সিল্করুট

বাংলার কাব্যগাথা মনসামঙ্গল

ফারিহা আজমিন

চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের আঁকা মনসা ছবি: এমএপি একাডেমি

বাংলার লোককথায় আজও অম্লান বেহুলা ও লখিন্দর। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যধারার অন্যতম কাব্য মনসামঙ্গল। তবে এ ধারার প্রধান দুটি কাব্য চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গলকাব্যের তুলনায় মনসামঙ্গল প্রাচীন। পৌরাণিক গল্প কাহিনীর এ কাব্যের অন্যতম চরিত্র বেহুলা ও লখিন্দর। ধারণা করা হয়, বাংলার পুণ্ড্র জনপদ ধরেই ছিল এ দম্পতির বাস। তাই তো বগুড়া জেলার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে লখিন্দরের মেধ বা বেহুলার বাসরঘরের অবস্থান বলে জানা যায়। সেই সঙ্গে বেহুলার বাবা সওদাগর বাছু বেনিয়ার বাড়িও ছিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। এখনো সে জায়গায় তাদের আদি কিছু চিহ্ন রয়েছে। তবে বেহুলা লখিন্দরের বসবাস আদতে বাংলার কোন অংশে ছিল সে সত্যতা মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের বর্ণনা থেকে আরো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। 

কাব্যের আদি কবিদের ধারণামতে, মনসামঙ্গল নামে কাব্যটি পরিচিতি পেয়েছে মূলত পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় বা বিহার অঞ্চলে এবং পূর্ববঙ্গে পদ্মপুরাণ নামেই এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাও পাওয়া গেছে। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে বহু মনসামঙ্গলকাব্য পাওয়া গেছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কাব্যগুলো মনসামঙ্গল ও পূর্ববঙ্গে প্রায়ই পদ্মপুরাণ নামে পরিচিত। ’

এবার মনসামঙ্গলের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসাকে নিয়ে জানা যাক। সাপের দেবী মনসাকে কবে থেকে দেবী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল তা বলা কঠিন। মূলত মনসা অনার্য দেবী। প্রতিটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কল্পকাহিনীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে সর্পসংশ্লেষ। যেমন প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু করে ফিনিশিয়া বা স্ক্যান্ডিনেভিয়া পর্যন্ত একই গল্প। তবে মনসা পূজার প্রচলন ছিল মূলত ভারতের আদিবাসী গোষ্ঠীদের মধ্যে। যা কয়েক হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল। এছাড়া জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায় দেবী মনসার পূজা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পালন করা হতো। জানা গেছে, বর্ষায় সাপের প্রকোপ বেড়ে যেত বলেই সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভক্তরা দেবীর আশ্রয় প্রার্থনা করত। এছাড়া ধন-সম্পদ, সন্তান সন্ততির জন্য সর্পদেবীর ভক্ত তার দ্বারস্থ হয়। বলা হয় মনসা একজন লৌকিক দেবী। 

তবু তার অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে হিন্দু সমাজের সব সম্প্রদায় মনসাকে দেবী হিসেবে মর্যাদা দেয়। কিন্তু আদি পুরাণগুলোয় আবার মনসার উল্লেখ পাওয়া যায় না। অপেক্ষাকৃত নবীন পুরাণ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণে মনসার উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যকর্ম মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত হয়েছে নানা গাথাকাহিনী। এ গ্রন্থগুলো অবশ্য খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর আগে রচিত হয়নি। লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দু সমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে। এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়।

তবে এ কাব্যের পুরো আখ্যান আবর্তিত হয়েছে মনসার নিজ পূজা প্রচারকে কেন্দ্র করে। কাব্যের মূল উপজীব্য চাঁদ সওদাগর মনসাকে পূজা করতে অস্বীকার করা এবং তার পরই দেবী হয়ে ওঠার বাসনা থেকে মনসা তার ওপর নানা অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেছে কাব্য। এ কাব্যে সে সময়ের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা তথ্যবহুল বর্ণনা পাওয়া গেছে। চাঁদ সওদাগর শুধু এ কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ একটি চরিত্র। 

চম্পকনগরের অধীশ্বর ছিলেন বণিক চাঁদ সওদাগর। যিনি জগৎ পিতা শিব দেবতার একনিষ্ঠ ভক্ত। চাঁদ দেবতা শিব থেকেই মহাজ্ঞান লাভ করেছেন। শিবের কন্যাই মনসা। মনসার ইচ্ছা তাকেও মনুষ্যকুল পূজা করবে এবং তার আরাধনায় মগ্ন থাকবে। তবে পিতা শিব জানালেন কেবল দেবতা শিবের একনিষ্ঠ কোনো ভক্তই যদি মনসাকে পূজা করে, তখন থেকেই কেবল বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে মনসা পূজা সম্ভব। মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব অর্জন সম্ভব নয়। তাই মনসা চাঁদের কাছে পূজা চাইলেন। শিবভক্ত অন্য কোনো দেবতাকে পূজা করতে চাঁদ প্রত্যাখ্যান করলেন। যেহেতু চাঁদ কেবল দেবতা শিবকেই ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন, তাই তার অন্য কোনো দেবতার কাছে মাথা নত করার ইচ্ছা ছিল না। 

চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজা না করা থেকেই শুরু হলো উভয়ের দ্বন্দ্ব। মনসা শাপ দিয়েছিল চাঁদকে। সেখান থেকেই চাঁদ সওদাগরের ছয় পুত্রকেই বিয়ের রাতে সর্পদংশন করে এবং তারা মারা যায়। মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব অর্জন সম্ভব নয়। ছয় পুত্রকে সর্পদংশনে হত্যা করার পরও সমুদ্রপথে চাঁদের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়ে চাঁদকে সর্বস্বান্ত করেন মনসা। কোনোক্রমে বেঁচে যায় চাঁদ। 

কিছুদিন এভাবে চাঁদ নানা বিপদের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেন এবং কিছুকাল পর তার আরেক পুত্র লখিন্দরের বিবাহ নির্ধারণ করা হয় উজানীনগরের আরেক সওদাগর বাছু বেনিয়ার কন্যা বেহুলার সঙ্গে। সব সত্য জেনেও বাছু বেনিয়ার মেয়ে বেহুলার সঙ্গে লখিন্দরের বিয়ে ঠিক করে। কিন্তু মনসা এ সময়ে বৃদ্ধাবেশে এসে ছল করে বেহুলাকে অভিশাপ দিয়ে যায় এবং মনসার হাত থেকে রক্ষা পেতেই সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর বানানো হয় বেহুলা ও লখিন্দরের। কিন্তু গোপনে মনসার নির্দেশে একটি ছিদ্র রাখা হলো। ছিদ্রপথে কালনাগিনী ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করল। বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে ভেলায় ভেসে পাড়ি দিল মনসার উদ্দেশে। এর মধ্য দিয়ে ঘটে বিচিত্র সব ঘটনা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে বেহুলা অবশেষে ইন্দ্রের সভায় নাচ দেখিয়ে স্বর্গের দেবতাদের খুশি করেন। চাঁদ ফিরে পান লখিন্দরসহ অন্য সন্তানদের জীবন ও ডুবে যাওয়া নৌকাসহ ধনরত্ন। এ সময়ে বেহুলার সতীত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে অবশেষে চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা দিল। মর্ত্যবাসের মেয়াদ ফুরাতে বেহুলা-লখিন্দর আবার ইন্দ্রসভায় স্থান পেল। এই ছিল মনসামঙ্গলকাব্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। 

এক মনসামঙ্গলকাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের ঘটনা নিয়ে দুই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নানা লোককাহিনী প্রচলিত আছে। এ লোককাহিনীকে কেন্দ্র করেই কানা হরিদত্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, বিজয় গুপ্ত, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ বংশীদাস প্রমুখ মনসামঙ্গল-পদ্মপুরাণসহ নানা কাব্য রচনা করেছেন। আর মনসামঙ্গলকাব্যে যে উজানীনগরের কথা বলা আছে, সেটি কোথায় অবস্থিত এ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা দিতে না পারলেও জনশ্রুতি অনুযায়ী, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাঁস ইউনিয়নের বিনসাড়া গ্রামই সেই উজানীনগর।

ইতিহাস ও লোককাহিনী থেকে জানা যায়, বাছু বেনিয়ার ঘরে এ গ্রামেই জন্ম নেয় বেহুলা সুন্দরী। সময়ের পরিক্রমায় এখন সেখানে বাছু বেনিয়ার ৫২ বিঘা আয়তনের বাড়ির চিহ্ন বলতে এখন আর তেমন কিছুই নেই। তবে বিরান ভিটায় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়েছে মাত্র একটি জিয়নকূপ, যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা আসে। বর্তমানে সেখানেই বিনসাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অনেকে বাড়িঘর তুলে বসতভিটা তৈরি করেছে। তবে বেহুলার জিয়নকূপ, তার স্নান করার পুকুর, ডুবন্ত নৌকার চিহ্ন ছাড়া আর তেমন কিছুই বর্তমানে অবশিষ্ট নেই সেখানে। আশপাশের লোকজন এখনো বিনসাড়া গ্রামের বেহুলার পিতৃভিটার ওই পাড়াকে বেহুলার পাড়া হিসেবে জানে।

এছাড়া মনসামঙ্গলের এ গল্পগাথা যে এ বাংলারই গল্প তার প্রমাণ ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে বগুড়া জেলার গোকুলে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করেও বেহুলার বাসরঘর বা লখিন্দরের মেধের টিকে থাকা।

ফারিহা আজমিন: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা