কভিডের শর্ত মেনে সৌদির শ্রমবাজারে প্রবেশে এক বছরে প্রবাসীদের ব্যয় ১১১ কোটি টাকা

শফিকুল ইসলাম

ছবি : সংগৃহীত

কভিডে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে ওঠার পর যখন সৌদি আরবে শ্রমবাজার খুলতে শুরু করে, তখন নানা শর্ত আরোপ করে প্রবাসীদের ওপর। বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে দেশটিতে শ্রমিকদের প্রবেশের সুযোগ দেয়। দেশে আটকে পড়া প্রবাসীরা ভ্যাকসিন না পাওয়ায় দেশটিতে প্রবেশে পড়েন ভোগান্তিতে। বাংলাদেশী কর্মীদের হোটেলে কোয়ারেন্টিন থাকা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। ফলে এ শর্তারোপের জালে এ খাতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে ৪৪ হাজার কর্মীর জন্য প্রায় ১১১ কোটি টাকা বেশি খরচ করতে হয়। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ হাজার কর্মীকে অনুদান হিসেবে দেয়া হয় সাড়ে ৫৭ কোটি টাকা।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ১ হাজার ১৫৫ জন প্রবাসীকে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, আগস্টে ৭৫৪ জনকে ১ কোটি সাড়ে ৮৮ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১২৪ জনকে ২ কোটি ৮১ লাখ, অক্টোবরে ২ হাজার ৬১৮ জন প্রবাসীকে ৬ কোটি সাড়ে ৫৪ লাখ, নভেম্বরে ৯২১ জনকে ২ কোটি ৩০ লাখ ২৫ হাজার, ডিসেম্বরে ২ হাজার ৮৫ জনকে ৫ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। এছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ১ হাজার ৩৫৬ জনকে ৩ কোটি ৩৯ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ১৫৫ জনকে ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৭৫ হাজার, মার্চে ১ হাজার ৭৩৭ জনকে ৪ কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার, এপ্রিলে ৯৩৯ জনকে ২ কোটি ৩৪ লাখ ৭৫ হাজার, মে মাসে ২ হাজার ৪২৯ জনকে ৬ কোটি ৭ লাখ ২৫ হাজার এবং সর্বশেষ জুনে ৪ হাজার ৪২৫ জন প্রবাসীকে ১১ কোটি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সৌদি আরবে গেছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ প্রবাসী, ২০২১ সালে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন এবং ২০২২ সালে ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন এবং ২০২৩ সালে গেছেন ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ প্রবাসী। ২০২১ সালের ২০ মে থেকে সৌদি আরবে যেতে কোয়ারেন্টিনে থাকা কর্মীদের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এ বছর সাড়ে চার লাখের বেশি প্রবাসী সৌদি আরবে যান। যাদের মধ্যে অনেকে আকামা ও ভিসার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে থাকায় নানা শর্তারোপের মধ্যেই সৌদির শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন।

সৌদি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্যাকসিন ছাড়া ২০২১ সালের ২০ মে থেকে সেদেশে প্রবেশে বাংলাদেশী কর্মীদের হোটেল কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। তবে কোয়ারেন্টিনে থাকার সব খরচ বহন করতে হয়েছে শ্রমিকদের নিজেদের পকেট থেকে। সৌদি ফিরতে কোয়ারেন্টিনের জন্য সে দেশের নির্ধারিত হোটেলে বুকিং দিতে হয়েছে কর্মীদের। আর এজন্য শুরুতে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকাও খরচ করতে হয়েছে সৌদি প্রাবাসীদের। তবে এ খরচ দেশে আটকে পড়া কর্মহীন প্রবাসীদের জন্য বহন করা কঠিন হওয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলাপ করে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকায় হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে সৌদি আরবগামী কর্মীদের কোয়ারেন্টিন খরচ বাবদ তাদের পরিবারকে জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। কল্যাণ বোর্ডে প্রবাসীদের দেয়া অর্থ থেকে এ টাকা অনুদান হিসেবে সৌদি প্রবাসীদের দেয়া হয়।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, কভিডের শর্ত মেনে সৌদি শ্রমবাজারে প্রবেশে এক বছরে প্রবাসীদের অনুদান হিসেবে প্রায় ১১১ কোটি টাকা দেয়া হলেও বাস্তবে প্রবাসীদের খরচ হয়েছে দ্বিগুণ। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে করোনাকালীন সৌদিতে যাওয়া ৪৪ হাজার প্রবাসীকে অনুদান দেয়া হলেও ওই সময়ে কর্মী গেছে আরো বেশি। বিভিন্ন এজেন্সি থেকে যেসব কর্মী সৌদিতে গেছেন এয়ারপোর্টে এন্ট্রির সময় সেই প্রবাসীদের পক্ষে পরিবারের কারো নাম উল্লেখ না করে এ অনুদান আত্মসাতের জন্য এজেন্সিগুলো নিজেদের নাম, মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে, যা পরবর্তী সময়ে কল্যাণ বোর্ডের সফটওয়্যারে একাধিক নাম ও মোবাইল নম্বরসহ ধরা পড়ে। এজেন্সির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা এসব প্রবাসীর অর্থ এজেন্সি এবং ওই প্রবাসী কারো কাছেই দেয়া হয়নি।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌কভিডের সময়ে সৌদির এ শর্তারোপ অনেকটাই চাপে ফেলে সেখানে গমনেচ্ছু প্রবাসীদের।’ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে তাদের অনুদান দেয়ার বিষয়টি সবাই ইতিবাচকভাবে দেখেছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে অর্থের পরিমাণ আরো বাড়ানো গেলে প্রবাসীরা বেশি উপকৃত হতো। যেহেতু তারা দেশে আটকে ছিল দীর্ঘদিন। আর এজেন্সির হয়ে ওই সময়ে সৌদি যাওয়ায় যেসব কর্মী এ অনুদান পাননি, মন্ত্রণালয়ের উচিত এজেন্সিকে ডেকে সেসব কর্মীর প্রাপ্য অর্থ সহায়তা বুঝিয়ে দেয়া। এজেন্সিকে জবাবদিহির আওতায় আনা। কারণ তারা প্রবাসীদের পরিবারের যোগাযোগ নম্বর-ঠিকানা না দিয়ে অর্থ আত্মসাতের জন্য নিজের নাম-ঠিকানা দিয়েছে ‘

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব কর্মী ওই সময়ে সৌদির শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে এবং কোয়ারেন্টিনে থেকেছে, তাদের আর্থিক সহায়তার কথা বিবেচনায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। যদিও শুরুতে ৭০ হাজার থেকে আরো বেশি টাকা দিয়ে কর্মীদের হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে একটু মধ্যম মানের হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে শ্রমিকদের জন্য এ অর্থ দেয়া সহজ হয়।

প্রবাসীদের দেয়া এ অনুদান তাদের নিজেদের অর্থ থেকে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়ে মো. হামিদুর রহমান আরো বলেন, ‘‌বিদেশে যাওয়ার আগে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে প্রবাসীরা ৩ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেন, সেই টাকা থেকেই এ অনুদান দেয়া হয়েছে। সরকারের বিশেষ বরাদ্দের প্রয়োজন হয়নি। এছাড়া করোনাভাইরাস শনাক্তে আরটিপিসিআর পরীক্ষার জন্য ১ হাজার ৫৫০ টাকা দেয়া হয় প্রবাসীদের।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন