় যে রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠিত সমবায় সমিতি জনগণের জামানতে অর্থ নিয়ে নিজেদের নামে জমিসহ বিভিন্ন সম্পত্তি ক্রয় করেছেন।

গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করা সমবায় সমিতি অনুমোদনহীন এমএলএম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। সংশ্লিষ্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই গ্রাহকদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করে এমএলএম ব্যবসা সমবায় কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল কয়েকটি চক্র। ধরনের কার্যক্রম চালুর সময়ই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায় গ্রাহকরা প্রতারিত হওয়ার পর আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন। এসব অভিযোগের সূত্র ধরে তদন্ত পরিচালনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন