ভিয়েতনাম : মহামারীতে থমকে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা

বণিক বার্তা ডেস্ক

গত তিন দশকে স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ে একের পর এক সুখবর পেয়ে এসেছে ভিয়েতনামের জনগণ। বিশেষ করে আশির দশক থেকে দেশটির রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। কিন্তু দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এখন বাদ সেধেছে মহামারী। খবর জাপান টাইমস।

ভিয়েতনামের রফতানি খাত এখন ধুঁকছে। আকস্মিকভাবেই ধস নেমেছে দেশটির তৈরি পোশাক রফতানিতে। মহামারীর কারণে বিদেশ থেকে আসা প্রচুর ক্রয়াদেশ হারিয়েছে ভিয়েতনামি পোশাক কারখানাগুলো।

মহামারীর কারণে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অর্থনীতিতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে ভিয়েতনামি শ্রমিক-কর্মজীবীদেরও। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ভিয়েতনাম। ফলে এসব দেশের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখন শুধু হো চি মিন সিটি বা হ্যানয়ের রাস্তাঘাটে নয়, ভিয়েতনামের গ্রামাঞ্চল পর্যটনকেন্দ্রগুলোয়ও অনুভূত হচ্ছে ভালোভাবেই।

হো চি মিন সিটির বাণিজ্যিক কেন্দ্রের একেবারে মধ্যস্থলে অবস্থিত বেন থান মার্কেটের সড়কে ফল বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করেন লে থি হোয়া (৫৫) কিছুদিন আগেও বেচাবিক্রি বেশ রমরমা ছিল তার। মহামারীর কারণে এখন শুধু অতীতের সুদিনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় তাকে। তিনি বলেন, মানুষ এখন রাস্তায় বেরোয় না। মহামারীর আগে আমার যে বিক্রি ছিল, এখন তার এক-তৃতীয়াংশও নেই।

বিশ্বায়নের যুগে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার দিক থেকে যেসব দেশ সবচেয়ে ভালো করছে, সেগুলোর অন্যতম হলো ভিয়েতনাম। অল্প কয়েক দশকের মধ্যে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং পাওয়ার হাউজ হয়ে উঠেছে দেশটি। অনেকটা রফতানি খাতের ওপর ভর করে ২০১৯ সালেও দশমিক শূন্য শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে দেশটি। অন্যদিকে মহামারীর কারণে বছর প্রবৃদ্ধির হার দুই দশকে সবচেয়ে শ্লথ হয়ে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশটিতে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বছর দেশটির প্রবৃদ্ধির হার নেমে আসতে পারে দশমিক শতাংশে। এর মধ্যে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) দেশটির অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র দশমিক ৩৬ শতাংশ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে ভিয়েতনামে। ইন্টেল, স্যামসাং এলজির মতো জায়ান্ট কোম্পানিগুলোও ভিয়েতনামে কারখানা খুলেছে। অন্যদিকে সোলার প্যানেল শিল্প তৈরি পোশাক শিল্পেও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে দেশটি। ২০১৯ সালে দেশটির রফতানির পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। ২০০৮ সালের পর

থেকে দেশটির রফতানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার গুণে। অন্যদিকে মাথাপিছু বার্ষিক মজুরির পরিমাণ সময় হাজার ১৫৪ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার ৮০০ ডলারে।

বিষয়ে ইনফোকাস মেকং রিসার্চের ব্যবস্থাপনা পরিচালক র্যালফ ম্যাথিয়াস বলেন, গত ৩০ বছরে ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে সুখবরের সুনামি বয়ে গিয়েছিল। দুই দশক আগে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ে যোগদানের পর এবারই প্রথম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ধসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভিয়েতনামি অর্থনীতি।

অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের সিঙ্গাপুরভিত্তিক অর্থনীতিবিদ সিয়ান ফেনার জানান, মহামারী রফতানিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোকে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।

মহামারীর শুরু থেকেই ভিয়েতনামসহ রফতানিনির্ভর দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ভিয়েতনামি কাস্টমসের পরিসংখ্যান বলছে, এপ্রিলেও দেশটির রফতানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ। মে মাসে বৈশ্বিক বাণিজ্য খাত স্থবির হয়ে পড়ায় দেশটির রফতানিতে পতন হয় আরো ১২ দশমিক শতাংশ। অন্যদিকে জুলাই পর্যন্ত বছরের প্রথম সাত মাসে সার্বিক রফতানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে দেড় শতাংশে। যেখানে আগের বছরের প্রথম সাত মাসে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতাংশ।

অন্যদিকে ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে দেশটির পর্যটন খাতের অবদান শতাংশ। মহামারীর কারণে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে খাতের রাজস্ব আয় কমেছে ৫৫ দশমিক শতাংশ। দেশটির উৎপাদন আতিথেয়তা খাতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোটি ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা, যা দেশটির মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ। এদের সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক ধস।

তবে মুহূর্তে অর্থনীতির গতিপথে কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধনের কথা ভাবছেন না ভিয়েতনামি নেতারা। এর পেছনে কারণও রয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এক ডজনেরও বেশি রফতানি চুক্তিতে সই করেছে দেশটি। ফলে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে বড় এক চৌম্বকক্ষেত্র হয়ে উঠেছে দেশটি।

সফলভাবে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর ক্ষেত্রে ভিয়েতনামি সরকার এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।  তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির ওপর সংক্রমণের দ্বিতীয় প্রবাহ বয়ে যায়। বন্দরনগরী দানাং থেকে ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে ১৪টি প্রদেশ শহরে। তবে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সফল ভিয়েতনাম। সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে হাজার ৩৪ জনের। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে মাত্র দুজনের।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারায় দ্বিতীয় প্রবাহের মধ্যেও দেশটিতে শিল্পোৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি। যদিও সময় মহামারী থেকে নিরাপত্তাসংক্রান্ত সব ধরনের পদক্ষেপই কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করেছেন দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ ভালো অবস্থানেই রয়েছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের তুলনায় এশিয়ার অন্যান্য দেশে আরো অনেক বেশি প্রাণঘাতী অর্থনীতির জন্য হানিকারক হয়ে দেখা দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। তবে বিদেশী বাজার পর্যটন শিল্পের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ভিয়েতনামিদের জন্য একধরনের শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে চলমান মহামারী পরিস্থিতি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন