অরক্ষিত বিজেএমসির ২৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

সাইদ শাহীন

চলতি মাসের তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) সব পাটকল। বন্ধ ঘোষণার পর থেকে ডিউটিতে নেই এসব পাটকলের প্রহরী নিরাপত্তাকর্মীরা। অবস্থায় অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে পাটকলগুলোর প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় পাটকল খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলস লিমিটেড। ১১৩ একর জমির ওপর স্থাপিত পাটকলে কয়েকদিন আগেও ভেতর-বাইরে জমজমাট চিত্র ছিল। শ্রমিক, কর্মচারী, নিরাপত্তাকর্মীসহ নানা শ্রেণীর মানুষের আনাগোনায় মুখর ছিল এর আঙিনা। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ ঘোষণার পর থেকে অনেকটা ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে পাটকলে। নিরাপত্তাকর্মীরা ডিউটিতে না থাকায় বর্তমানে কর্মকর্তারা শিফট করে পাহারা দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পাটকলটির প্রকল্পপ্রধান খান মো. কামরুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় নিরাপত্তা প্রহরী কম ছিল আমাদের। এখন সবাই ছুটিতে থাকায় কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুসারে কর্মকর্তারা শিফট করে পাহারা দিচ্ছি। কিছু শ্রমিক এখনো কলোনিতে রয়েছেন। তারা চলে গেলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। সামনের দিনে আনসার মোতায়েন বা পুলিশি টহল বাড়াতে পারলে পাটকলের মূল্যবান সম্পদগুলো অক্ষুণ্ন রাখা যাবে বলে মনে করেন তিনি।

নিরাপত্তা প্রহরী না থাকলেও সীমানাপ্রাচীর আছে ক্রিসেন্ট জুট মিলসে। কিছু পাটকলে তাও নেই। আবার অনেক পাটকলে সীমানাপ্রাচীর থাকলেও তা পর্যাপ্ত মজবুত নয় নিরাপত্তার জন্য অপ্রতুল। এছাড়া বেশকিছু পাটকলের জমি প্রায় বেদখলের পথে রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মিল বন্ধ করায় এখন প্রহরী বা নিরাপত্তাকর্মীরা কেউ পাহারা দিচ্ছেন না। ফলে এসব সম্পত্তির ওপর স্থানীয়দের লোভ বাড়তে পারে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে জমি বেদখল হতে পারে। এমনকি প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও  চুরি বা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি তাদের মোট সম্পত্তি মূল্যায়নের জন্য এরই মধ্যে পাটকলগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। তবে ২০১৮-১৯-এর খসড়া বার্ষিক প্রতিবেদনে মোট সম্পত্তির নানা শ্রেণী বিভাজন দেখিয়েছে বিজেএমসি। এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পত্তির মধ্যে স্থায়ী সম্পদ রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকারযার মধ্যে ভূমি, ভূমি উন্নয়ন, দালানকোঠা অন্যান্য, স্থাপনা যন্ত্রপাতি, আসবাব সরঞ্জামাদি, পরিবহন মোটরযানসহ অন্যান্য সম্পদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগ, চলতি হিসাবে জমা, লাভ/ক্ষতি হিসাবে জমার অর্থ দিয়ে মোট সম্পত্তি নির্ণয় করা হয়েছে।

বন্ধ ঘোষণার পর পাটকলে সম্পত্তিগুলো কী অবস্থায় রয়েছে তা জানতে ঢাকা, খুলনা চট্টগ্রামের একাধিক পাটকলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বণিক বার্তা। এসব কর্মকর্তার কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে প্রত্যেকেই সম্পত্তি রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর সম্পদের মধ্যে বড় অংশই হচ্ছে জমি। বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, পাটকলগুলোর জমির পরিমাণ হাজার ২০০ একর।  ঢাকা অঞ্চলের সাতটি পাটকলের মধ্যে ৭৭ দশমিক শূন্য ২৫ একর জমি নিয়ে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস লিমিটেড। এছাড়া করিম জুট মিলস লিমিটেড ৫০ দশমিক ৬৮ একর, লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লিমিটেড ৬২ দশমিক ৮৩ ইউএমসি জুট মিলস লিমিটেড ৫২ দশমিক ২৯ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পাশাপাশি রাজশাহী জুট মিলস লিমিটেডে ৪৯ দশমিক শূন্য একর এবং জাতীয় জুট মিলস লিমিটেডে ৭৫ দশমিক ২১ একর জমি রয়েছে।


চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১০টি জুট মিলের মধ্যে ৭৯ একর জমি নিয়ে শীর্ষে রয়েছে আমিন জুট মিলস লিমিটেড ওল্ড ফিল্ডস লিমিটেড। এছাড়া গুল আহমেদ জুট মিলস লিমিটেড ৫১ দশমিক ৪৮ একর, হাফিজ জুট মিলস লিমিটেড ৬৬ দশমিক ৩৩, এমএম জুট মিলস লিমিটেড ১৯ দশমিক ৭৬, আর আর জুট মিলস লিমিটেড দশমিক ৬৩, বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরি লিমিটেড ১০, গালফ্রা হাবিব লিমিটেড (নন-জুট) ২০ দশমিক ৪৮, কর্ণফুলী জুট মিলস লিমিটেড ফোরাত কর্ণফুলী কার্পেট ফ্যাক্টরি ৭৬ দশমিক ২১ এবং মিলস ফার্নিশিং লিমিটেড (নন-জুট) দশমিক ৩৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। 

খুলনা অঞ্চলের নয়টি পাটকলের মধ্যে ১১৩ দশমিক শূন্য একর জমি নিয়ে শীর্ষে রয়েছে ক্রিসেন্ট জুট মিলস লিমিটেড। এছাড়া কার্পেটিং জুট মিলস লিমিটেড ২৩ দশমিক শূন্য একর, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৭৯ দশমিক ৬৩, আলীম জুট মিলস লিমিটেড ৪৫ দশমিক ২৮ইস্টার্ন জুট মিলস লিমিটেড ৪০ দশমিক ৮৭, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস লিমিটেড ৫৫ দশমিক ৮৪, স্টার জুট মিলস লিমিটেড ৫৬ দশমিক ৩১, খালিশপুর জুট মিলস লিমিটেড ৭০ দশমিক এবং দৌলতপুর জুট মিলস লিমিটেডের ২২ দশমিক ৫৯ একর জমি রয়েছে।

বিজেএমসির পরিচালনা পর্ষদের ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ভ্যালুয়ার নিয়োগ করে পাটকলগুলোর স্থায়ী সম্পত্তির পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। সে নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্যালুয়ার মিলগুলোর স্থায়ী সম্পত্তির পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। সব মিলের পুনর্মূল্যায়ন প্রতিবেদন একীভূত করে একটি সমন্বিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। সমন্বিত প্রতিবেদনের আলোকে তথ্য উপাত্তে স্থায়ী সম্পদের পুনর্মূল্যায়নকৃত টাকার অংক উল্লেখ করেছে বিজেএমসি।

সেই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে খুলনা অঞ্চলে। অঞ্চলে মোট সম্পত্তির পরিমাণ হাজার ৬৫৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার। এছাড়া ঢাকা অঞ্চলে হাজার ৬৫৫ কোটি, চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাজার ৭১৭ কোটি ৩২ লাখ এবং নন-জুট অঞ্চলগুলোতে ৩২২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার সম্পত্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে ২৫ হাজার ৩৫২ কোটি ৪৭ লাখ টাকার সম্পত্তি রয়েছে। তবে সম্পত্তির মধ্যে স্থায়ী সম্পত্তি রয়েছে সবচেয়ে বেশি, যার পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে হাজার ৯৮৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা, খুলনা অঞ্চলে হাজার ৬৬৬ কোটি ২০ লাখ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাজার ৪৩৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ আছে। এছাড়া নন-জুট অঞ্চলগুলোতে রয়েছে ২৪৪ কোটি লাখ টাকার স্থায়ী সম্পত্তি।  তবে মোট স্থায়ী সম্পদ থেকে পুঞ্জীভূত অবচয় হাজার ৭০৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বাদ দিলে নিট স্থায়ী সম্পদ দাঁড়ায় ১২ হাজার ২৮২ কোটি লাখ টাকা।

পাটকলগুলো সম্পদের বিষয়ে বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, বিজেএমসির সবগুলো বিষয় নিয়ে আমরা একটি কর্মপরিকল্পনা করেছি। প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সম্পদসহ অন্য বিষয়গুলোর সমাধান কী হবে, সেটি নিয়েও পরিকল্পনা হয়েছে। সম্পত্তির বর্তমান অবস্থাও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এখন শ্রমিকদের পাওনা অর্থ পরিশোধে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সম্পদগুলো নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। সব বিষয়ে সময় হলেই আপনাদের জানাব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন