জয়দেবপুর-পার্বতীপুর সেকশন

দেড় দশকেই নষ্ট এক-তৃতীয়াংশ রেললাইন

নিজস্ব প্রতিবেদক

রেললাইনের কাঠের স্লিপারগুলো জরাজীর্ণ। কোনোটিতে ধরেছে পচন, আবার পচে একাংশ ভেঙে গেছে কোনোটির। ঢিলে-ঢালা নাটবোল্ট, কোথাও সেগুলোও নেই। রয়েছে পাথরের ঘাটতি। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ জয়দেবপুর-পার্বতীপুর সেকশনের চিত্র এটি। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, ‘সেকশনটির ৩০-৩৫ শতাংশ রেললাইন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে নিরাপদ ট্রেন চলাচল।

বাংলাদেশ রেলওয়ের জয়দেবপুর-পার্বতীপুর সেকশনের দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার। দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে সিরাজগঞ্জের জামতৈল পর্যন্ত অংশটি ব্রড গেজ থেকে ডুয়াল গেজে রূপান্তর করা হয় ২০০৩ সালে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ের স্টেশন ইব্রাহিমাবাদ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত নতুন ডুয়াল গেজ লাইনও একই বছর নির্মাণ শেষ হয়। নির্মাণের দেড় দশকের মধ্যেই সেকশনটির এক-তৃতীয়াংশ রেলপথ ক্ষয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য লাইনটির নিম্নমানের নির্মাণকাজকে দায়ী করছেন তারা।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেল সেকশনগুলোর একটি ঢাকা-জয়দেবপুর। ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-দিনাজপুর-পঞ্চগড়, ঢাকা-যশোর রুটসহ রাজধানীর সঙ্গে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচল করা ট্রেনগুলো লাইনটি ব্যবহার করে। কোনো ট্রেন ব্যবহার করে লাইনটির একাংশ, আবার কোনোটি পুরো লাইনই ব্যবহার করে থাকে। জয়দেবপুর থেকে পার্বতীপুর রেলপথটি বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি প্রধান রেলপথ, যার মাধ্যমে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের সব যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করছে।

সিরাজগঞ্জের জামতৈল রেলস্টেশনের মাস্টার গোলাম হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন ১৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করছে। এর মধ্যে লোকাল রাজশাহী এক্সপ্রেস, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনসহ সবগুলোই আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন। লালমনি এক্সপ্রেস, পদ্মা, ধূমকেতু, সিল্কসিটি, চিত্রা, সুন্দরবন, দ্রুতযান, বনলতা, নীলসাগর, রংপুর এক্সপ্রেস, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, একতা, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস নামে ট্রেনগুলো আপ ও ডাউনে প্রতিদিন চলাচল করছে এ পথে।

রেলওয়ের তথ্য বলছে, জয়দেবপুর-পার্বতীপুর সেকশনটি শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। ১৮৭৪-৭৯ সময়কালে পাকশী (সারাঘাট) থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় মিটার গেজ রেলপথ। অন্যদিকে ১৯১৫-১৬ সময়কালে পাকশী (সারাঘাট) থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হয়। ১৯২৪-২৬ সালের মধ্যে মিটার গেজ লাইনকে ব্রড গেজে রূপান্তর করে ব্রিটিশরা। ১৯৯৮ সালে সিরাজগঞ্জের জামতৈল থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় রেলপথ। একই বছর বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হলে প্রথমবারের মতো দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়। ২০০৩ সালে জয়দেবপুর-পার্বতীপুর সেকশনটি ব্রড গেজ থেকে ডুয়াল গেজে রূপান্তর করা হয়। এরপর আর বড় ধরনের কোনো সংস্কারকাজ হয়নি।

রেলপথটি সংস্কারের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে। গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছেজয়দেবপুর  থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ডুয়াল গেজ রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ শীর্ষক প্রকল্পটিরপ্রকল্প পরীক্ষণ কমিটির সভা। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান।

সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৩৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-পার্বতীপুর রেলপথটির ৩০-৩৫ শতাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্রতিনিয়ত ভেঙে যাচ্ছে। এ কারণে নিরাপদ ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া সেকশনটির ২৫-২৫ শতাংশ স্লিপার নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যালাস্টের (পাথর) ঘাটতিও রয়েছে। নিরাপদ ও সেকশনাল গতিতে ট্রেন চলাচলের জন্য রেলপথটির স্লিপার বদলানো, ব্যালাস্টিং, টেম্পিং ও ডিপ স্ক্রিনিং করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সভার কার্যপত্রে। লাইনটি সংস্কারের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পটি আরো যাচাই-বাছাই ও নতুন করে বিস্তারিত সমীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা। সমীক্ষায় কোথায় কী পরিমাণ রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে বলা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশের রেলওয়ের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের প্রকল্প পরিচালক আতিকুর রহমান। জয়দেবপুর-পার্বতীপুর সেকশনটির জীর্ণ দশার বিষয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেলপথটি মাত্র দেড় দশকে এত খারাপ অবস্থায় যাওয়ার কথা না। নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে এমনটি হতে পারে। আমি নিজেও গত কয়েক দিন একাধিকবার রেলপথটি পরিদর্শন করেছি। লাইনটির কোনো কোনো অংশ একেবারেই খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। এ ভাঙাচোরা লাইনে আবার নতুন নতুন ট্রেন চালানো হচ্ছে। এটি ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন তিনি।

বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, রেলওয়ের অনেক অবকাঠামোগত দুর্বলতা আছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবেই আজকের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় বসে নেই। দেশের সব রেললাইনকে পর্যায়ক্রমে ডাবল লাইনে উন্নীত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন