সিল্করুট

হিউয়েন সাঙের দেখা বাংলার জনপদ ও বৌদ্ধ ঐতিহ্য

শহিদুল হাসান

ভাসুবিহার ছবি: সংগৃহীত

চৈনিক বৌদ্ধ সাধক ও পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (তিনি জুয়ানজাং নামেও পরিচিত) বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে জানতে এবং এ-বিষয়ক প্রামাণ্য পুস্তকাদি সংগ্রহ করতে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তিনি মাতৃভূমি চীন দেশ থেকে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করে গান্ধার হয়ে ভারতবর্ষে আসেন। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি একই যাত্রাপথ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ ১৩ বছর ভারতবর্ষে অবস্থান করেন এবং প্রায় সব বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে তিনি দুই বছর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। হিউয়েন সাঙ যেসব জায়গায় গিয়েছিলেন সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখে রেখেছেন। তিনি নালন্দা থেকে বাংলায় আসেন (এখানে ব্রিটিশ যুগে ব্যবহৃত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বোঝানো হয়েছে)। হিউয়েন সাঙের ভ্রমণের সময় উত্তর ভারতের শক্তিশালী রাজা ছিলেন কনৌজের হর্ষবর্ধন। সমসাময়িক গৌড় বা বাংলায় তখন স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের শাসন। তবে হিউয়েন সাঙ আসার কিছুদিন আগেই তিনি মারা যান। তার লিখনিতে শশাঙ্ক-পরবর্তী সময়ের বাংলার কয়েকটি রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংরেজিসহ নানা ভাষায় এ চৈনিক পরিব্রাজক প্রদত্ত বিবরণ অনূদিত হয়েছে। স্যামুুুুয়েল বিল Buddhist Records of the Western World শিরোনামে হিউয়েন সাঙের বিবরণের ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণের সময় উল্লেখ করেননি। এছাড়া বাংলা ভাষায় এ-বিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ ও অনুবাদ পাঠকের দরবারে হাজির রয়েছে। এর মধ্যে অসীম কুমার রায় লিখিত বঙ্গ বৃত্তান্ত বিদেশী পর্যটকদের লেখায় বাঙ্গালার কথা [পঞ্চম থেকে সপ্তদশ শতাব্দী] এবং বিপুল সাহা অনূদিত ও সম্পাদিত হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণ গ্রন্থের উল্লেখ করা যেতে পারে।

ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম Ancient Geography of India গ্রন্থে হিউয়েন সাঙ প্রদত্ত বিবরণের আলোকে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম কজঙ্গলে গঙ্গা অতিক্রম করে বাংলার পুন-ন-ফ-তান-না (পুণ্ড্রবর্ধন) রাজ্যে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে করতোয়া নদী পার হয়ে কিয়া-মো-লু-পো (কামরূপ) রাজ্যে যান। সেখান থেকে তিনি আসেন সান-মো-তট-অ (সমতট) দেশে। এ জায়গাগুলোর বাইরে তিনি তান-মো-লি-তি (তাম্রলিপ্তি) ও কি-লো-নু-ফা-লা-না (কর্ণসুবর্ণ) অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন। হিউয়েন সাঙের লেখনীতে পাওয়া এই রাজ্য বা দেশগুলির অবস্থান প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে সুবিদিত। নিম্নে এই এলাকাগুলোতে দেখা বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৌদ্ধ বিহার এবং বৌদ্ধধর্মীয় রীতিগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হলো। এক্ষেত্রে আমি অসীম কুমার রায় কর্তৃক প্রদত্ত অনুবাদের সহায়তা নিয়েছি।

পুন-ন-ফ-তান-না তথা পুণ্ড্রবর্ধন

হিউয়েন সাঙ পুন-ন-ফ-তান-না রাজ্য সম্পর্কে লেখেন:

এই দেশের পরিধি প্রায় ৪,০০০ লি। রাজধানীর পরিধি হবে ৩০ লি। জায়গাটি জনবহুল। পুষ্করিণী, সরকারী অফিস আর ফুলে ভরা বনভূমি এখানে জায়গায় জায়গায় অবস্থিত। ... এখানকার জমি সমতল আর দো-আঁশলা।

রাজধানীর প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পো-চি-পো সংঘারাম। এর অঙ্গনগুলি প্রশস্ত আর এ গুলিতে খুব আলো হাওয়া। এর মণ্ডপ আর ঘরগুলি বেশ উঁচু। সাধুর সংখ্যা এখানে প্রায় ৭০০। এঁরা মহাযান ধর্মের চর্চা করেন। পূর্ব ভারতের অনেক প্রসিদ্ধ সাধু এখানে বাস করেন।

এর কাছেই অশোক রাজার বানানো একটি স্তূপ আছে। পুরাকালে, এই জায়গায় তথাগত দেবতাদের লাভার্থে ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে, পর্বদিনে এখানে চারিদিকে উজ্জ্বল আলো দেখা যায়। 

এর পাশেই একটি জায়গায় অতীত কালের চারজন বুদ্ধ ব্যায়ামের জন্য হাঁটতেন ও পরে বসতেন। তাঁদের স্মরণ চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়।

কাছেই একটি বিহারে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের মূর্তি আছে। এঁর দিব্য দৃষ্টিতে কোন ব্যাপারই লুকানো নেই, আর এঁর দৈবজ্ঞান নির্ভুল। তাই কাছে বা দূরের লোকে উপবাস আর পূজা করে আর এখানে নিজেদের সমস্যা সম্পর্কে পরামর্শ করতে আসে। (পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮)

উপর্যুক্ত বর্ণনাটি অনেকাংশেই বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে অবস্থিত দুর্গ নগরী এবং তার চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ বিহারগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। এমনকি প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে রাজধানী নগরী থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পো-চি-পো বা উচ্চারণ ভিন্নতায় পোশিপো বিহারটিও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এটি মূলত ভাসু বিহার।

সান-মো-তট-অ তথা সমতট

হিউয়েন সাঙের লেখনীতে উল্লেখিত সান-মো-তট-অ রাজ্যটির বর্তমান অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাশে অবস্থিত কুমিল্লা জেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকা। এ রাজ্য সম্পর্কে তিনি লেখেন:

আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, আর লোকেদের স্বভাব ভদ্র। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী, লম্বায় কম, আর এদের গায়ের রঙ কালো। এরা বিদ্যানুরাগী, আর বিদ্যালাভ করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করে। সত্য আর মিথ্যা দুই সিদ্ধান্তের লোক এখানে থাকে। তিরিশটির কাছাকাছি সংঘারাম আছে, তাতে ২,০০০ সাধু থাকেন। এঁরা সকলেই স্থবির সম্প্রদায়ের। শ’খানেক দেব মন্দির আছে। তাতে অনেক (অবৌদ্ধ) সম্প্রদায়ের লোক থাকেন। নির্গ্রন্থ নামে নগ্ন সন্ন্যাসীরাই (দিগম্বর জৈন) সবচেয়ে বেশি।

নগর থেকে অনতিদূরে অশোক রাজার বানানো একটি স্তূপ আছে। প্রাচীনকালে তথাগত এখানে সাতদিন দেবতাদের লাভার্থে তাঁর গভীর ও রহস্যময় ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন। এর পাশেই চারজন বুদ্ধের বসবার আর হাঁটবার চিহ্ন আছে।

অনতিদূরে একটি সংঘারামে বুদ্ধের একটি নীল স্ফটিকের মূর্তি আছে। এটি প্রায় আড়াই মিটার উঁচু, আর বুদ্ধের (মহাপুরুষ) লক্ষণ এতে স্পষ্ট দেখা যায়। মূর্তিটি মাঝে মাঝে তার অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করে। (পৃষ্ঠা ৯৮-৯৯)

উল্লেখ্য, কুমিল্লার শালবন বিহার, ভোজ বিহার, আনন্দ মুড়াসহ অসংখ্য বিহারে ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আবিষ্কৃত হয়েছে।

তান-মো-লি-তি তথা তাম্রলিপ্তি

হিউয়েন সাঙের লেখনীতে উল্লেখিত তান-মো-লি-তি’র অবস্থান বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায়। ঐতিহাসিক সূত্রাদি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির ভিত্তিতে এটিকে প্রাচীন বাংলা সমুদ্রবন্দর তাম্রলিপ্তির সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হিউয়েন সাঙ এ এলাকা সম্পর্কে লেখেন:

সমতট থেকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে তাম্রলিপ্তি দেশ। দেশের পরিধি প্রায় ৭০০ কিলোমিটার আর রাজধানীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। দেশটি সমুদ্রের ধারে। জমি এখানে নীচু আর উর্বর। নিয়মিত চাষ হয়, আর প্রচুর ফুল আর ফল জন্মায়। আবহাওয়া গরম। লোকেরা চটপটে আর ব্যস্তবাগীশ। পুরুষেরা পরিশ্রমী আর সাহসী। (বৌদ্ধধর্মে) বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী দুই সম্প্রদায়েরই লোক এখানে থাকে। দশটি আন্দাজ সংঘারামে প্রায় ১,০০০ সাধু থাকেন। দেব মন্দিরের সংখ্যা ৫০টি হবে। সেগুলিতে অনেক সম্প্রদায়ের লোক মিলেমিশে থাকে। সমুদ্র থেকে একটি উপসাগর এই দেশে প্রবেশ করেছে, যেন স্থল আর জল আলিঙ্গন করছে। বহুমূল্য দুষ্প্রাপ্য জিনিস আর রত্ন এখানে একত্র করা হয়, সাধারণত: তাই এখানকার লোকেরা বেশ ধনী।

নগরের পাশেই অশোক রাজার বানানো একটি স্তূপ আছে। তার কাছেই পুরাকালের চারজন বুদ্ধের বসবার ও হাঁটবার চিহ্ন।

এখান থেকে ৩৫০ কিলোমিটার আন্দাজ উত্তর-পশ্চিমে কর্ণসুবর্ণ দেশ। (পৃষ্ঠা ৯৯)

কি-লো-নু-ফা-লা-না তথা কর্ণসুবর্ণ

হিউয়েন সাঙের উল্লেখিত কি-লো-নু-ফা-লা-না ছিল বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী। এটিকে মুর্শিদাবাদ জেলার রাজবাড়ীডাঙ্গায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এ এলাকার বৌদ্ধ সংস্কৃতি সম্পর্কে এ চৈনিক শ্রমণ লিখেছিলেন:

এই রাজ্যের পরিধি প্রায় ৭০০ কিলোমিটার, আর রাজধানীর পরিধি প্রায় ১০ কিলোমিটার। নগরটি জনবহুল আর গৃহস্থরা বিত্তশালী। লোকেরা সৎ ও ভদ্র। এরা অত্যধিক বিদ্যানুরাগী আর খুব আগ্রহের সঙ্গে লেখাপড়া করে। এদের মধ্যে (বৌদ্ধধর্মে) বিশ্বাসী আর বিধর্মী দু রকম লোকই আছে। এখানে প্রায় ১০টি সংঘারাম আছে আর তাতে প্রায় ২,০০০ সাধু থাকেন। এঁরা হীনযান সম্প্রদায়ের লোক। পঞ্চাশটি দেব মন্দির আছে। এখানে বিধর্মীদের সংখ্যা খুব বেশি। এছাড়া এখানে এমন তিনটি সংঘারাম আছে যেখানে দেবদত্তর নিষেধানুযায়ী গাঢ় করা দুধ (ক্ষীর? দই? মাখন? দেবদত্ত নিজের সম্প্রদায়ের লোকেদের মাখন খেতে নিষেধ করেছিলেন) ব্যবহার করা হয় না।

রাজধানীর পাশেই রক্তমৃত্তিকা সংঘারাম। এর হলগুলি প্রশস্ত আর আলো হাওয়া যুক্ত। বহুতল অট্টালিকাগুলি খুব উঁচু। এই সংস্থাতে রাজ্যের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদ্বান আর প্রসিদ্ধ লোকেরা একত্রিত হন। তাঁরা পরস্পরকে উৎসাহ আর উপদেশ দিয়ে উন্নত হতে আর চরিত্র উৎকৃষ্ট করতে সাহায্য করেন। 

সংঘারামের পাশে, অদূরে, অশোক রাজার বানানো একটি স্তূপ আছে। তথাগত যখন পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন তখন তিনি সাতদিন এখানে ধর্মোপদেশ দেন। এর পাশে একটি বিহার আছে। চারজন অতীত বুদ্ধের হাঁটবার আর বসবার চিহ্ন এখানে আছে। এছাড়া, বুদ্ধ যেখানে তাঁর ধর্ম লোকেদের বুঝিয়ে দেন সেই সব জায়গাতেও কয়েকটি স্তূপ আছে। এগুলি সব অশোক রাজার তৈরি। (পৃষ্ঠা ৯৯-১০১)

চৈনিক বৌদ্ধ সাধক হিউয়েন সাঙের লেখায় উঠে আসা বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতি-দর্শন-স্থাপত্যবিষয়ক তথ্যাদি আদি পর্বের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আলেখ্য। তিনি বাংলাদেশের বগুড়া কিংবা কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ বিহারের পাশাপাশি সম্রাট আশোকের সময়ে নির্মিত স্তূপও দেখেছেন। এছাড়া সমতটে তিনি জৈন ধর্মালম্বীদের সরব উপস্থিতি দেখেছেন। এমনকি তিনি তাদের বৌদ্ধদের তুলনায় সংখ্যায় অধিক হিসেবে বিধৃত করেন। এ যেন ধর্মীয় সহাবস্থান বা ধর্মীয় উদারতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। বাংলার বৌদ্ধ বিহারগুলো যে সমকালীন সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তার ইঙ্গিত হলো হিউয়েন সাঙের বক্তব্য—‘এখানে নিজেদের সমস্যা সম্পর্কে পরামর্শ করতে আসে।’ এ ধরনের সহাবস্থান উদারতা বাংলার মানুষের দীর্ঘকালের উত্তরাধিকার।

সহায়ক গ্রন্থাবলি

১. অসীম কুমার রায়, বঙ্গ বৃত্তান্ত: বিদেশী পর্যটকদের লেখায় বাঙ্গালার কথা [পঞ্চম থেকে সপ্তদশ শতাব্দী] (কলিকাতা: ঋদ্ধি ইন্ডিয়া, ১৯৫৬)।

২. বিপুল সাহা, হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণ (কলকাতা: অনুভাব প্রকাশনী, ২০০৮)।

শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়