সিল্করুট

প্রত্নতত্ত্বের দৃষ্টিতে বেহুলার বাসরঘর

মাহমুদুর রহমান

কথিত বেহুলার বাসরঘর ছবি: নাজমুল হুদা/ উইকিমিডিয়া কমনস

বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বেহুলার বাসরঘর। লোককথা অনুসারে এখানেই ছিল বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর। সেখানে সাপে কেটেছিল লখিন্দরকে। কিন্তু মনসামঙ্গল যে অঞ্চলের কথা বলে তার সঙ্গে বগুড়ার সাদৃশ্য কষ্টকল্পনার। তাই প্রশ্ন জাগে, আদতেই এখানে বেহুলার বাসরঘর থাকা সম্ভব কিনা।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নস্থান মহাস্থানগড়। আর সেখানেই বেহুলার বাসরঘর। কিন্তু এর যে গঠন ও গড়ন তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় বৌদ্ধ যুগের স্থাপনার। সেসব কারণে অনেকে মনে করেন সম্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেন। কিন্তু মৌর্য যুগের স্থাপনা এটি নয় এমন মতও আছে। ১৯৩৪-৩৬ সালে মহাস্থানগড় এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের তত্ত্বাবধানে খননকার্য পরিচালিত হয়। দেখা যায় অনেকখানি জায়গাজুড়ে এতে ১৭২টি কুঠুরি রয়েছে। গোকুল গ্রামে অবস্থানের কারণে এর নাম গোকুল মেধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী।

কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা কী বলছেন? তাদের মতে, এটি বৌদ্ধ স্তূপের সঙ্গে মিলে যায়। ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বৌদ্ধ স্থাপনার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। কেবল গঠন না, প্রত্নতাত্ত্বিকরা গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে পাওয়া নানা টেরাকোটার প্রতিও। ননীগোপাল মজুমদারের অধীনে হওয়া এ খননকার্যে বেশকিছু টেরাকোটা পাওয়া যায়। টেরাকোটাগুলো ছিল গুপ্ত যুগের।

গুপ্ত যুগের সময় ৩২০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ। এর মধ্যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় পুরো ভারতবর্ষই প্রায় তাদের অধীনে চলে আসে। একে অনেকে ভারতের স্বর্ণযুগও বলে থাকেন। গোকুল মেধে পাওয়া টেরাকোটাগুলো গুপ্ত যুগের শেষ পর্যায়ের। সে কারণে সহজেই ধরে নেয়া যায় গোকুল মেধ ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি। তাহলে মৌর্য আমলে বা অশোকের সময়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ থেকে ১৯৪০ সালে প্রকাশিত বাংলার ভ্রমণ বইয়ে পাই, ‘মহাস্থান হইতে ৪ মাইল পশ্চিমে বিহার নামে গ্রামে ও পার্শ্বেই ভাসোয়া বিহার যা ভাসুবিহার গ্রামে পুরাতন বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। সপ্তম শতাব্দীতে য়ুয়ান চোয়াং যখন পুণ্ড্রবর্ধনে আগমন করেন, তখন এই স্থানে তিনি একটি গগনস্পর্শী চূড়াসমন্বিত বৌদ্ধবিহার দেখিয়াছিলেন। তিনি ইহাকে পো-শি-পো বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। এই সঙ্ঘারামে মহাযান সম্প্রদায়ের ৭০০ ভিক্ষু ও বহু বিখ্যাত শ্রমণ অবস্থান করিতেন।’

গোকুল মেধ নিয়ে বলা হচ্ছে, ‘মহাস্থানের অতি নিকটে দক্ষিণ দিকে গোকুল নামক গ্রাম অবস্থিত। এখানেও একটি প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা ‘গোকুলের মেঢ়’ নামে পরিচিত। স্তূপটি চতুর্বিংশতি কোণবিশিষ্ট ও মৃত্তিকা হইতে ইহার ভিত্তির উচ্চতা প্রায় এক ফুট। এই স্থান খনন করিয়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রায় ১৭০টি কক্ষ আবিষ্কার করিয়াছেন। পরস্পরের গাত্র-সংলগ্ন এই কক্ষগুলিকে মৌমাছির চাকের খোপের মত দেখায়। স্তূপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ৪২ ফুট বিস্তৃত ও প্রায় ২৫ ফুট উচ্চ সোপান শ্রেণী বাহির হইয়াছে। এই স্তূপটিও একটি বৌদ্ধ দেবায়তন ছিল বলিয়া অনুমিত হয়। ইহার প্রাচীর গাত্রে টালির উপর মানুষ, জীবজন্তু, লতাপাতা প্রভৃতির চিত্র উৎকীর্ণ আছে। ইহার শিল্প পদ্ধতি দেখিয়া প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেন যে আনুমানিক ঘষ্ঠ অথবা সপ্তম শতাব্দীতে গুপ্তযুগে এই মন্দিরটি নির্ম্মিত হইয়াছিল।’

অর্থাৎ, বলা হচ্ছে বেহুলা-লখিন্দরের গল্প তৈরি হওয়ার আগেই এ স্তূপ তৈরি হয়। তবে এর সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু বিষয়। গোকুল গ্রামের আশপাশে আরো কিছু গ্রামের নাম, কালীদহ নদী ইত্যাদির কারণে চাঁদ সওদাগর, মনসার গল্প এর সঙ্গে জুড়ে যায়। এছাড়া এ স্থান থেকে মনসার মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেসব যে মনসারই মূর্তি তা নিয়ে সবার মত এক নয়। কেননা সর্প পূজা অনেক পুরনো প্রথা। মনসামঙ্গলের সঙ্গে গোকুল গ্রাম যুক্ত হওয়া তার জন্য জরুরি না।

এদিকে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের যৌথ গবেষণায় গত শতাব্দীর শেষের দিকে মহাস্থানগড়ে আবার খনন হয়। মো. শফিকুল আলম ও জঁ ফ্রান্সিস স্যালেসের গবেষণাপত্র বলে, গোকুল মেধের কাছাকাছি কিছু অঞ্চল মূলত পাল আমলে তৈরি। তারা লিখেছেন, ‘The region immediately around Gokul Medh is surrounded by the vestiges of mounds with structural remains and numerous artificial ponds (tanks). 29 Two other very large mounds to the southwest of Mahasthangarh illustrate a similar pattern of a large structure accompanied by habitation mounds and artificial ponds. One is the site of Godai Bari, located 1.5 kilometers west of the southwest corner of the Mahasthangarh fortifications. This site, excavated by the Directorate of Archaeology in 1998, consists of a complex of solidly-packed brick structures and walls; the combined effect of these constructions is a steep-sided mound in which the long axis runs east-west.’

পাল সাম্রাজ্যের সময় ৭৫০-১১৬১ খ্রিস্টাব্দ। সে সময় এ স্থাপনাগুলো তৈরি হয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। হতেও পারে এ সময়ে স্থাপনাগুলোর সংস্কার হয়েছিল। যেহেতেু বিদেশী পর্যটক আগেই তার ভ্রমণ কাহিনীতে লিখে গেছেন মহাস্থানগড় ও আশপাশের কথা, বোঝাই যায় তা কবে তৈরি হয়েছিল। এরপর তার আরো সংস্কার হয়। তবে পাহাড়পুরসহ গোকুল মেধে পাল আমলের ছাপ আছে তা স্পষ্টই উল্লেখ করা হয়েছে।

গবেষকদ্বয় লিখেছেন, ‘Throughout the western portion of greater Bengal, the Pala period was one of growth and prosperity, as indicated by the Pala endowments of religious monasteries (such as Paharpur) and civic improvements (such as the large artificial pond at Dhibor in western Bangladesh). At Mahasthangarh, this period of prosperity was manifested in development of a complex urban hinterland with a distinct division into different zones: to the northwest, a religious area with monasteries, and to the south, a zone of semi-autonomous communities such as the one around Gokul Medh.’

তাহলে কেন ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতাব্দীর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হলো এ স্থাপনা? লোককথার সঙ্গে বাস্তবতা অনেক সময়ই জুড়ে যায়। গোকুল মেধের সঙ্গে বেহুলা-লখিন্দর কেমন করে যুক্ত হলো সেটির ব্যাখ্যা রয়েছে এ সংখ্যার অন্যান্য লেখায়।

মাহমুদুর রহমান: লেখক ও সাংবাদিক