ঢাকা গাজীপুর নারায়ণগঞ্জের শ্রমঘন শিল্পাঞ্চল

করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে নাজুক আবাসন

জেসমিন মলি

স্বল্প পরিসরের জায়গায় ছোট ছোট টিনশেড ঘর। নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। খুপরির মতো এক একটি কক্ষে গাদাগাদি করে চার-পাঁচজনের বাস। কয়েকটি পরিবার মিলে ব্যবহার করে একটি টয়লেট। রান্নাঘর গোসলখানাও শেয়ার করতে হয়। এমন অস্বাস্থ্যকার পরিবেশে বাস করেন দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা। নাজুক আবাসন ব্যবস্থা বাড়িয়ে তুলেছে শ্রমিকদের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি।

সারা দেশের যত শ্রমঘন শিল্প-কারখানা রয়েছে তার একটি বড় অংশই ঢাকা, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এসব অঞ্চলে শ্রমঘন শিল্প বিশেষ করে পোশাক কারখানার মতো শিল্প গড়ে তুললেও সেখানে কর্মরত শ্রমিকের আবাসনের বিষয়টি নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না উদ্যোক্তাদের। ফলে নিম্ন আয়ের এসব শ্রমিকের ঠাঁই হয় স্থানীয়দের গড়ে তোলা ঘিঞ্জি পরিবেশের টিনশেড ঘরে। এসব বসতিতে নেই জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগ।

পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সম্প্রতি তাদের এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, ঢাকা আশপাশের অতিঘন শিল্প এলাকাগুলোয় কর্মরতদের আবাসন ব্যবস্থার যে নাজুক অবস্থা তা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ . আদিল মুহাম্মদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জএই তিন জেলায় সবচেয়ে বেশি শিল্পায়ন হয়েছে। এসব শিল্পে যারা কাজ করবেন তাদের জন্য যে ধরনের পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল সেটি গড়ে তোলা হয়নি। ফলে স্থানীয়দের ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা ঘরে বাস করতে হয় শ্রমিকদের। এসব আবাসনের বেশির ভাগের অবস্থা খুবই খারাপ। খুবই নিম্নমানের এসব আবাসনে একত্রে অনেকে থাকছেন, পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। কারণে এসব বসতিতে কেউ একজন সংক্রমিত হলে তা সহজেই অন্যদের সংক্রমিত করে ফেলছে।

শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে যদি কর্মীদের আবাসনে মনোযোগ দেয়া হতো, তাহলে এখানে কর্মরতদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিছুটা হলেও কম হতো জানিয়ে পরিকল্পনাবিদ বলেন, এসব জেলা   আশপাশের এলাকায় অতিঘন শিল্পায়ন হওয়ায় করোনার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। সামনের দিনে আমাদের শিল্পায়নের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন এবং শহরের জনসংখ্যা এবং ঘনত্ব নিয়ে পুনর্ভাবনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে শহর এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদের মানসম্মত  আবাসন পরিকল্পনা করা দরকার। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আবাসিক ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধনও করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম হটস্পট ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর। সারা বাংলাদেশে যতজন করোনা সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি ঢাকা শহরের। এখানে ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ করোনা সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার পর নারায়ণগঞ্জ গাজীপুরে সংক্রমণ বেশি।

আবাসন সংকটসহ অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে বাস করেন এই তিন জেলার কয়েক লাখ পোশাক শ্রমিক। নাজুক পরিবেশে বাস করলেও তাদের বেতনের অংশই ঘর ভাড়ার পেছনে ব্যয় করতে হয় বলে জানান শ্রমিকরা।

আবাসন খাতসহ শহর পরিকল্পনায় যুক্তরা বলছেন, আমাদের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে সাজানোর পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিকল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার। সে সঙ্গে উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণও প্রয়োজন। পাশাপাশি আঞ্চলিক মেগা প্রকল্প গ্রহণে প্রকল্পের আর্থসামাজিক এবং কৃষি, পরিবেশ প্রভৃতির ওপর সামষ্টিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা উচিত।

বিষয়ে বিআইপি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, করোনা-উত্তর নগর-পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্য পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে মানবিক শহর সমাজ গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর গড়ে তুলতে এবং সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা সামাজিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে মৌলিক পরিকল্পনার বিষয়গুলোর ওপরও জোর দিতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্প প্রণয়নে কমিউনিটির অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে মানবিক শহর নির্মাণ করা এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে শহরকে সাজানো প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত, কভিড-১৯ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য শিল্প ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখাবিষয়ক এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠকে শিল্পাঞ্চল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ গাজীপুরকে তিনটি জোন হিসেবে আলাদা করে গড়ে তোলার কথা জানানো হয়। এসব এলাকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত বন্ধ করার কথাও সভায় জানানো হয়। সে বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক পোশাক শিল্পের জন্য তারা নিজেরা একটি হেলথ গাইডলাইন তৈরি করেছেন বলে জানান।  তিনি আরো জানান, গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য তিনটি হাসপাতালে ৫০০ বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ওই বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। চলতি বছরের মার্চ মাস  থেকে  পর্যন্ত প্রায় লাখ প্রবাসী দেশে আসেন। তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। তাদের ব্যবস্থাপনার জন্য জেলা, উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যন্ত ১১০টি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে।  অবস্থার মধ্যেও দেশ জাতীর স্বার্থে কারখানা চালু করা হয়েছে। তবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের কাজ করতে হবে। আমাদের শিল্প কারখানাগুলো খোলা এবং মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষায় গার্মেন্টসকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন