সিল্করুট

হিউয়েন সাঙ ও তার সফরনামা

আহমেদ দীন রুমি

আলেকজান্ডার কানিংহামের ম্যাপে হিউয়েন সাঙের পথ ছবি: দ্য অ্যানসিয়েন্ট জিওগ্রাফি অব ইন্ডিয়া, ১৮৭১

ফা-হিয়েন যখন চীন পৌঁছলেন, খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে তখন ৪১২ সাল। স্মৃতিতে তার তখনো অম্লান পেছনে থাকা এক দশকের সফর। সেই যে ৩৯৯ সালে ঘর ছেড়েছিলেন। তারপর রোমাঞ্চকর কেটেছে প্রতিটি দিন। বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তু, বুদ্ধের দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তির স্থান বুদ্ধগয়া; বুদ্ধের প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদানের স্থান সারনাথ এবং নির্বাণ লাভের স্থান কুশীনগর দেখেছেন নিজের চোখে। দেখেছেন মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধরাজ্য, জনজীবন ও নয়নজুড়ানো সব স্থাপনা। লিখে কি আর চোখে দেখার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়! তার পরও বছর দুইয়ের মধ্যে লিখে ফেললেন সফরনামা। সে সফরনামাই দুই শতাব্দী পরে পৌঁছায় তারই মতো চৈনিক এক তরুণের হাতে। তরুণ যেন এ রকম কিছুরই অপেক্ষায় ছিলেন। তার মাথায়ও চেপে বসে পাগলামি। নজিরবিহীন এক প্রচেষ্টাকে বাস্তব রূপ দিতে ছাড়েন ঘর। আজ প্রায় দেড় হাজার বছর পর সে ক্ষেপাটে তরুণ পরিচিত হয়ে আছেন হিউয়েন সাঙ নামে। তার সে প্রচেষ্টা টিকে আছে সপ্তম শতাব্দীর দুনিয়ায় ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি ও দর্শনের অনন্য দলিল হিসেবে।

হিউয়েন সাঙ জন্মগ্রহণ করেন ৬০৩ সালে। তার পূর্বপুরুষ হেনান প্রদেশের চিনলিউতে বসবাস করত দীর্ঘদিন ধরেই। কর্মসূত্রেই যাতায়াত ছিল রাজপ্রাসাদের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। অল্প বয়সেই তিনি মেজ ভাইয়ের সঙ্গে দেশের পূর্ব-রাজধানী লো-আঙে আসেন। ১৩ বছর বয়সে হন সেখানকার মন্দিরের নিবেদিত উপাসক। সুই রাজবংশের পতনকালে যে কঠিন পরিস্থিতির তৈরি হয়, সে সময় তিনি ও তার ভাই শিঙতু শহরের মঠে। সেখানে ২০ বছর বয়সে তিনি দীক্ষিত হন একজন পূর্ণাঙ্গ ভিক্ষুরূপে। দীক্ষালাভের কিছুদিন পরেই শুরু করেন চীনের বিভিন্ন প্রদেশে সফর। উদ্দেশ্য দেশের শ্রেষ্ঠ আচার্যদের সান্নিধ্যে থেকে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন শিক্ষালাভ। নানা স্থানে সফরের এক পর্যায়েই পৌঁছলেন চাঙ-অন শহরে। সেখানেই পরিচিত হলেন ফা-হিয়েনের স্মৃতিকথার সঙ্গে। মূলত এখান থেকেই তিনি বৌদ্ধ পূন্যভূমিতে সফরে উদ্দীপ্ত হন। তিনি চাচ্ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার বৌদ্ধ ঋষিদের সংস্পর্শে এসে মনের যা কিছু প্রশ্ন ও সংশয়; তা দূর করবেন।

তার বয়স তখন মোটে ২৬ বছর। ৬২৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি চাঙ-অন থেকে ভারত অভিমুখে রওনা হলেন। সঙ্গে ছিলেন কানসুহ প্রদেশের সিঙ-চান শহরের এক ভিক্ষু। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন কানসুহ প্রদেশের প্রধান শহর লন-চাউয়ের দিকে। সেখান থেকে প্রদেশের শাসনকর্তার সহযোগিতায়ই নদীর অন্য পারে থাকা লিয়াঙ-চাউ গেলেন। শহরটি ছিল তখন তিব্বত ও সুঙ-লিঙ পর্বতমালার পূর্বদিক থেকে আসা বণিকদের মিলন কেন্দ্র। হিউয়েন তাদের সামনে ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা হাজির করলেন। জানালেন, ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ জানার জন্য তিনি বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলোয় ভ্রমণের জন্য বের হয়েছেন। বণিকরা তার কথা শুনে আগ্রহী হয়ে তার খরচের ব্যবস্থা করে দেন। তখন পর্যন্ত শহরের শাসনকর্তা অবশ্য তাকে যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু হিউয়েন সাঙয়ের সংকল্প দেখে আর বাধা দিলেন না।

শেষ পর্যন্ত দুজন ভিক্ষুর সহযোগিতায় তিনি পশ্চিম দিকে কাওয়া-চাউ এলেন। শহরটি সু-লু নদী থেকে প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণে এবং সম্ভবত বুলানঘির। এখান থেকে এক যুবকের সঙ্গে তিনি উত্তর দিকে এগোতে থাকলেন। যুবকটির উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত হিউয়েনকে হত্যা করে অর্থ লুটে নেয়া। কিন্তু খুব কায়দা করে তিনি নিজেকে বাঁচান নানা বিপদের হাত থেকে। এভাবে তিনি কুচে, বালুকা এবং সেখান থেকে উত্তর দিকে তুষারাবৃত পর্বতমালা পার হয়ে পৌঁছান সু-য়েহ শহরে। সেখান থেকে গেলেন তরস, নুজকেন্দ ও তাসখন্দ। তারপর সুতৃষ্ণ, সমরকন্দ কেবুদ, কসনিয়া হয়ে বোখরায় এলেন। এভাবে তিনি একের পর এক অতিক্রম করলেন বেটিক, খোয়ারিজম, কেশ, তিরমেদ, চঘানিয়ান, গরসো, সুমান কুবাদিয়ান, ওয়াখশ, খোটল, কুমিধ, রোশান, বঘলান, পুই, সমনগান, খুলম ও বলখে। বলখকে পেছনে রেখে এগিয়ে গেলেন জুমদ, জুজগান, তালিকান, গচি, বামিয়ান ও কপিশার দিকে। কপিশায় পৌঁছে সেখান থেকে এগিয়ে চললেন ভারতের উত্তর সীমান্তের লম্পকে। বোধহয় ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি সেখানে এসে প্রথম ভারতের মাটিতে পা রাখলেন। সেখান থেকে বাংলা ঘুরে তিনি যখন ভারতের বাইরে পা রাখেন, ততদিনে পেরিয়ে গেছে ১৪ বছর। তার এক বছর পরে ৬৪৫ সালে তিনি চীনের পশ্চিম রাজধানী শিঙ-ফুতে পৌঁছান।

ভারত থেকে হিউয়েন সাঙ নিয়ে যান বুদ্ধের দেহাস্থি, একটি স্বর্ণের বুদ্ধ মূর্তি, একটি চন্দন কাঠের বুদ্ধ মূর্তি, একটি রুপার তৈরি বুদ্ধ মূর্তি ও মহাযান শাখার ১২৪টি সূত্রের পুঁথির মতো অজস্র ঐতিহাসিক উপাদান। ঘোড়ার পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া বোঝায় ছিল অন্যান্য শাস্ত্রীয় আলোচনার বই। চীনে ফিরে গিয়ে তিনি ভারত ও বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন বৌদ্ধ পুস্তক অনুবাদের দিকে মন দেন। কম করেও ৭৫টি বই তিনি নিজে অনুবাদ করেন। চীনে ফেরার পর তিনি যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা ও সম্মান লাভ করেন। সে প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ন রেখেই ৬৬৪ সালে তিনি মারা যান। চীন সম্রাটের নির্দেশে জাঁকজমকের সঙ্গে তাকে পশ্চিম রাজধানী শিঙ-ফুতে সমাধিস্থ করা হয়। এর পাঁচ বছর পর ৬৬৯ সালে তার দেহাবশেষ সেখান থেকে সম্রাটের নির্দেশে ফন-চুয়েন উপত্যকার উত্তরে একটি জায়গায় সরিয়ে আনা হয়। সেখানে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয় স্মারক-সৌধ।

হিউয়েন সাঙের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান মূলত দক্ষিণ এশিয়ার সূত্র বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের অনুবাদ উদ্যোগে। এর মধ্য দিয়েই চীনে যোগাচার দর্শনের উল্লম্ফন ঘটে। তবে বাইরের দুনিয়ায় তিনি সমধিক পরিচিত তার সফরনামার কারণে। ৬৪৬ সালে তিনি সম্রাটের অনুরোধে লেখেন দ্য গ্রেট টাং রেকর্ডস অন দ্য ওয়েস্টার্ন রিজিয়নস বা সংক্ষেপে বলতে গেলে হিউয়েন সাঙের সফরনামা। মধ্যযুগের মধ্য এশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠের জন্য এটা প্রধান দলিল। হিউয়েন সাঙের শিষ্য পিয়ানজি পুরো এক বছর ব্যয় করেন লেখা এডিট করতে গিয়ে। বইটি ১২ খণ্ডে বিভক্ত। সেখানে বর্ণিত হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর ভূগোল, স্থল ও সমুদ্রপথ, জলবায়ু, স্থানীয় পণ্য, জনগণ, ভাষা, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনৈতিক জীবন, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি। তার লেখায় শতাধিক অঞ্চল ও রাজ্যের প্রসঙ্গ এসেছে, যার মধ্যে পারস্য, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ প্রধান। বইটি প্রথমে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয় ১৮৫৭ সালে; বিশিষ্ট পণ্ডিত স্ট্যানিসল্যাস জুলিয়েনের হাতে। সফরনামার বাইরে তিনি লিখেছেন যোগাচার বৌদ্ধদর্শন নিয়ে যুগান্তকারী পুস্তক চেং ওয়েই শি লুন। এছাড়া ‘বাশি গুইজু সং’ নামে তার আরো একটি গ্রন্থ বেশ পরিচিত। হিউয়েন সাঙের সফরনামার দিকে তাকালে দেখা যায় একজন বৌদ্ধ পণ্ডিতের চোখে সপ্তম শতাব্দীর দুনিয়া। কিন্তু তিনি তো কেবল দেখেই ক্ষান্ত থাকেননি, তখনকার তথ্য এমনভাবে সংরক্ষণ করেছেন; যেন আধুনিক ও সচেতন কোনো ঐতিহাসিক। তার সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ পুস্তক ও শিক্ষা ভারত এবং বাংলা থেকে চীনে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে নীতিনির্দেশনা গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি যা করেছেন, তা তার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। তিনি সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলিকেও তুলে এনেছেন। বিশেষ করে বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে যে বড় শূন্যতা, সেখানে হিউয়েন সাঙই হয়ে উঠেছেন প্রধান উৎস। বাংলার বিভিন্ন স্থানে তিনি ভ্রমণ করেছেন; তার সে লেখা বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনায় সহযোগিতা করে।

হিউয়েন সাঙ প্রায় ৬৫৭টি সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থ সংগ্রহ ও অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘‌প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্রহৃদয়’কে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের অনিবার্য পুস্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্রন্থের টীকা লেখেন হিউয়েন সাঙ; যা পরবর্তী সময়ে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও জাপানের বৌদ্ধ দর্শনচর্চায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। তিনি ভারত থেকে ‘‌মহাপ্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র’র তিন কপি নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে। অতিকায় সে পুস্তকটিও তিনি দ্রুত অনুবাদ করেন। এদিকে চেং ওয়েই শি লুন হলো যোগাচার বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন নিয়ে লেখা পুস্তক; যা প্রভাবিত বইটি পঞ্চম শতাব্দীর আফগানিস্তানের বৌদ্ধ দার্শনিক ভাসুবন্ধুর ‘ত্রিশিকাবিজ্ঞপ্তিমাত্রেতা’ থেকে। ভাসুবন্ধু ও তার ভাই অসঙ্গ মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের যোগাচার ধারার প্রতিষ্ঠাতা। হিউয়েন সাঙ দীর্ঘদিন নালন্দার পণ্ডিত শীলভদ্র ও প্রসেনজিতের অধীনে পড়াশোনা করেছেন। হিউয়েন সাঙয়ের দাবি অনুযায়ী, তিনি ত্রিশিকাবিজ্ঞপ্তিমাত্রেতা গ্রন্থের ১০টি ব্যাখ্যা পড়েছেন। সেসব টীকা ও ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে ধর্মপাল, স্থিরমতি, নন্দ, চিত্রভানু, বান্ধুশ্রী, শুদ্ধচন্দ্র, জিনপুত্র, গুণমতি, জিনমিত্র ও জ্ঞানচন্দ্র। চীনে ফিরে গিয়ে তিনি তার দীর্ঘ অধ্যয়নকে সংশ্লেষ করে একটা ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখেন, সে ব্যাখ্যাগ্রন্থই পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত হয় চেং ওয়েই শি লুন নামে। আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন, চেং ওয়েই শি লুনের মধ্যে মূলত হিউয়েন সাঙয়ের গুরু প্রসেনজিতের শিক্ষা ফুটে ওঠে। পাশাপাশি উঠে আসে যোগাচার ঘরানার প্রাথমিক দিকের আকরগ্রন্থ যোগাচারভূমির প্রভাব। প্রমাণিত হয় হিউয়েন সাঙয়ের পড়াশোনার ব্যাপ্তিও।

দূরপ্রাচ্যে যোগাচার গ্রন্থের পেছনে প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে হিউয়েন সাঙয়ের গ্রন্থ। জন্ম দিয়েছে চীনা বৌদ্ধ চিন্তায় ফাশিয়াং ও জাপানের বৌদ্ধ চিন্তায় হোসো ধারার চিন্তাধারাকে। হিউয়েন সাঙয়ের প্রধান শিষ্যদের একজন ছিলেন কুইজি। তিনি হিউয়েন সাঙয়ের পুস্তকের একটা ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখেন; যেখানে সনাতন যোগাচারের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল। তার অন্য শিষ্য ছিলেন উনচিউক। তিনিও নিজের একটা ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখেন, যা কোরিয়ায় যোগাচার দর্শনের প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তৃতীয় শিষ্য দোশো তার শিক্ষা প্রচার করেন জাপানে। তার মাধ্যমেই জাপানে হোসো ধারার চিন্তাযাত্রা শুরু করে।

হিউয়েন সাঙ মধ্য চীন থেকে সে যাত্রা শুরু করে সিল্করোড ধরে সফর করেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তে। তার পদচিহ্ন ছড়িয়ে আছে এদিকে বাংলা ও দক্ষিণে কাঞ্জিপুরম পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন বাংলা ও চীনের মধ্যকার সাংস্কৃতিক লেনদেনই ওঠে আসেনি তার লেখায়; পাশাপাশি উঠে এসেছে বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক লেনদেনের চিত্রকল্প। হিউয়েন সাঙয়ের সফরনামা তাই একাধারে সমকালীন চীন ও বাংলার দলিল। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই বর্তমান পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল। তখন থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম চীনে দাগ কাটতে শুরু করে। এ প্রবাহ জারি থেকেছে দীর্ঘদিন ধরে। হিউয়েন সাঙ সে সময়কার চীন ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতেও প্রভাব রাখেন। বৌদ্ধ লোককথায় তার আকর্ষণ ছিল সত্য। কিন্তু তার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। টাঙ দরবার থেকে তাকে চীন ত্যাগের অনুমতি দেয়া না হলেও তিনি ভারতে চলে আসেন। ভারতের বিভিন্ন রাজার সঙ্গে তার আলোচনা লিপিবদ্ধ করেন। তিনিই সম্রাট হর্ষবর্ধনকে রাজি করিয়েছিলেন চীনের সম্রাটের কাজে দূত পাঠাতে।

হিউয়েন সাঙয়ের সফরনামা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা হয় ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। তারপর বহু সাহিত্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে তার সফরনামা। অন্য লেখাগুলোও কেবল বৌদ্ধ দর্শনের পরম্পরা রক্ষা ও বিকাশেই না; ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য অনিবার্য অবলম্বন হয়ে এখনো টিকে আছে। প্রায় দেড় হাজার বছর পরে এসে হিউয়েন সাঙ যেন সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আফগানিস্তানে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অস্তিত্ব তার লেখা থেকে প্রতীয়মান হয়। চীন ও ভারতে যে সে সময় চিনি উৎপাদনের প্রযুক্তি ব্যবহার হতো, সে কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। বাংলা যে সে সময়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল কিংবা নালন্দা ও ভাসু বিহার ছিল সরব জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমি; বাংলার এমন অজস্র উপাদান আসে হিউয়েন সাঙয়ের স্মৃতিকথায়। যেন বাংলার পরিচয় নির্মাণেই এগিয়ে এসেছিলেন হিউয়েন সাঙ।

আহমেদ দীন রুমি: লেখক