একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান

বদরুল আলম

তৈরি পোশাক খাতের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জেসি পেনি। লোকসানের ভারে দেউলিয়াত্বের পথে থাকা প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। শুধু জেসি পেনি নয়, বিশ্বের বড় বড় অনেক ব্র্যান্ডও নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুই বছর ধরে একের এক বন্ধ হচ্ছে আউটলেট। সম্প্রতি কভিড-১৯ বিপর্যয়ে অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎই যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে ক্রেতা ধরে রাখতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই পিক সময়ে বন্ধ কারখানা সচল হতে শুরু করেছে বাংলাদেশে।

পোশাক শিল্প মালিকদের প্রত্যাশা, শিগগিরই করোনাভাইরাস সংকট কেটে যাবে। তখন তাদের তৈরি পণ্যের চাহিদা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে এলেও বৈশ্বিক বাণিজ্য আগের অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। বরং করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

পোশাক খাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার পরিস্থিতি আগে থেকেই খারাপ ছিল। এর মধ্যেই নভেল করোনাভাইরাস নতুন বিপর্যয় নিয়ে আসে। সংক্রমণ ঠেকাতে একে একে লকডাউনে চলে যায় খাতের রফতানি পণ্যের বড় গন্তব্য ইউরোপের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘ সময় লকডাউনে থাকার পর এখন ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছে দেশগুলোর অর্থনীতি। কিন্তু আগে থেকেই নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো কভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবেলা করে এক বছরও টিকে থাকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বাজারবিশ্লেষকরা।

তাদের দাবি, করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ধীরে ধীরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে যাবে। যেহেতু বৈশ্বিক লজিস্টিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। অবস্থায় স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোতে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী হতে পারে ক্রেতা দেশগুলো। এছাড়া পণ্য উৎপাদনে সিউ-বোট, রোবটের মতো প্রযুক্তিগত উন্নয়নগুলোও আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে। সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের রফতানিকারকরা যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবেলা করার কথা ভাবছেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রফতানিকারকরা হয়তো ভাবছেন, সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে, সরবরাহ চেইন ঠিক হয়ে যাবে আর বিপুল পরিমাণ পোশাক রফতানি করবেন রফতানিকারকরা। তারা হয়তো ভাবছেন, ভিয়েতনাম কারখানা খুলে দিয়েছে বা অন্য প্রতিযোগীরা খুলে দিলে তারা ক্রয়াদেশ ধরতে সমস্যায় পড়বেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো চাহিদা যতক্ষণ না পর্যন্ত ঠিক হবে ততক্ষণ এসব ভাবার যৌক্তিক প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে না। আর বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে যারা কাজ করছেন, তারা যদি গতানুগতিক ধারা থেকে সরে অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেন তাহলে আগের কাঠামোতে অনেক কিছুই চলবে না।

বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সিইও আলী আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, এখানে দুটো দিক, একটি হলো এটা ঠিক যে ক্রেতারা একের পর এক ব্যবসায় লোকসান গুনতে শুরু করেছিল। আমাদের এখানে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে হঠা? করেই। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নেতিবাচক হতে পারে। এটাও ঠিক যে সার্বিকভাবে দেখলে বৈসাদৃশ্য আছে। কিন্তু এটাও ঠিক অর্থনীতি সচল করতে একটা জায়গা থেকে শুরু তো করতেই হবে। পশ্চিমারা যেহেতু সচল হতে শুরু করেছে ফলে আমাদেরও ধীরে ধীরে সচল হতে হবে। আবার মহামারীর পরে কিন্তু দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। তার পরও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো শুরু করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা এও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব অবকাঠামো প্রস্তুত করছে। তারা সিউ-বোটের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারে। এমন উৎপাদন ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলতে পারে, যাতে কোনো মানুষের ব্যবহার থাকবে না। পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, বড় মহামারী কেটে যাওয়ার পর বড় ধরনের পরিবর্তনও আসতে শুরু করে। প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সরবরাহ চেইন সবকিছুতে সেই পরিবর্তিত মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায়। স্প্যানিশ ফ্লু থেকে শুরু করে সব বড় মহামারীর পরই নতুন নতুন বিষয় আবির্ভূত হয়েছিল।

কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার বেশ আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক স্থানীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে সমীক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারস (পিডব্লিউসি) ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দেউলিয়া হতে চেয়েছে ব্রাজিলের কিকো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বন-টন, মার্চে সাউদার্ন গ্রোসার্স, এপ্রিলে নাইন ওয়েস্ট ওয়েস্ট, মে মাসে রকপোর্ট, আগস্টে বরুকস্টোন, অক্টোবরে সিয়ার্স নভেম্বরে ডেভিড ব্রাইডাল দেউলিয়া হতে চেয়ে আবেদন করে। আর চলতি বছর দেউলিয়া হতে চাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিউটি ব্র্যান্ডস, ফুল বিউটি ব্র্যান্ডস। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রে জেসি পেনি দেউলিয়া হতে চাইছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাফল্য ধরে রাখতে বড় বাজারগুলোয় তৈরি পোশাক বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ারশোরিং অটোমেশনে বিনিয়োগ করতে হবে। নিয়ারশোরিং হলো বাজারের নিকটবর্তী স্থানে পণ্য উৎপাদন। আর অটোমেশন হলো যান্ত্রিকীকরণ। প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছিল জরিপের ওপর ভিত্তি করে, যে জরিপে অংশ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন বড় কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা।

তাদের মত অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ নিয়ারশোরিংয়ের দিকে ধাবিত হবে পোশাকের বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন।

সরবরাহ চোইন নিয়ে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন হলেও বাংলাদেশের কারখানা মালিকরা পূর্ব প্রেক্ষাপট ভেবে নিয়ে কারখানা খুলতে শুরু করে দিয়েছেন। তাদের মূল লক্ষ্য ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ। যদিও অসমাপ্ত কাজ শেষ করা নতুন কাজ ধরার জন্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খুলছেন বলে দাবি করেছেন তারা।

ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক . সাজ্জাদ জহির বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক ক্রেতা আগের ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করলেও এখন আবার সেগুলো নেবেন বলে সম্মতি দিয়েছেন, ফলে কারখানা সচল হওয়ার একটা যৌক্তিকতা হয়তো আছে। তবে সংক্রমণ রোধে শ্রমিকের মৌলিক সুরক্ষা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তা কারখানায় প্রবেশ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরেও নিশ্চিত করতে হবে। কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্য নজরদারিও নিশ্চিত করতে হবে, এক্ষেত্রে স্বচ্ছতাও রাখতে হবে। একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে কারখানাগুলোয় স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা করা এখন জনস্বাস্থ্য প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টির মিশ্রণ ঘটানোরও প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

কারখানা খোলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এরই মধ্যে পোশাক কারখানার দুই-একজন শ্রমিক করোনা আক্রান্ত হওয়ার তথ্য যেমন আছে, তেমনি একজন শ্রমিক করোনা আক্রান্ত হওয়ায় গতকাল থেকে ঘোড়াশালের ইউএমসি জুট মিল লকডাউন করার ঘটনাও ঘটেছে।

দুদিন ধরে পোশাক খাতের অনেক কারখানা সচল হয়েছে। কিন্তু মালিকদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অল্পসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে ইউনিট চালু করার কথা থাকলেও একসঙ্গে অনেক শ্রমিক দিয়ে কারখানা চালুর তথ্য নিশ্চিত করেছে খোদ বিজিএমইএ, যার পরিপ্রেক্ষিতে সব সদস্যদের উদ্দেশ করে একটি সতর্কতামূলক নোটিসও দিয়েছে সংগঠনটি। সেখানে উল্লেখ করা হয়, একটি গ্রুপের কারখানায় একসঙ্গে চার হাজার শ্রমিক ডেকে আনার একপর্যায়ে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ইস্যুতে সেখানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, কিছু কারখানা লকডাউনের মধ্যেও আংশিক সচল ছিল, সেগুলো এখন পূর্ণাঙ্গ সচল। অনেক বড় কারখানাও খোলা হয়েছে স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না করে। পরিবেশে শ্রমিকরা কীভাবে কাজ করছেন তা বিজিএমইএ নেতা, মালিক  ক্রেতাদের কারখানায় উপস্থিত হয়ে দেখা উচিত।

শিল্প পুলিশের হিসাবে গতকাল সোমবার ছয় শিল্প এলাকায় সব খাত মিলিয়ে মোট হাজার ৮২০টি কারখানা সচল ছিল। এর মধ্যে ৯৪৭টি বস্ত্র পোশাক খাতের কারখানা, যার বিজিএমইএ সদস্য ৭১৮টি, বিকেএমইএ সদস্য ১৫৭টি এবং ৭২টি বস্ত্র খাতের বিটিএমএ সদস্য কারখানা। সচল বস্ত্র পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে ৪৭৩টি খোলা হয় গত রোববার, সোমবার খুলেছে আরো ২৮৮টি।

প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর ২৬ এপ্রিল থেকে খুলতে শুরু করেছে শ্রমঘন পোশাক শিল্পের কারখানাগুলো। গ্রামফেরত শ্রমিকদের কাজে ফিরতে নিরুৎসাহিত করা হলেও গতকাল অনেক শ্রমিক কারখানায় যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকার বাইরে থেকে শিল্প এলাকাগুলোতে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হচ্ছে না। আবার ধাপে ধাপে খোলার কথা থাকলেও একযোগে সব এলাকায়ই কারখানা খুলেছেন মালিকরা।

অথচ বিজিএমইএ বিকেএমইএর পরিকল্পনা অনুযায়ী, কারখানা খোলার প্রথম ধাপে আজ আগামীকাল ঢাকা মহানগর এলাকার বিভিন্ন শিল্প-কারখানা খোলার কথা। ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে খুলবে আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই মানিকগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ কাঁচপুর এবং নরসিংদী এলাকার বিভিন্ন শিল্প-কারখানা খোলার পরিকল্পনা ছিল ৩০ এপ্রিল। আগামী মের মধ্যে গাজীপুর ময়মনসিংহ এলাকার শিল্প-কারখানা খোলার কথা। এর বাইরে আজ থেকে নারায়ণগঞ্জ এলাকার নিটিং, ডায়িং কারখানাগুলো খুলে দেয়ার কথা জানিয়েছিল বিকেএমইএ। কিন্তু গত দুদিনে প্রায় সব এলাকায়ই কম-বেশি কারখানা খুলতে শুরু করেছে।

কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকার পরও কারখানা কেন সচল হচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে একটি সমীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে জানিয়েছে বিজিএমইএ। সেই সমীক্ষায় মোট ৫৯৩ কারখানার কাছে সংগঠনটি জানতে চায় ২৬ মার্চ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানার ক্রয়াদেশ সরবরাহ করার পূর্ব নির্ধারিত কোনো সময়সূচি ছিল কিনা। প্রশ্নের উত্তরে ৯৩ শতাংশ জানিয়েছে ছিল আবার মে মাসে কারখানা সচল করার মতো ক্রয়াদেশ আছে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে ৮৭ শতাংশ কারখানা বলেছে ক্রয়াদেশ আছে বাকি ১৩ শতাংশ বলেছে, মে মাসে কারখানা সচল করার মতো ক্রয়াদেশ নেই। ২৬ তারিখে কারখানা খুলতে চাইছেন কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে ৬৫ শতাংশ কারখানা খোলার আগ্রহ জানিয়েছেন।

এদিকে গতকাল এক ভিডিও বার্তায় বিকেএমইএ প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, জীবন-জীবিকার সন্ধানে আমাদের সচল হতে হবে। এলাকাভিত্তিক কারখানা খোলার তথ্য জানিয়ে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব আমরা গ্রহণ করেছি বলেও ভিডিও বার্তায় দাবি করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন