২০২১ বা তারপর মহামারী কেমন চেহারা নেবে?

বণিক বার্তা ডেস্ক

২০২১ সালের জুন মাস, বিশ্ব তখন করোনাভাইরাস মহামারীর এক বছর ছয় মাস সময় পার করেছে। ভাইরাস ধীরগতিতে তার প্রকোপ ছড়িয়ে চলেছে। নিয়মিত বিরতিতে লকডাউন তখন নিউ নরমালে পরিণত হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া একটি ভ্যাকসিন ছয় মাস পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে সক্ষম। কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি এর বিতরণের গতিকে ধীর করে রেখেছে। বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ২৫০ মিলিয়ন মানুষ সংক্রমিত হয়েছে এবং .৭৫ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।

কভিড-১৯ মহামারী কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে তা নিয়ে ওপরে বর্ণিত এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করা যেতেই পারে। সারা বিশ্বে এপিডেমিওলজিস্টরা সার্স-কোভ--এর বিস্তৃতি প্রভাব কমানোর প্রস্তুতি হিসেবে স্বল্প দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাগুলো তৈরি করছেন। যদিও তাদের পূর্বাভাস সময়রেখাগুলো ভিন্ন, মডেলাররা দুটি বিষয়ে সম্মত হয়েছেন: প্রথমত কভিড-১৯ আমাদের মাঝে থাকতে এসেছে। এছাড়া এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ভাইরাসের বিপরীতে মানুষের ইমিউনিটি কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকে, ভিন্ন ভিন্ন ঋতু কি এর বিস্তৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে কিনা এবং সম্ভবত সবচেয়ে জরুরিব্যক্তি সরকারগুলো কী উপায় বেছে নেবে এমন অনেক অজানা বিষয়ের ওপরে। ইনফেকশাস ডিজিজ মডেলার রোজারিয়ান্ড এগো বলেন, অনেক কিছু উন্মোচিত হচ্ছে, অনেক কিছু করা যাচ্ছে না। আমরা সত্যি এখনো জানি না কী হতে যাাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া কতটা স্বাভাবিকভাবে শুরু হবে এবং আমরা কী ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করব তার ওপর, বলছিলেন ডিজিজ মডেলার জোসেফ য়ু।

গত সপ্তাহে পৃথিবীব্যাপী কভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। যেখানে মৃত্যুবরণ করেছে সাড়ে ছয় লাখের বেশি মানুষ। অনেক দেশ এখন লকডাউন তুলে দিচ্ছে, অনেক মানুষ ধরে নিচ্ছে মহামারী শেষ হয়ে গেছে, বলছিলেন এপিডেমিওলজিস্ট ইউনতান গার্ড। তার মতে, ব্যাপারটা মোটেই তেমন না। আমরা এখন একটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় আছি।

এখন যদি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি এক বছরের কম সময় টিকে থাকে, যেমনটা অন্যান্য করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে ২০২৫ পর্যন্ত এবং তার পরও বছরান্তে কভিড-১৯-এর সংক্রমণের উল্লম্ফন দেখা যেতে পারে। সেই আলোকে নিজেদের মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরাও।


অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে?

মহামারী সব জায়গায় একই ধরনের ভূমিকা রাখছে না। চীন, নিউজিল্যান্ড রুয়ান্ডার মতো দেশগুলোতে সংক্রমণের নিম্ন হার লক্ষ করা গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিলের মতো দেশে সরকারগুলো দ্রুত লকডাউন তুলে দেয়ার পর সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে।

পরের দলটি নিয়ে মডেলাররা বেশ উদ্বিগ্ন। দক্ষিণ আফ্রিকায় যারা কিনা এখন কভিড-১৯-এর সর্বমোট সংক্রমণে পাঁচ নম্বরে আছে, মডেলারদের অনুমান অনুসারে আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে তারা হয়তো সংক্রমণের চূড়ায় অবস্থান করবে। এদিকে হাসপাতালের সংস্থান বিবেচনা করে দক্ষিণ আফ্রিকান সেন্টার ফর এপিডেমিওলজিক্যাল মডেলিং অ্যান্ড অ্যানালিসের পরিচালক জুলিয়েট পুলিয়াম বলেন, আমরা এরই মধ্যে অনেক এলাকায় সক্ষমতা অতিক্রম করে গেছি। তাই আমি মনে করি আমাদের সেরা দৃশ্যটিও ভালো কিছু নয়।

কিন্তু লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে আশাবাদী হওয়ার মতো খবরও আছে। প্রাথমিক কিছু প্রমাণ বলছে আচরণগত পরিবর্তনের ব্যাপারে। যেমন হাত ধোয়া মাস্ক পরা। যা কিনা লকডাউন পেরিয়েও অব্যাহত আছে এবং সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সহায়তা করছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৩টি দেশে লকডাউন শিথিল করে দেয়ার পর সেখানে সংক্রমণ পূর্বাভাস অনুযায়ী বাড়েনি। ইনফেকশাস ডিজিজ এপিডেমিওলজিস্ট সামির বাট বলেন, এটা বোঝা যায় মাস্ক পরা, হাত ধোয়া সামাজিক দূরত্বের নিরিখে মানুষের আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

মানুষের আচরণের পরিবর্তন সামনের দিনগুলোতে মহামারী মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। অন্য এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেক্সিকোতে ৭০ শতাংশ জনগণ ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

যেসব অঞ্চলে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ কমে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে গবেষকদের মতে সেখানে নজরদারির সেরা উপায় হচ্ছে টেস্ট আইসোলেশনের মাধ্যমে নতুন সংক্রমণ তাদের যোগাযোগগুলো চিহ্নিত করা। উদাহরণস্বরূপ হংকংয়ের কথা বলা যেতে পারে।

কিন্তু কার্যকরভাবে সংক্রমণ রুখতে কতটা কন্টাক্ট ট্রেসিং আইসোলেশন প্রয়োজন? একটি বিশ্লেষণ বলছে, কন্টাক্ট ট্রেসিং অবশ্যই হতে হবে দ্রুত বিস্তৃত। প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকদিনের মধ্যে ৮০ শতাংশ কন্টাক্ট ট্রেস করতে হবে। দলটি এখন ডিজিটাল কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখছে। তবে সপ্তাহে কয়েক হাজার সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়া অঞ্চলগুলোয় ৮০ শতাংশ যোগাযোগ চিহ্নিত করা অসম্ভব।

তবে বাট মনে করেন আপাতত যা করা যেতে পারে তা হলো সামাজিক দূরত্বের নীতি যত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পালন করা যায় তা করতে।

২০২১ সাল এবং তারপর কী ঘটবে?

আগামী বছর মহামারীর অবস্থা অনেকটাই নির্ভর করবে ভ্যাকসিনের আগমন এবং ভ্যাকসিন গ্রহণ করার পর কিংবা সংক্রমণের পর ইমিউন সিস্টেম কতটা সময় সুরক্ষা দিতে পারে তার ওপর। অনেক ভ্যাকসিন কয়েক দশক সুরক্ষা দিতে পারে। যেমন হাম অথবা পোলিও। আবার হুপিং কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনের সুরক্ষা সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়। একইভাবে কিছু ভাইরাল ইনফেকশন দীর্ঘমেয়াদি ইমিউনিটি প্রদান করে, যেখানে অনেকগুলো ক্ষণস্থায়ী প্রতিক্রিয়া দেখায়। এপিডেমিওলজিস্ট গার্ড লিখেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সার্স-কোভ--এর ঘটনাগুলো বহুলাংশে নির্ভর করবে ইমিউনিটির সময়কালের ওপর।

সার্স-কোভ--এর ইমিউনিটি কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে সে বিষয়ে গবেষকরা এখন পর্যন্ত খুব অল্পই জানেন। সেরে ওঠা রোগীদের নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমণ শুরুর পর ৪০ দিন পর্যন্ত অ্যান্টিবডি বজায় থাকে। আরো কিছু গবেষণা বলছে যে অ্যান্টিবডি লেভেল কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে হ্রাস পেতে থাকে। এখন কভিড-১৯ যদি সার্সের মতো একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে তবে অ্যান্টিবডি লেভেল উচ্চ অবস্থায় থাকবে পাঁচ মাস পর্যন্ত এবং দুই-তিন বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। অবশ্য কেবল অ্যান্টিবডিই একমাত্র সুরক্ষা পদ্ধতি নয়, মেমোরি বি এবং টি সেলও ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে লড়াই করতে পারে। যদিও সার্স-কোভ--এর সংক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা এখনো নিশ্চিত নয়। সব মিলিয়ে এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথও নেই।

তবে ভ্যাকসিন কিংবা দীর্ঘমেয়াদি ইমিউনিটি ছাড়া সংক্রমণ যদি বাড়তে থাকে, আমরা নিয়মিতভাবে ভাইরাসের বিস্তৃতি দেখব। সেক্ষেত্রে ভাইরাসটি স্থানীয় চেহারা ধারণ করবে। যা কিনা সত্যিকার অর্থেই হতাশাজনক ঘটনা হবে। তবে স্বল্পমেয়াদি ইমিউনিটির ক্ষেত্রে এটি বার্ষিক প্রাদুর্ভাবে পরিণত হতে পারে।

তবে স্থায়ী ইমিউনিটির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেটি ভ্যাকসিন ছাড়াও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ২০২১ সাল নাগাদ এটি অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। তবে ইমিউনিটি যদি দুই বছরের জন্য পাওয়া যায় তবে এটি অদৃশ্য হয়ে ২০২৪ সালের শেষ দিকে আবার ফিরে আসতে পারে।

নেচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন