সানেম ও দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের জরিপ

করোনায় ছোট ও মাঝারির তুলনায় ভালো আছে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারীতে ছোট মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে তথ্য উঠে এসেছে। কভিড নাইনটিন অ্যান্ড বিজনেস কনফিডেন্স: ফাইন্ডিংস ফ্রম ফার্ম লেভেল সার্ভে শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল গতকাল এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা . মসিউর রহমান। ওয়েবিনারে দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল সিরাজ।

এছাড়া ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে ছিলেন কে খান টেলিকম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম খান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মনজুর এবং পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান . এম মাসরুর রিয়াজ। প্রায় ৯০ জন গবেষক, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক উন্নয়ন কর্মী এই ওয়েবিনারে সংযুক্ত হন।

বাংলাদেশে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যবসায়ীদের আস্থা প্রত্যাশার ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক . সেলিম রায়হান। জরিপটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি জানান, আট বিভাগের ২২টি জেলার মোট ৩০৩টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সমীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ১৫৩টি উৎপাদন খাতের ১৫০টি সেবা খাতের। ১৫-২৩ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদাধিকারীদের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপের আরো তিনটি পর্ব আগামী তিন মাস পর পর পরিচালনা করে হবে বলেও তিনি জানান।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের প্রতিষ্ঠানের মুনাফা করার ক্ষমতা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আয়, ব্যবসার খরচ এবং বিক্রি/রফতানি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নের উত্তর -১০০ একটি মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়েছে। যেখানে মানে খুব খারাপ, ২৫ মানে খারাপ, ৫০ মানে কোনো পরিবর্তন নেই, ৭৫ মানে ভালো এবং ১০০ মানে খুব ভালো। মানদণ্ড ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আস্থা প্রত্যাশা প্রতিফলন করে।

জরিপের উত্তরের ওপর ভিত্তি করে সানেম তিনটি সূচক তৈরি করেছে। প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স বা পিবিএসআই (বার্ষিক), প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স বা পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক) এবং বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স (পরবর্তী তিন মাস) এর মধ্যে পিবিএসআইয়ের (বার্ষিক) মাধ্যমে গত বছরের এপ্রিল-জুনের সঙ্গে বছরের এপ্রিল-জুন পর্যায়ে ব্যবসার অবস্থার তুলনা করে। পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক) চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের সঙ্গে এপ্রিল-জুনের ব্যবসার অবস্থার তুলনা করে। আর বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স বা বিসিআই চলতি বছরের এপ্রিল-জুনের তুলনায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যবসায় আস্থা তুলনা করে। প্রতিটি সূচকই -১০০ মধ্যে মূল্যায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে ৫০ মানের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, ৫০-এর নিচের মানে অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন ২০২০ সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। সব খাতই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তৈরি পোশাক, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, পাইকারি ব্যবসা রেস্টুরেন্টের। ওষুধ আর্থিক খাতের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল।

এপ্রিল-জুনের তুলনায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উন্নতি বিসিআই সূচকের সব কয়টি উপাদানে প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু সার্বিক বিসিআই পরিমাপ খারাপ, ৫১ দশমিক শূন্য ৬। তৈরি পোশাক, চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বিসিআই ৫০-এর নিচে।

টেক্সটাইল, ওষুধ, পাইকারি, রেস্টুরেন্ট, আইসিটি আর্থিক খাতে বিসিআই ৫০-এর উপরে, যেটি ভালো পরিস্থিতি নির্দেশ করে। খাতগুলো জুলাই-সেপ্টেম্বরে এপ্রিল-জুনের চেয়ে ভালো পরিস্থিতি আশা করছে।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরে . রায়হান বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের সঠিক বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের সাহায্য নিয়েছে। আর ৫৫ শতাংশ সাহায্য নেয়নি। অন্যদিকে ১১ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানেই না।

প্রণোদনা প্যাকেজের সাহায্য না নেয়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, প্যাকেজের সহায়তা না নেয়াদের ৮৪ শতাংশ বলেছে, তাদের খাতের জন্য কোনো বরাদ্দ ছিল না। ৮২ শতাংশ বলেছে, সাহায্য কোনো অনুদান না হওয়ায় তারা তা নেয়নি। অন্যদিকে ৮০ শতাংশ দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেছে। ৭৮ শতাংশ ব্যাংকিং সেবার সমস্যার কথা বলেছে, ৬৩ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সাহায্য নেয়ার প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যার কথা জানিয়েছে, ৩৮ শতাংশ বলেছে, বরাদ্দ অর্থ তাদের জন্য যথেষ্ট নয় এবং ২৩ শতাংশ বলেছে, তাদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সহায়তাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ জানিয়েছে, সহায়তা খুবই কার্যকরী। ৪০ শতাংশ জানিয়েছে, সহায়তা তাদের জন্য কার্যকরী ছিল। শতাংশ সহায়তা কার্যকরী বা অকার্যকারী কিছুই মনে করেনি। উত্তরদাতাদের শতাংশের কাছে সহায়তার তেমন কার্যকারিতা নেই এবং শতাংশ কোনোই কার্যকারিতা পায়নি।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদেরকে দেশের ব্যবসা পরিস্থিতি সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হয়েছে। ৮৮ শতাংশ দুর্নীতি ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ জানিয়েছে কভিড-১৯ সংকট মোকাবেলা ব্যবসার জন্য সহায়ক ছিল না। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা বাণিজ্যের কাঠামোগত সমস্যা (বন্দর এবং কাস্টমস), অপ্রতুল সরকারি সাহায্য, কর ব্যবস্থায় সমস্যা, আর্থিক সেবাপ্রাপ্তিতে সমস্যা, ব্যবসা বা সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা, পরিবহনের অবস্থা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং বিদ্যুৎ সংযোগ প্রাপ্তিতে সমস্যা ব্যবসায় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন