মানসিক স্বাস্থ্য

করোনা সংকট মোকাবেলায় কিছু কার্যকর কৌশল

ডা. তাঈম পাঠান

করোনাভাইরাসের এই মহামারী আমাদের সবাইকে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে প্রভাবিত করছে। সংকট আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এবং অর্থনৈতিক সামাজিক কাঠামোকে ভীষণভাবে চাপের মুখে ফেলছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে। ধরনের ব্যতিক্রম পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তায় বিচলিত হওয়াটাই মানুষের জন্য স্বাভাবিক। নানা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা আসছে এবং এর অধিকাংশই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন ভবিষ্যতে কী হবে এবং ভাইরাসটি আপনাকে, আপনার পরিবারকে, আপনার দেশকে এবং সমগ্র বিশ্বকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে? যদিও এই দুশ্চিন্তাগুলো স্বভাবতই আপনার মধ্যে আসতে পারে, কিন্তু দুশ্চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় দিলে, তা আপনাকে কোনোভাবে সহায়তা করবে না বা কোনো উপকারেও আসবে না।

এজন্য প্রথমত ভাবা দরকার, রকম পরিস্থিতিতে আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণে কী আছে? আপনি গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, যে বিষয়টা আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটা হচ্ছে আপনার আচরণ, অর্থাৎ আপনি নিজে যা করতে পারবেন, সেটা করা।

দ্বিতীয়ত, মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। কারণ এই সংকটের সময় আপনি নানান চিন্তা, শঙ্কা এবং বিবিধ মিশ্রিত আবেগের মুখোমুখি হবেন। এগুলো আমাদের মনের মধ্যে নানা রকম ঝড় তুলবে। যখন ঝড় আসে তখন নৌকা বন্দরে নোঙর ফেলে, এই নোঙর কিন্তু ঝড়কে থামায় না, বরং এটা নৌকাকে মাঝ সমুদ্রে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। নিম্নের তিনটি ধাপে নিজেকে নোঙর ফেলে মনকে কিছুটা স্থিতিতে আনতে সাহায্য করবে।

প্রথম ধাপ হচ্ছে যখন আপনার মনে কষ্ট হচ্ছে তখন সেগুলোকে দমানোর চেষ্টা না করে সেগুলো মেনে নিন।

দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে নিজের মনের সঙ্গে শরীরের সংযোগ স্থাপন করুন এবং আপনার মনকে ফিরিয়ে আনুন আপনার শরীরে। নিম্নের অনুশীলনগুলো করার চেষ্টা করুন:

ধীরে ধীরে আপনার পায়ের পাতাকে হালকাভাবে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরুন।

ধীরে ধীরে আপনার শিরদাঁড়াকে সোজা করুন। চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন।

. ধীরে ধীরে আপনার দুহাতের আঙুলের ডগাগুলোকে একে অন্যের বিপরীতে হালকাভাবে চেপে ধরুন।

ধীরে ধীরে আপনার দুটো হাতকে আড়মোড়া করে প্রসারিত করুন। আপনার ঘাড়কে আস্তে আস্তে পেছনের দিকে সংকুচিত করুন।

. আপনার নিঃশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ না করে তার দিকে আপনার মনোযোগকে ফিরিয়ে আনুন।

এই সময়ে আপনি কিন্তু আপনার মনের ভেতরের চিন্তা আর আবেগ থেকে পালাতে চাচ্ছেন না। মন শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে আপনি চলে যাবেন পরবর্তী ধাপে।

এই তিনটি ধাপের সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে, আপনি যে কাজটি করছেন, সেদিকে মনোনিবেশ করা। আপনার কাজের বা আচরণের প্রতি সংকল্পবদ্ধ হওয়া। মনে রাখবেন এই কাজগুলো অবশ্যই পরিচালিত হতে হবে আপনার মূল্যবোধ নীতি দ্বারা।

সংকটের সময় আপনি কী ধরনের মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে চান? ছয় মাস-এক বছর পরে যখন আপনি পেছনের দিকে তাকাবেন তখন যেন আপনি নিজের ব্যাপারে গর্ব বোধ করতে পারেন। যেমন বিচলিত কাউকে ফোনে কিংবা ক্ষুদে বার্তায় সান্ত্বনা দিতে পারেন। বাসার কোনো কাজে কাউকে সহায়তা করতে পারেন, রান্না করতে বা শিশুদের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করতে পারেন। নিজেকে সুস্থ রাখতে ব্যায়াম করতে পারেন, আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য অর্থবহুল যেকোনো কাজ করতে পারেন। বারবার প্রশ্ন করুনআমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য বা অন্যদের জন্য আমি কী করতে পারি?’ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন এই সময় ছোট একটা পদক্ষেপই অনেক বড় এবং ভালো প্রভাব ফেলতে পারে।

এটা মনে রাখা জরুরি যে নিজের প্রতি দয়াশীলও হতে হবে, বিশেষ করে আপনি যদি সেবামূলক কোনো পেশায় জড়িত থাকেন অথবা কারো সেবা প্রদানে সরাসরি যুক্ত থাকেন। বিমানে জরুরি অবস্থানকালে সবসময় উপদেশ দেয়া হয় অন্যকে সাহায্য করার আগে নিজে অক্সিজেন মাস্ক পরে নিতে। কারণ আপনি যদি না বাঁচেন তাহলে অন্যকে সাহায্য করার প্রশ্নটাই অবান্তর। সুতরাং নিজের প্রতি দয়াশীল যত্নশীল হওয়াটা এই অক্সিজেন মাস্ক পরার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আপনার চারপাশে দেখুন কী সম্পদ আছে? আপনার বন্ধুবান্ধব, পরিবার, আপনার চিকিৎসক, জরুরি স্বাস্থ্যকর্মী তারা সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। জেনে রাখুন দরকার হলে কীভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। কীভাবে আপনি মানসিক সাহায্য পেতে পারেন। আপনার পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। আর আপনি যদি কাউকে সহায়তা করতে পারেন, তাহলে সেটাও তাদের জানিয়ে রাখুন। এই সংকটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব গুজব বা অসত্য খবর আসছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে যান, যেখান থেকে নির্ভরযোগ্য খবরটা পাওয়া যাবে।

সর্বশেষ যেটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন আপনাদের সবারই জানা তা হলো জীবাণুকে নাশ করা। ২০ সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে সাবান দিয়ে হালকা গরম পানি দিয়ে হাত ধোয়া, নিজেকে ঘরে রাখা, আপনার ঘরে থাকে না, এমন কারোর সঙ্গে মেলামেশা মুহূর্তে বন্ধ করা। যদি কোনো কারণে বাড়ির বাইরে যেতে হয়, তাহলে অন্যের সঙ্গে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা।

আশা করি ওপরের পদক্ষেপগুলো আপনার শরীর মনের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উপকারে আসবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানডেভরেসোন্যান্স’, দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি অনলাইন জরিপ করছে। (https://docs.google.com/forms/d/e/1FAIpQLSeKjKlpr3aoe_8us4PxbuKPRF8IZXIEexI8VaX4zK67b6IlUQ/viewform)

আপনারা লিংক ব্যবহার করে আগামী জুন ২০২০ তারিখ পর্যন্ত, জরিপে অংশ নিতে পারেন বা উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।

 ডা. তাঈম পাঠান: যুক্তরাজ্যে কর্মরত কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এবং পরামর্শক, ডেভরেসোন্যান্স, বাংলাদেশ।

-মেইল: [email protected],

[email protected]

 [ লেখার মূল উৎস নেয়া হয়েছে অ্যাকসেপটেন্স অ্যান্ড কমিটমেন্ট থেরাপি অর্থাৎ মেনে নেয়া এবং নিজেকে নিয়োজিত করা নামক মনোরোগ চিকিৎসা থেকে]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন