আবারো অপেশাদারি আচরণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের

মেহেদী হাসান রাহাত

পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ২০১৩ সালে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণের মাধ্যমে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়। তবে প্রকৃত ডিমিউচুয়ালাইজেশন বাস্তবায়ন থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এখনো সদস্য ও শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েই কার্যক্রম চালাচ্ছে এক্সচেঞ্জটি। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির প্রতিনিধি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক করা।

গত ২১ অক্টোবর ডিএসইর ৯৭২তম পর্ষদ সভায় ট্রেকহোল্ডার কোম্পানির প্রতিনিধি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ডিবিএর ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই মধ্যে ডিএসইর পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিও ট্রেকহোল্ডারদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিটির বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তাদের কেউ বলছেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর যেখানে স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রমের ওপর ব্রোকারদের প্রভাব কমার কথা, সেখানে তা ক্রমেই বাড়ছে। ব্রোকারদের সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসইর পর্ষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতেই বোঝা যায় এক্সচেঞ্জের ওপর তাদের কী ধরনের প্রভাব রয়েছে। এছাড়া ডিএসইর সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও সবার জানা। ফলে এক্ষেত্রে ডিবিএর ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক হলে সেটির অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ডিমিউচুয়ালাইজেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও ডিমিউচুয়ালাইজেশন পরবর্তী সময়ে এক্সচেঞ্জটির ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বণিক বার্তার। তাদের সবাই এটিকে ডিমিউচুয়ালাইজেশন ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়ারহোল্ডার ও ব্রোকারেজ ব্যবসা আলাদা 

করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এ অবস্থায় ডিবিএকে ট্রেকহোল্ডার প্রতিনিধি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষমতা দেয়া হলে তা এক ধরনের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে দৃশ্যমান হবে। এছাড়া ছাড়পত্রের বিষয়ে ডিএসইর পর্ষদের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টিও ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ধারণার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়টি যেমন, ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়াও তেমনি।

এদিকে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারা ডিএসইর পর্ষদের এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত নন। স্টক এক্সচেঞ্জের বিষয়গুলো তদারকির দায়িত্বে থাকা কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের উদ্যোগ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক।

জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ডিএসই কেন এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর কারণ আমি জানি না। তবে যে আইনের অধীনে ট্রেকহোল্ডারদের লাইসেন্স দেয়া হয়, সেখানে ব্রোকারদের অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে এমন কোনো বিষয় উল্লেখ নেই। তাহলে প্রতিনিধি পরিবর্তনের মতো সামান্য বিষয়ে একটি অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়টি বোধগম্য নয়। ডিএসই কোন যুক্তি কিংবা আইনের বলে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে বিষয়ে তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।

এদিকে ব্রোকার ও ডিবিএর সদস্যরা বলছেন, ডিএসইর ব্রোকারদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর ডিবিএ গঠন করা হয়। এর আগে ব্রোকারদের সংগঠন করার অধিকার ছিল না। ডিবিএ যাতে একটি কার্যকর সংগঠন হিসেবে বিকশিত হতে পারে, সেজন্য প্রতিনিধি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়ে ডিএসইর কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ডিএসই সেটির অনুমোদনও দিয়েছে। এছাড়া সদস্য প্রতিষ্ঠানের জন্য কখনো কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে সবাই ডিবিএকে দায়ী করেন। তাই ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষমতা থাকলে ডিবিএ যাছাই-বাছাইয়ের সুযোগ পাবে।

ডিবিএর প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সংগঠন হিসেবে সদস্যদের কাছে যাতে আমাদের একটি অবস্থান থাকে, সেজন্য এ উদ্যোগ নিয়েছি। এ ধরনের অনুমোদন বা ছাড়পত্র দেয়ার বিষয়টি সব বাণিজ্য সংগঠনের ক্ষেত্রেই থাকে। এছাড়া সব ব্রোকার যাতে সংগঠনের সদস্য হয় ও এটি যাতে আরো বিকশিত হতে পারে, সেজন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে ডিএসইর সঙ্গে ডিবিএর যোগাযোগ আরো নিবিড় হবে।

ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা দলাদলির কারণে কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছাড়পত্র না দেয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান ডিবিএ প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ডিবিএর পর্ষদে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে দুই-তিনজন যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো প্রতিনিধিকে ছাড়পত্র দিতে না চায় তাহলে কিন্তু সম্ভব নয়। কারণ এখানে সবার মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর আমরা ব্রোকাররা সবাই একটি পরিবার। তাই ব্যক্তিস্বার্থে এ ধরনের হীন কাজ কেউ করবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে যাতে নিয়মিতভাবে সাবস্ক্রিপশনের অর্থ পাওয়া যায় ও কেউ এ অর্থ জমিয়ে রেখে কিংবা না দিয়ে পার পেয়ে যেতে না পারে, সেটিও প্রতিনিধি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ডিবিএর ছাড়পত্র বাধতামূলক করার একটি কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এতে কোনো প্রতিষ্ঠানের সাবস্ক্রিপশনের অর্থ বকেয়া থাকলে প্রতিনিধি পরিবর্তনে ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে বকেয়া অর্থ আদায় করতে সুবিধা হবে।

ডিএসইর পর্ষদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ জানতে চাইলে এক্সচেঞ্জটির শেয়ারধারী পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বণিক বার্তাকে জানান, সব সদস্যের কাছ থেকে যাতে সাবস্ক্রিপশনের অর্থ নিয়মিতভাবে পাওয়া যায়, সেজন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যান্য ব্যবসায়িক সংগঠনও সদস্যদের সাবস্ক্রিপশনের ভিত্তিতেই চলে। তাছাড়া ডিবিএ ছাড়পত্র দিলেই যে কেউ প্রতিনিধি হিসেবে ডিএসইর অনুমোদন পাবে বিষয়টি এমন নয়। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হলে ডিবিএর ছাড়পত্র থাকলেও সেক্ষেত্রে ডিএসই সেটি বাতিল করে দিতে পারে।

ব্রোকারদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা দলাদলির কারণে ছাড়পত্র আটকে দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। ব্যক্তিবিশেষের কারণে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই বলে মনে করেন তারা।

ডিএসইর সাবেক শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও বিএলআই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বণিক বার্তাকে বলেন, ডিবিএর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসইর পর্ষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি ইতিবাচক। কোন ব্রোকার কেমন সেটি আমাদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। তাই ডিবিএর কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়া হলে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা আরো বাড়বে। তবে ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা অন্য কোনো কারণে ছাড়পত্র না দেয়ার যে শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা কখনো ঘটবে না, এ কথা বলা যাবে না। এটি ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর করে। যদি সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব সংগঠনের দায়িত্বে থাকে তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না বলে জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন