জানুয়ারি-জুন সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে

বিনিয়োগ আকর্ষণে নেয়া উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করুন

বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে বিনিয়োগ বাণিজ্য। বাইরের দেশ থেকে বিনিয়োগ আনতে বিভিন্ন দেশ বড় ধরনের ছাড় দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা মিয়ানমারের দিকে লক্ষ করলে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। কেননা বিদেশী বিনিয়োগ দেশী পণ্য বা সেবার চাহিদার বিস্তার ঘটায়। দেশের পণ্য বা সেবা বিদেশে রফতানির সহজ সুযোগ সৃষ্টি করে। ফলে একটি বিদেশী বিনিয়োগ দেশের অভ্যন্তরে গতি সৃষ্টি করে। তাতে দেশের বিনিয়োগ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। তাই সঠিক বিদেশী বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির কাঠামো পাল্টে দিয়ে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য আনে। বাংলাদেশও সচেষ্ট বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে, কিন্তু আশানুরূপ ফল মিলছে না। এর অন্যতম কারণ বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস-২০২০ সূচকে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়ে এলেও সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এখনো অনেক পিছিয়ে। কভিড-১৯ যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের কারণে চীন থেকে অনেক বিদেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। এতে অন্যান্য দেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম ইন্দোনেশিয়া বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে আইন, বিধিবিধান, কর ব্যবস্থা এবং ব্যাংকিং পদ্ধতি সহজ করেছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে দেশগুলো সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামো, নীতিগত সহায়তা, ব্যাংকিং নিয়ম-নীতি পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ব্যবহারসহ সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশকেও বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার এবং অবকাঠামো উন্নয়নে আরো মনোযোগ দিতে হবে।

বিদেশী বিনিয়োগ টানতে এরই মধ্যে কৌশল নির্ধারণ শুরু করেছে ভারত সরকার। সেখানে দেশী-বিদেশী বিয়োগকারীদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ একর জমি। শিথিল করা হয়েছে শ্রম আইনের শর্ত, পরিকল্পনা হচ্ছে করছাড় দেয়ার। রাজ্যগুলোও নিচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। এরই মধ্যে প্রায় এক হাজার কোম্পানিকে ভারতে আসার প্রস্তাব দিয়েছে মোদি সরকার। বিদেশী বিনিয়োগ টানতে এরই মধ্যে বড় সফলতা পেয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার। চীন থেকে মার্কিন কারখানা সরিয়ে নিতে সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই প্রস্তাব দিয়েছে জাকার্তা। বরাদ্দ করেছে চার হাজার একর জমি। জাকার্তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ২৭টি কারখানা সরানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো জানিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার জায়ান্ট এলজিও চীন থেকে কারখানা সরিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় আসছে। এদিকে বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারীতে ইউরোপ, আমেরিকা নাকানিচুবানি খেলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ভিয়েতনাম। স্থানান্তরিত এসব বিনিয়োগ টানতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে দেশটি। বিনিয়োগ আকর্ষণে স্পেশাল টাস্কফোর্স করেছে তারা। লক্ষ্য, মাল্টিবিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্প্রতি হওয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হ্যানয়ের অন্যতম শক্তি। ফলে চীনের অনেক পোশাক কারখানারও বিনিয়োগ পাওয়ার আশা করছে দেশটি। বিদেশী বিনিয়োগের তেমন কোনো আশ্বাস না পেলেও বসে নেই বাংলাদেশ। তবে বিনিয়োগ আসছে কম। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কম বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। জাপানি বেশকিছু বিনিয়োগ পাওয়ার আশা করছে সরকার। বিনিয়োগ আকর্ষণে এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানির করপোরেট কর কমানো হয়েছে আড়াই শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নীতিতে পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি বাস্তবায়ন হলে বৈদেশিক মুদ্রা বা এফসি অ্যাকাউন্ট খুলে লাভের টাকা রাখতে, বিনিয়োগ করতে এবং ফেরত নিতে পারবেন বিদেশীরা।

২০২১ সালে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে কমপক্ষে ৯৯তম স্থানে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। লক্ষ্যপূরণে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। তাছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য নীতি সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছেন অনেকেই। বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে খুব বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আনা যাবে না। তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। দূর করতে হবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। একই সঙ্গে পুঁজি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করবে এমন শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বিনিয়োগের পূর্বশর্তগুলো পূরণ না করতে পারলে প্রকৃত বিদেশী বিনিয়োগ আনা সম্ভব হবে না। বিদেশী বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পূর্বশর্ত হিসেবে বিনিয়োগকৃত অর্থ বা লভ্যাংশ যাতে বিনিয়োগকারী নিজ দেশ বা অন্যত্র স্থানান্তর করতে পারেন, সেজন্য -সংক্রান্ত সব ব্যাংকিং কার্যক্রম নীতিমালা পরিবর্তন বা প্রতিবন্ধকতা দূর করার আশু ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আরো দুটি উপাদানের কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, শিল্প বা সেবা খাতে বিনিয়োগ তখনই হবে, যখন উৎপাদিত পণ্য বা সেবার বাজার সুরক্ষিত হবে। বাজার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা না হলে বিনিয়োগ হবে না। অর্থাৎ পরিবেশ রয়েছে, আইনের পরিবর্তন হয়েছে, তার পরও বিনিয়োগ হবে না বাজারে পণ্যের বা সেবার চাহিদা না থাকলে। এক্ষেত্রেও আমাদের গার্মেন্ট একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্র্যান্ড হিসেবে আমাদের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়নি অথচ আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। এটি সম্ভব হয়েছে বায়িং হাউজগুলোর মাধ্যমে। ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে সম্পত্তি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, বিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে এগুলোর সেবা যাতে একজন বিনিয়োগকারী এক স্থান থেকেই সহজে পেতে পারেন, সেজন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের কার্যক্রর আরো সক্রিয় করতে হবে।

ভারতের উদাহরণগুলো আমরাও বিবেচনায় নিতে পারি। কেননা অর্থনৈতিক সামাজিক সূচকে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ এখনো দুর্বল ব্যবসায়িক পরিবেশের ইমেজ সংকট দূর করতে ব্যস্ত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো সমস্যা এখন না থাকলেও জমি সমস্যার পাশাপাশি ওয়ান স্টপ ফ্যাসিলিটির অকার্যকারিতার মতো সমস্যা রয়ে গেছে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা, জটিল কর কাঠামো, বন্দরে কালক্ষেপণ ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতির ছড়াছড়ি বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার অন্যতম অন্তরায় এখানে। এসব জটিলতার ফলে বিনিয়োগের অনুমোদন পেতেও সময়ক্ষেপণ হয়। তাছাড়া এখানে ব্যবসা করার জন্য নানা ধরনের বাড়তি ব্যয়ও বহন করতে হয়। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা স্বাভাবিকভাবেই অনুৎসাহিত হয়ে পড়েন। বিদেশী বিনিয়োগ আনতে যখন সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন দেশীয় বিনিয়োগের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। বেসরকারি বিনিয়োগের হার একই জায়গায় থমকে আছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর অন্যতম শর্ত আস্থার পরিবেশ। সেবার মানও বাড়াতে হবে। সর্বোপরি সরকারের নেয়া উদ্যোগের সঠিক দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন