সিল্করুট

পোড়ামাটির ফলকে সমতটের জনজীবন

খুরশিদ জাহান

লেখায় ব্যবহৃত ছবি: ময়নামতি জাদুঘর

প্রিয় কোনো মুহূর্ত, গুরুত্বপূর্ণ কোনো দৃশ্য বা ঘটনা আমরা ক্যামেরায় ধারণ করে রাখি ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করতে। এভাবে একটি সময়ের দৃশ্য বা ঘটনা ধারণ করে রেখে অন্য সময়েও অবলোকন করতে পারা—ক্যামেরা আবিষ্কারের অনেক আগে এ বাংলার মানুষ মাটির তৈরি শিল্পকর্ম দিয়েই কাজটি করেছে দারুণভাবে। যার বদৌলতে একুশ শতকে বসবাস করেও আমরা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর বাংলার মানুষের জীবনচিত্র দেখার সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু কীভাবে! আপনার জিজ্ঞাসু মনের উত্তর মিলবে প্রাচীন বাংলার পোড়ামাটির ফলকচিত্রে।

এ পোড়ামাটির ফলক বাংলার শিল্পকলার এক অনন্য অবদান। নরম মাটিকে ফলকের আকার দিয়ে তাতে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হওয়ার পর আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হতো পোড়ামাটির ফলক। প্রাচীনকালে বিভিন্ন ইমারত বিশেষ করে মন্দিরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বাংলায় প্রথম কবে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহার শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানা না গেলেও খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম সহস্রাব্দ থেকেই বাংলায় পোড়ামাটির শিল্পকর্মের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। চতুর্থ-ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাংলার চিত্রকলায় পোড়ামাটির ফলক বিশেষ স্থান অধিকার করে নেয়। এ ধারা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতেও অব্যাহত ছিল। বাংলার বেশকিছু প্রত্নস্থলে পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। একদিকে যেমন সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে প্রাচীন বাংলার অন্যতম প্রধান জনপদ সমতটে পাওয়া ফলকগুলো উল্লেখযোগ্য, অন্যদিকে তেমনই বিষয়বস্তুগত দিক থেকেও ফলকগুলোর পরিসর অনেক বিস্তৃত। সমতটে প্রাপ্ত ফলকগুলোয় সেখানকার সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের চিত্রায়ণ করা হয়েছে নিপুণভাবে।

সমতটে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকগুলো থেকে সেখানকার মানুষের দেবতা অপদেবতার প্রতি বিশ্বাসের পরিচয় মেলে। ফলকগুলোয় বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রতিকৃতিই অধিক দেখা যায়। হিউয়েন সাঙের বিবরণসহ অন্যান্য সূত্রেও সমতটে বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তার কথা জানা যায়। আনন্দবিহার, ভোজবিহার, রূপবান মুড়া প্রভৃতি প্রত্নক্ষেত্রে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধ প্রতিমা উৎকীর্ণ ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। মাথার পেছনে প্রভামণ্ডল, মাথায় মুকুট, কানে কুন্তল এবং বাম পাশে পদ্ম প্রতীকসহ আরেক জনপ্রিয় বৌদ্ধ দেবতা পদ্মপানির চিত্রায়ণ উপস্থিত আছে এখানকার ফলকগুলোয়। এছাড়া বজ্রপানি, অষ্টভুজা তারা প্রমুখ বৌদ্ধ দেবদেবীর পাশাপাশি মায়াদেবী/মারুদেবী প্রভৃতি জৈন ধর্মীয় চরিত্রও উৎকীর্ণ রয়েছে কয়েকটি ফলকে। যার ভিত্তিতে সমতটে বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি কিছুমাত্রায় জৈন ধর্মের উপস্থিতিও স্বীকার করা যেতে পারে।

সমতটের পোড়ামাটির ফলকগুলোয় বেশকিছু পৌরাণিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কার্যকলাপকে তুলে ধরা হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত স্বর্গীয় গায়ক গন্ধর্ব কখনো উড়ন্ত, কখনো ঢোল বাজাতে ব্যস্ত বা ডমরু নিয়ে খেলা করা অবস্থায় চিত্রিত হয়েছে। কয়েকটি ফলকে গন্ধর্বের সঙ্গে তার সঙ্গিনী অপ্সরাকেও দেখা যায়। অপ্সরারা নৃত্য ও সংগীতে পটিয়সী। অপ্সরা ও গন্ধর্বের চিত্রায়ণ একই সঙ্গে সমাজে নৃত্য ও সংগীতচর্চার ইঙ্গিত বহন করে। সংগীত ও নৃত্যে পারদর্শী অন্য দুই পৌরাণিক চরিত্র কিন্নরী ও বিদ্যাধরের চিত্রায়ণও সমতটের পোড়ামাটির ফলকগুলোয় লক্ষ করা যায়। এর বাইরে অন্যান্য ফলকে যক্ষ, যম, মকর, কীর্তিমুখের চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সেকালের মানুষের এসব চরিত্রের প্রতি বিশ্বাসের পরিচায়ক।

শরীরের ঊর্ধ্বাংশ নারীর দেহের সদৃশ এবং নিম্নাংশ মাছের লেজবিশিষ্ট কাল্পনিক মৎস্যকুমারী চিত্রায়িত ফলক পাওয়া গেছে রূপবান মুড়া ও শালবন বিহারে। মৎস্যকুমারীর কানে কুন্তল, গলায় মালা, হাতে কঙ্কন, মাথায় খোপা তৎকালীন সমাজে নারীদের ব্যবহার্য অলংকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। নারীরা কেশ সজ্জায় বিশেষ মনোযোগী ছিল। সেকালে সমতটের জনগণ সাজসজ্জায় সচেতন ছিল। নর-নারী উভয়ই নানা রকম অলংকার দিয়ে নিজেদের সজ্জিত করত, ফলকগুলোয় সেটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।

সমতটের অধিবাসীদের মধ্যে ধুতি, শাড়ি ও উত্তরীয় জাতীয় পোশাকের ব্যবহার ছিল প্রধান। অধিকাংশ ফলকে চিত্রায়ণের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যায় পুরুষদের মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ‘কাছা’ পদ্ধতিতে ধুতি পরার জনপ্রিয়তা ছিল। কয়েকটি ফলকে যোদ্ধাদের পায়ে পরিহিত জুতা, প্রাচীন সমতটের মানুষের মাঝে জুতা পরার প্রচলনের ইঙ্গিত দেয়। তারা মাথায় বিভিন্ন আকৃতির টুপির ব্যবহার করত। কিছু ফলকে উত্তরীয় পরার দৃশ্য বর্তমান সময়ে কৃষক ও শ্রমিকদের কাঁধে ঝুলে থাকা গামছার কথা মনে করিয়ে দেয়। মৌসুমি জলবায়ু প্রভাবিত এ অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষকে হঠাৎ বৃষ্টি বা ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর শুকিয়ে নিতে প্রায়ই কাঁধে বা কোমরে গামছাজাতীয় কাপড় বেঁধে রাখতে দেখা যায়।  

তৎকালীন প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের একটি বড় অংশ স্থান পেয়েছে সমতটের মৃৎশিল্পীদের প্রস্তুতকৃত পোড়ামাটির ফলকচিত্রে। কয়েকটি ফলকে বাংলার বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসা হাতির প্রতীকায়ন দেখা যায়। কোনো কোনো ফলকে পিঠে বসার আসনযুক্ত অবস্থায়, কোনোটিতে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে চলা অবস্থায় কিংবা ছুটন্ত অবস্থায় হাতিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। সেকালে যানবাহন ও যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রাণী ঘোড়াকেও মৃৎশিল্পী গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছেন তার ফলকে। বাংলার মানুষের সুপ্রাচীন কাল থেকে এখানকার প্রকৃতি ও পশুপাখির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার চিত্রটিও যেন ধরা পড়েছে পোড়ামাটির ফলকে। তারই প্রমাণ বহন করছে বাঘ ও মানুষের লড়াইয়ের চিত্রসংবলিত ফলক। একই সঙ্গে হরিণ, মহিষ, ময়ূর, সাপ, বেজি, হাঁস, বানর, গাধা, শূকর, ষাঁড় প্রভৃতি প্রাণী এবং পদ্ম, সূর্যমুখী প্রভৃতি ফুলের চিত্রায়ণ তৎকালে এগুলোর উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।

একই সঙ্গে সেই সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দিকও প্রকাশ করে ফলকগুলো। ফলকে মাছের চিত্রায়ণ মাছ শিকার ও মাছের ওপর নির্ভরশীলতার দিকটি উপস্থাপন করছে। গৃহপালিত পশু দিয়ে কৃষিকাজ, ভার বহন করানো, যাতায়াতের কাজ করানো হতো। হাল চাষরত কৃষকের প্রতিকৃতিবিশিষ্ট ফলক সমতটের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিরই পরিচায়ক। কৃষির পাশাপাশি তারা বন্যপশু শিকার করেও জীবিকানির্বাহ করত।

তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যুদ্ধ ছিল নিয়মিত ঘটনা। যাদের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে সমতটের রাজারা শাসন পরিচালনা করছিলেন। পোড়ামাটির ফলকে শিল্পী সে যোদ্ধাদেরও চিত্রায়ণ করেছে নানা ভঙ্গিমায়। সেই সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছে ছোরা, তলোয়ারসহ বিভিন্ন আকৃতির ঢাল ও ধনুকের মতো যুদ্ধাস্ত্র। এসব ফলকে পরিচয় মিলবে তৎকালীন সময়ে মানুষ যুদ্ধ বা আত্মরক্ষায় কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করত। অশ্বারোহী সৈন্যের প্রতিকৃতিবিশিষ্ট ফলক দেখে তাদের সামরিক কৌশল সম্পর্কে জানা যায়। লক্ষ করার বিষয়, একাধিক ফলকে সংগীতের বিভিন্ন যন্ত্র ও নৃত্যের উপস্থিতি জানান দেয় শুধু যুদ্ধবিগ্রহে ভারাক্রান্ত হয়ে নয়, এ সমাজের মানুষ সংগীত, নৃত্য করেও জীবনকে উপভোগ্য করে তুলত। এমনকি গল্প করেও তারা অবসর সময় পার করত, সে দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে ময়নামতির একটি ফলক। মুদ্রার অন্য পিঠে মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশাও সমতটের মৃৎশিল্পীর নজর এড়ায়নি। ফলকেই ফুটিয়ে তুলেছে চিন্তাক্লিষ্ট মুখের অবয়ব। পরিশেষে বলতে চাই পোড়ামাটির ফলকগুলো সমতটের মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামরিকসহ সামগ্রিক জীবনের একটি ধারণা দিতে সক্ষম। পাঠক অনুসন্ধিৎসু চোখ নিয়ে ফলকগুলো পরখ করলে প্রাচীন সমতটের জনজীবনের সে চিত্র দেখতে সক্ষম হতে পারেন।

খুরশিদ জাহান: প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ