দাম কমিয়েও বিক্রি হচ্ছে না স্ক্র্যাপ

জাহাজ ভাঙা শিল্পের ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যাংক

ওমর ফারুক ও দেবব্রত রায়

কয়েক বছর ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে থাকা জাহাজ ভাঙা শিল্প করোনাভাইরাসের কারণে ফের সংকটে পড়েছে। ইয়ার্ডগুলোয় অবিক্রীত পড়ে আছে প্রায় ১৮ লাখ টন স্ক্র্যাপ। দাম কমিয়েও তা বিক্রি করতে পারছেন না ইয়ার্ড মালিকরা। পরিশোধ করতে পারছেন না ব্যাংকঋণের কিস্তি। পরিস্থিতিতে খাতটিতে দেয়া ঋণ আদায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে ব্যাংকগুলো।

ইস্পাত খাতে প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের। এর মধ্যে জাহাজ ভাঙা খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণ দীর্ঘদিন ধরে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। ব্যবসা খারাপ যাওয়ায় খাতের সিংহভাগ ঋণই এরই মধ্যে খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছে। ঋণ আদায়ে অনেকগুলো মামলাও চলমান রয়েছে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে। বিনিয়োগ করা ব্যাংকের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি হয়েছে জাহাজ ভাঙা খাতসহ ইস্পাত শিল্পে। গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চট্টগ্রামে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই ইস্পাত খাতে। ২০১৩-২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে ইস্পাত খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা।

দীর্ঘ সময় মন্দায় থাকার পর গত কয়েক বছরে পুরনোদের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল জাহাজ ভাঙা শিল্প। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনার ধাক্কায় আবারো নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্যমতে, সংগঠনটির তালিকায় দেড় শতাধিক ইয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ৬০টির মতো ইয়ার্ড। তাদের স্ক্র্যাপের মূল ক্রেতা রি-রোলিং মিলগুলোর উৎপাদন থেমে থাকায় এসব ইয়ার্ডে পড়ে আছে স্ক্র্যাপের স্তূপ।

ইয়ার্ডে মজুদ কমাতে টনপ্রতি ১০ হাজার টাকা ছাড় দিয়েও স্ক্র্যাপ বিক্রি করতে পারছেন না মালিকরা। দাম পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ে জাহাজের স্ক্র্যাপগুলোর প্লেট, সেটিং স্ক্র্যাপ, মিক্স স্ক্র্যাপ প্রতি টন ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। মার্চের শুরুতে ৫৮ টাইপ গ্রেডের প্লেট এবং মিক্সআপ স্ক্র্যাপ ৪৩ থেকে ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছিল। করোনার কারণে রি-রোলিং মিল শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় এখন এসব স্ক্র্যাপ মূল দাম থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা কমিয়ে ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন ইয়ার্ড মালিকরা। এতে ক্রেতা মিলছে না। স্ক্র্যাপ বিক্রি না হলেও ব্যাংকের প্রতি মাসের ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে আছেন তারা।

বিএসবিআরএর সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার কারণে অনেক দিন স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়নি। ইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপের স্তূপ জমে আছে। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে বিক্রি শুরু হলেও তা আশানুরূপ নয়। টনপ্রতি ১০ হাজার টাকা কমিয়েও এখনো আমরা ক্রেতা পাচ্ছি না। সরকার করোনা সংকটকালেও কোনো প্রণোদনা খাতে দেয়নি। ব্যবসা না থাকায় ব্যাংকঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে পারছেন না ইয়ার্ড মালিকরা।

ইস্পাত খাতে বিনিয়োগ করা বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত সাত বছরেই ইস্পাত খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। বছর বছর ঋণের বোঝা বাড়লেও গত তিন-চার বছর কিছুটা চাঙ্গা হওয়ায় ঋণের টাকা আদায়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে উদীয়মান খাতটি আবারো স্থবির হয়ে পড়ায় ঋণ আদায়ে আবারো দুশ্চিন্তায় পড়েছে ব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত দুই-তিন বছরে ইস্পাত খাতে আগের চেয়ে অনেক ভালো ব্যবসা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির চেয়ে ঋণ আদায়ের পরিমাণ সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু এবারে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের নিয়মিত কিস্তি আদায় করছে না। ইস্পাত খাতের দুরবস্থা চলতে থাকলেও খাতে বিনিয়োগ করা হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় আবারো অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রামের চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, শিপ ব্রেকিং খাতে বিনিয়োগ করে গত কয়েক বছরে প্রায় সব ব্যাংকে একটা বড় ধাক্কা গিয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে এই খাতটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে খাতের বিনিয়োগ উঠে আসার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এদিকে করোনা সংকটসহ নানা কারণে স্ক্র্যাপের চাহিদা কমে যাওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে জাহাজ আমদানি কমেছে ১১৫টি। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে ২৭২টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হয়, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাহাজ আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫৭টি।

জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ার কারণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ২০১৮-১৯ অর্থবছর বা তার আগের বছরগুলোয়ও আমদানি করা স্ক্যাপ জাহাজের টনপ্রতি ট্যারিফ মূল্যের ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ টাকা মূল্য সংযোজন কর সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করেছিলেন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে স্ক্যাপের ওপর নতুন করে আরো শতাংশ কর আরোপ করা হয়। নতুন করে কর আরোপের ফলে ৩০০ টাকার স্থলে এখন ভ্যাট দিতে হচ্ছে হাজার টাকা।

জাহাজ ভাঙা শিল্পের ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের ৭০ শতাংশ রি-রোলিং মিলের অন্যতম কাঁচামাল পুরনো জাহাজ ভেঙে পাওয়া স্ক্র্যাপ। জাহাজ ভাঙা শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে এক লাখ শ্রমিক-কর্মচারী এবং পরোক্ষভাবে তিন-চার লাখ মানুষ জড়িত। খাতের ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর শুল্ক, কর, ভ্যাট ফি বাবদ হাজার ২০০ থেকে হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব দেয় সরকারকে। স্ক্র্যাপ বিক্রি হোক না হোক রাজস্ব প্রতি বছর নিয়মিত দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। কিন্তু করোনাকালে সরকার একাধিক শিল্প খাতকে প্রণোদনা দিলেও এই খাতকে প্রণোদনার আওতায় আনেনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন