মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নিষ্ঠাবান ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ

নাজমুল হক তপন

ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’র শেষ দৃশ্যে দুই বুড়ো সোবহান সাহেব আর ইমদাদ খুনকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা করার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শহীদদের তালিকা করার মহৎ উদ্যোগ এক জীবনে শেষ করতে পারবেন না, এটা খুব ভালভাবেই জানেন সোবহান সাহেব। কাজটা প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকবে এই বিশ্বাসের এতটুকুনও কমতি নাই সোবহান সাহেবের। জীবেনর একটা বড় সময় তিনি কাটিয়েছেন বড় কাজ করার পরিকল্পনা করে। শেষ পর্যন্ত সোবহান সাহেবের মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তালিকা তৈরি করাটা সবচেয়ে বড় কাজ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বাঙালির যে আপোষ করার কোন সুযোগ নাই এটা জীবনভর প্রমাণ করে গেছেন হুমায়ুন আহমেদ। ধরা যাক তার ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ বইটার কথাই। পিএচডি করার সময় মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে অবস্থানকালীন আশপাশের ছোট ছোট ঘটনাবলি নিয়ে বইটি লেখা। এর বেশ কয়েকটি লেখার মধ্যে অন্যতম ‘বাংলাদেশ নাইট’। মাত্র পাঁচ-ছয় পাতার লেখাটিতে একাত্তর বাঙালির জীবেন যে সর্বস্ব উঠে এসেছে সেটি। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে উদযাপিত হবে বাংলাদেশ নাইট।

সমসাটা বাঁধল অন্য জায়াগায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ কি. মি. এর মধ্যে বাংলাদেশী ছাত্র মাত্র দুজন। এদের একজন মোরহেড স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বাংলাদেশের ছাত্র মিজানুল হক। আর দ্বিতীয় জন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএচডিরত লেখক হুমায়ুন আহমেদ। বাঙালি ছাত্র কম ছিল, বিধায় পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ নাইট’ উদযাপনের প্রস্তাব দেয়া হল ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ থেকে। আর এটা শুনে তো মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় মিজানুল হক ওরফে মিজান সাহেবের। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টুডেন্টস অ্যাডভাইজারকে তো ভীষণভাবে অপদস্ত করলেন মিজান সাহেব। চিৎকার করে বললেন, তোমার এত বড় সাহস যে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের এক সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে বল। জানো ওরা একাত্তরে কী করেছে? আমার দেশকে তুমি অপমান কর কোন সাহসে? এভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মেজাজ চড়ে গেল মিজানের। জোরে হুংকার দিয়ে টেবিলের উপর খুব জোরে ঘুষি মারলেন। আর এতে করে টেবিলে রাখা কফির পেয়ালা উল্টে পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে ‘বাংলাদেশ নাইট’ উপদযাপনের অনুমোদন পেল মিজান। হুমায়ুন আহমেদ আর মিজান সাহেব দুজনে মিলে শুরু করলেন এই বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজনের।

এদিকে বিকেল গড়িয়ে যায়। তেমন কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারেননি দুজনে। আনাড়ি হাতে রান্না করতে গিয়ে খিচুড়ির ১২টা বেজে গেছে। বেসুরো গলায় দুজনে মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে এমনটাই ভাবছেন লেখক। কেননা দুজনই সেভাবে গান গাইতে পারেন না। সন্ধ্যার আগ দিয়ে শুরু হল এলাহী কান্ড। ৭০০- ৮০০, এমনকি হাজার কি.মি. দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে আসতে শুরু করল বাঙালি ছাত্ররা। দেশের সম্মান বাঁচাতে মিজানের অনুরোধ রেখেছে সবাই। সময় নষ্ট না করে মেয়েরা সুন্দর করে শুরু করল রান্নার আয়োজন। মূল অনুষ্ঠান শুরু হল জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে। আশপাশে ততক্ষণে আকর্ষণের কেন্দ্রে ‘বাংলাদেশ নাইট’  অনুষ্ঠান। পরদিন স্থানীয় ফার্গো ফোরাম পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ নাইট’ নিয়ে ছাপা হল একটি প্রতিবেদন। তার অংশ বিশেষ, ‘একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, দেশের গান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সব ছেলে মেয়েরা কাঁদতে শুরু করলো। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এমন মধুর দৃশ্য আর দেখিনি।’

হুমায়ুন আহমেদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ একটা জনযুদ্ধ। দেশের সব মানুষের প্রাণ বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। গেরিলা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঝাঁপিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত আলেখ্য ‘আগুনের পরশমনি’ উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সব ঘটনা। রেসকোর্সের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে আত্মসমর্পণ করার সময় করমর্দনের জন্য কাদের সিদ্দিকী ওরফে বাঘা সিদ্দিকীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি। হাত মেলালেন না কাদের সিদ্দিকী। বললেন, কোন নারী নির্যাতনকারী ও শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারি না।’

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চেয়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ? তার বহুল আলোচিত সৃষ্টি হিমুর হলুদ পাঞ্জাবিতে কোন পকেট নাই। মোদ্দা কথা হিমুর কোন টাকার প্রয়োজন নাই। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবর গ্রাসের বিপক্ষে হিমুর এটা প্রতিবাদ কি-না সেই গবেষণভার ভার তোলা থাক বোদ্ধাদের ওপরে। তবে বাংলাদেশের উপরের তলার মানুষদের নষ্টামি-ভ্রষ্টামি নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে একবার হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, ‘মাঝে মধ্যে মনে হয় লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে অনেক হিমু তৈরি করে দেশটাকে পাল্টে দিই। ’

লেখার বাইরে সেভাবে বদলের স্লোগান নিয়ে রাজপথে হয়তো নামেননি হুমায়ুন আহমেদ। তবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘ঘাতক দালাল নির্মল কমিটি’র তহবিল গঠনে রাখেন উল্লেখযোগ্য ভুমিকা। আর  বাংলাদেশের বিকৃতিগুলোকে চোখে  আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি এতটুকুনও। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপনাগুলোতে নাম বদলের যে নিম্ন রুচির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সেটা খুব সহজভাবেই লেখক তুলে ধরেন ‘অয়োময়’ ধারাবাহিক নাটকটিতে।

মির্জার বদলে নতুন জমিদার হয়েছে কাশেম। ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাদ্যি বাজিয়ে জানান দেয়া হচ্ছে যে, এখন থেকে এ অঞ্চলের  নাম হবে কাশেম নগর। ওই সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল পাগল। ঢুলিদের কাছে পাগল জানতে চাইল বিষয়ডা কি? উত্তরে একজন বলল, নতুন জমিদার কাশেমের নামে এখন থেকে এ অঞ্চলের নাম হবে কাশেম নগর।’ হাসতে হাসতে পাগল জবাব দিল, আমি যদি কোনদিন জমিদার হই কবে এলাকার নাম রাখব পাগলা নগর। কারন আমি তো পাগল!’

একটা আধুনিক সভ্য বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল লেখকের। ‘নক্ষত্রের রাত’ উপন্যাসের একটি ঘটনা স্মরণ করা যাক। উচ্চ শিক্ষার্থে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন রেবেকা। ক্লাসে  বাংলাদেশ নিয়ে অনেক বাজে মন্তব্য করছে অন্য ছাত্ররা। টাকা দিলে  সব বর্জ্য বাংলাদেশ নিয়ে নেবে এমন কথাও বলেছে একজন। আর এতে করে হাসির রোল উঠেছে পুরো ক্লাশ জুড়েই। এমনকি বাংলাদেশ নিয়ে রসিকতায় হাসছেন শিক্ষকও। এতটা অপমান সহ্য করার মত শক্তি ছিল না রেবেকার। লজ্জায় অপমানে রেবেকোর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। এটা দৃষ্টি এড়াল না শিক্ষকের। রেবেকার দিকে ইঙ্গিত করে শিক্ষক বললেন, তুমি তোমার দেশকে খুব ভালবাস। এটা খুবই ভাল একটা ব্যাপার। তবে আমি যতদুর জানি, তোমাদের দেশে এখন সামরিক সরকার। কোন সভ্য দেশে কখনো সামিরক সরকার থাকতে পারে না।’ এই উপন্যাসটির সময়কাল ছিল এরশাদের সময়ে।

বাংলাদেশে অনেকগুলো বিতর্কিত ইস্যুর মধ্যে বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড অন্যতম। এখন এনিয়ে অনেকে কথা বললেও একটা সময়ে বিপুল জনসমর্থন ছিল এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। র‌্যাবের জনপ্রিয়তা কেমন ছিল এটা বুঝতে বেশিদুর যাওয়ার দরকার নাই। ঈদ শপিংয়ে বাচ্চাদের র‌্যাবের পোশাক কিনে দেয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ঠিক এরকম একটা সময়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ লিখেছিলেন ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব উপন্যাসটি। এ উপন্যাস নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিল র‌্যাব। হুমায়ুন আহমেদকে বিষোদগার করে সংবাদ সম্মেলনও করেছিল এ বিশেষ বাহিনী। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, র‌্যাবের জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে এটি লিখেছেন হুমায়ুন আহমেদ।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, হুমায়ুন আহমেদের এই বিশ্বাসটা কতটা গভীরে ছিল এটা অনুধাবন করতে প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। বহুব্রীহি নাটকে বাড়ির চাকর সৈয়দ আব্দুল কাদের কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার বড় ভাই ভাই সৈয়দ শাহ আবদুল মতিন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এলাকার চেয়ারম্যান ভাইকে ডেকে বলেছিল, রাজাকারের খাতায় নাম লেখা। দিন হাজরা পাবি ৮০ টাকা। হিন্দুর একটা দোকানও পাবি। ভাই চেয়ারম্যানের মুখের উপর জানাল, থুক দেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ কর, দ্যাশকে স্বাধীন করব। যুদ্ধে খুব নাম হইছিল ভাইয়ের। থানা অ্যাটাক করতে গিয়া মারা যান। ভাইয়ের নামে একটা রাস্তা দিইছে এলাকার লোক। ওই রাস্তা দিয়া যখন হাইট্যা যাই তখন আমার সিনাডা দশ হাত ফুইল্যা ওঠে।’

বহুব্রীহি নাটকেই টিয়া পাখির মুখ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ বলিয়ে বাংলাদেশের একটা ভেদ রেখা যেন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ।

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন