সিল্করুট

গুরু তিলোপা, শিষ্য নারোপা

এস এম রশিদ

ক্রিস বানিগানের স্কেচে তিলোপা ছবি: সাম্বালা

তিলোপা জন্মেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি দশম শতাব্দীর একজন মহাসিদ্ধ। কাছাকাছি সময়ের অনেক সিদ্ধাচার্যের জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদে। এর মধ্যে আছেন জালন্ধরীপাদ (চট্টগ্রাম), ধর্মপাদ (বিক্রমপুর), বিরুপাপাদ (কুমিল্লা), ডোম্বীপাদ (কুমিল্লা), চাটিলপাদ (চট্টগ্রাম), তিলোপাদ (চট্টগ্রাম), নারোপাদ (চট্টগ্রাম), গোরক্ষপাদ (কুমিল্লা), চৌরঙ্গীপাদ (কুমিল্লা), মীননাথ (বরিশাল)। কুমিল্লার শালবন বিহারকে স্থানীয়ভাবে হাড়িপা সিদ্ধার বাড়ি নামে ডাকা হয়। অনেকে বলেন গোরক্ষ সিদ্ধার বাড়ি, আবার কেউ বলে চৌরঙ্গী সিদ্ধার বাড়ি। এ সিদ্ধাচার্যরাই বাংলাদেশে অবস্থিত সোমপুর, শালবন, বিক্রমপুর বিহারে পণ্ডিত হিসেবে জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত ছিলেন বলে জানা যায়।

বর্তমান লেখায় আমাদের মনোযোগ থাকবে চট্টগ্রামের দুই বিশিষ্ট সিদ্ধার ওপর। একজন তিলোপা ও তার শিষ্য নারোপা। গুরু তিলোপা তার দর্শনের ছাত্র হিসেবে নারোপাকে গ্রহণ করেন। তিলোপার মতো নারোপাও ছিলেন উচ্চ বংশীয় ঘরের সন্তান। ধারণা করা হয় তার মূল নাম ছিল সামন্তভদ্র বা অভয়াকৃতি। স্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতায় সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নারোপা নেমে পড়েন ধর্ম সাধনার পথে। কৈশোরে যেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছিলেন সেখানেই ফিরে যান। কিন্তু সেখানে তার মন বসছিল না, সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তখন চলে যান নালন্দা বিহারে। এখানে তিনি নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। নালন্দায় তার জ্ঞান, প্রজ্ঞার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এখানে তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেন। কিংবদন্তি অনুসারে এ সময়েই তার জীবনে ঘটে বাঁক বদলে দেয়া এক ঘটনা। তিনি সন্ধান পান গুরু তিলোপার। কিংবদন্তি অনুসারে নারোপার সাক্ষাৎ ঘটে একজন ডাকিনী বা নারী সিদ্ধির সঙ্গে। তিনি নারোপাকে জাগতিক বিষয়াদি থেকে মুক্ত হয়ে ধ্যানের ওপর গুরুত্ব দিতে বলেন। এবার নির্বাণ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা পেয়ে বসে নারোপাকে। তিনি রওনা হন তিলোপার খোঁজে। ততদিনে মহাসিদ্ধ হিসেবে তিলোপার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।  

এমন একজন ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত একটি শব্দ যিনি পরিপূর্ণতার সিদ্ধি আত্মস্থ ও প্রসার করেন। এরা হলেন এমন একধরনের যোগিন/যোগিনী যারা বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে স্বীকৃত। মহাসিদ্ধরা তন্ত্রের অনুশীলনকারী বা তান্ত্রিক ছিলেন, যাদের গুরু বা তান্ত্রিক শিক্ষক হওয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা ছিল। এই সিদ্ধ হলেন একজন ব্যক্তি, যিনি সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশ ও হিমালয়জুড়ে তাদের ঐতিহাসিক প্রভাব বিপুল ছিল এবং তারা পৌরাণিক পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন, যা তাদের চর্যাগীতি ও সাহিত্যে বা নামধর্মী গানে সংমিশ্রিত, যেগুলোর বেশির ভাগই তিব্বতি বৌদ্ধ নীতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। মহাসিদ্ধরা বজ্রযান ঐতিহ্যের এবং ডজগেন ও মহামুদ্রার মতো বংশসূত্রের প্রতিষ্ঠাতা।

মহাসিদ্ধ হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি পরিপূর্ণতার সিদ্ধি আত্মস্থ ও প্রচার করে থাকেন। তিলোপার সঙ্গে সাক্ষাতের পর নারোপা তাকে চিনতে পারেননি। তখন তাকে ১২টি কঠিন ও ১২টি তুলনামূলক সহজ কাজ দেয়া হয়। নারোপা তার অধ্যবসায় ও একাগ্রতার কারণে প্রতিটা ধাপই অতিক্রম করেন। গুরুর দেয়া সব শিক্ষাই তিনি রপ্ত করেন সফলভাবে। পরবর্তী সময়ে তিনি তার সেই শিক্ষা প্রচার করেন শিষ্যদের মাঝে। তার একজন শিষ্য ছিলেন মরোপা নামে। মরোপার হাত ধরে সেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয় তিব্বতে। মরোপা নারোপার কাছে থেকে বৌদ্ধ ধর্মের সব সূত্র শিক্ষালাভ করেন, সক্ষম হন মোক্ষ লাভ করতে। তার শিক্ষা সমাপ্ত হলে মরোপার শিক্ষক তাকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে তিব্বতে পাঠান। মরোপা মহাসিদ্ধ হিসেবে সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মরোপা সেখানে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের কাগউ ধারার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।  

নারোপা জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রিয় পরিবারে। সতেরো বছর বয়সে পিতা-মাতার ইচ্ছায় বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের আট বছর পরে তিনি ঘোষণা দেন সংসার ত্যাগের। পরবর্তী সময়ে তিনি বেছে নেন তিলোপার রাস্তা। তবে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের আগে দীর্ঘদিন বিভিন্ন শাস্ত্র পাঠ করেছেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে অর্জন করেছেন স্পষ্ট ধারণা। একদিকে পড়াশোনা করেছেন বিনয়, সূত্র ও অভিধর্ম; অন্যদিকে ছিল মহাযান ধারার প্রজ্ঞাপারমিতা ও বিভিন্ন তন্ত্র। ক্রমে তিনি তার ধর্মীয় জীবনের শীর্ষে উন্নীত হন। পরিণত হন নালন্দার পণ্ডিত হিসেবে। তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিক। নালন্দায় থাকার সময়েই তিনি অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। সেই সূত্র ধরেই তিনি খুঁজতে থাকেন তিলোপাকে। একপর্যায়ে দেখা হয় তিলোপার সঙ্গে। কালো গড়নের লালচে চোখের মানুষ তিলোপা। তাকে দেখেই ঘোষণা দিল, সে মূলত আগে থেকেই নারোপার সঙ্গে ছিল। কেবল নারোপার না দেখার কারণেই এত সময় লেগেছে তার। তারপর তিনি নারোপাকে যোগ্য পাত্র বিবেচনা করলেন। শিক্ষা দিতে রাজি হলেন তার অর্জিত জ্ঞান। গ্রহণ করলেন নারোপাকে শিষ্য হিসেবে। 

পরবর্তী ১২ বছর নারোপা তিলোপার শিষ্য হিসেবে থাকেন। এ সময়ে তিনি সব ধরনের মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। তার শিক্ষাপদ্ধতি ছিল সরাসরি। তিলোপার প্রতিটি শিক্ষাই ছিল নারোপার প্রচলিত ধারণার বিপরীত। তার ব্যক্তিগত পরিচয়কে ছোট করে এমন। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তিলোপা বুঝিয়ে দিলেন নারোপার সত্যিকার সত্তাকে। নারোপার সামনে যেন স্পষ্ট হতে থাকল তারই সত্যিকার অস্তিত্ব। দূর হলো এতদিনের মিথ্যা ও আনুষ্ঠানিক জ্ঞানের অহম। তিলোপা খুব কম কথা বলতেন। শিক্ষাও চলত অনেকটা বাক্যহীন যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে। কোনো নিশ্চয়তা বা অনিশ্চয়তা নিয়ে কথা বলতেন না তিলোপা। তার পরও নারোপা সক্ষম ছিলেন তিলোপার অব্যক্ত ভাষা বুঝে নেয়ার ক্ষেত্রে। যেন তিলোপার একনিষ্ঠ অনুসরণ ছাড়া তার কাছে আর কোনো পথ ছিল না। এভাবে ১২ বছরের প্রশিক্ষণ শেষে তিলোপা নারোপাকে নিয়ে একটা উন্মুক্ত বন্ধ্যা মাঠে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে নারোপা ওস্তাদের কাছে থেকে সত্য প্রত্যক্ষ করলেন। সেদিন থেকেই নারোপা যোগীকুলের শ্রেষ্ঠ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। নারোপা তার ফেলে আসা জীবনকে শিশুর মতো দেখতে লাগলেন। তিনি নিজেই পরিণত হলেন একজন মহাসিদ্ধ ওস্তাদ হিসেবে। তিনি তার শিষ্যদের শিক্ষা দিতে লাগলেন বুদ্ধের দর্শন। যেহেতু তিনি শাস্ত্রের দিক থেকেই ছিলেন পণ্ডিত, বজ্রযান ধারার ওপর লেখালেখি করেছেন দীর্ঘ। তার সেই লেখনী এখনো টিকে আছে তেনজোরে। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের কাগউ ধারার প্রচার ও প্রসারে নারোপা এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তার মধ্য দিয়েই ওস্তাদ তিলোপার গভীর শিক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা থেকে তিব্বতে।

এস এম রশিদ: লেখক