দেশের উত্তারাঞ্চলের প্রবেশমুখেই গড়ে উঠেছে বর্তমানের বগুড়া। এখানকার কৃষিজমি উর্বর। নানা ফসল ফলানোর কারণে এখানকার কৃষকরা অনুকরণীয়। বগুড়া জেলার মধ্যে রয়েছে মহাস্থানগড় বা পুণ্ড্রনগর, বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও বৃহৎ নগর বলে ধরা হয়। করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে বাংলাদেশের এ প্রাচীনতম রাজধানী ও পুরাকীর্তিটি বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। বগুড়া সদর উপজেলা ও শিবগঞ্জ উপজেলাজুড়ে রয়েছে মহাস্থানগড়। চারপাশের সমতল বা কৃষিজমির চেয়ে গড়ে প্রায় ৪৫ ফুট উচ্চে অবস্থিত। এ দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তির স্থানটি একটি আয়তাকার ঢিবি, যার দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫৫২ মিটার ও প্রস্থ ১৩৭০ মিটার। এ চারপাশে প্রায় উঁচু ২৫ ফুট প্রস্থ প্রাচীর রয়েছে। মূল ‘পুন্ড্রনগর’ দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত। সুরক্ষিত নগরটি উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক একটি গভীর পরিখা দিয়ে চারপাশ ঘেরা ছিল। এ পরিখার আংশিক চিহ্ন আজও কালের সাক্ষ্য বহন করছে। পূর্বদিকে করতোয়া নদী। উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে আট কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে পোড়া ইটের তৈরি বিক্ষিপ্ত বহু ঢিবি দেখা যায়। এগুলো প্রাচীন প্রাদেশিক রাজধানীর সাক্ষ্য বহন করে। অনেক পর্যটক ও পণ্ডিত ব্যক্তি এ শহরতলি এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং তাদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। বলা হয়, ১৭৭৯ সালে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষরূপে শনাক্ত করার¡জন্য স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম পুণ্ড্রনগর ভ্রমণ করেন এবং সেখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মলিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপিতে ‘পুন্ড্রনগথ’ (পুণ্ড্রনগর) উল্লেখ থেকে বলা হয় নগরটি সম্ভবত মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত জনবসতি ছিল। এ উল্লেখের তালিকায় রয়েছে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা ইতিহাস, যা বর্তমানে ভাসু বিহার নামে পরিচিত। বগুড়ার ভাসু বিহার, যেন মাটির নিচে ঘুমন্ত দালিলিক ইতিহাস হয়ে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। ভাসু বিহারটি বর্তমানে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউনিয়নে অবস্থিত, যা মহাস্থানগড় থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে। উঁচু টিলা আকৃতির ধাপটি একসময় ছিল বৌদ্ধবিহার। চাইনিজ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৮-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে এ বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন করেন। তিনি তার বিবরণে উল্লেখ করেছেন এ বৌদ্ধবিহারে তিনি ৭০০ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে পড়ালেখা করতে দেখেছেন। হিউয়েন সাঙয়ের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে স্যার আলেকজান্ডার কানিং হাম (১৮৭৯) বর্তমানের ভাসু বিহারকে হিউয়েন সাঙয়ের দেখা বৌদ্ধবিহার হিসেবে শনাক্ত করেন। বিহারের অপূর্ব নির্মাণশৈলী যে কাউকে তাক লাগিয়ে দেবে। ভাসু বিহারে এখনো সারি সারি কক্ষ পড়ে আছে। যদিও প্রথম বিহারে ২৬টি ও দ্বিতীয় বিহারে ৩০টি কক্ষ বা কক্ষের মতো দেখতে পাওয়া যায়। প্রধান মন্দিরটি ছিল ভাসু বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে, ২ নম্বর বিহারের দক্ষিণে এবং ১ নম্বর বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে। মন্দিরটিতে ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ির প্রদক্ষিণ পথ আছে। কক্ষগুলোর অভ্যন্তর থেকে ৬০টিরও বেশি ব্রোঞ্জ মূর্তি উদ্ধার করা হয়। ইতিহাসে রয়েছে মূর্তিগুলোর মধ্যে বুদ্ধ, ধ্যানীবুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও বোধিশক্তি উল্লেখযোগ্য ছিল। পোড়ামাটি (ইট) আর সুড়কির কী এমন শক্তি ছিল যে দুই থেকে আড়াই বছর পরেও চিহ্ন রেখে গেছে। তাদের কি এমন নির্মাণ কৌশল ছিল? এমন প্রশ্ন মনের মধ্যে গেঁথে যাবে আপনারও। বিহারের ধাপে ধাপে বেশকিছু কক্ষ রয়েছে। পাঁচ-সাত ফুটের চওড়া ভিত ও কক্ষ দেখলে বোঝা যায় এখানে একসময় অতি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উন্নত ও নিয়মনীতির বিষয়গুলো ছিল কঠোর। ধারণা করা হয় বিহারের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত কক্ষগুলোয় বৌদ্ধ ভিক্ষুক পড়ালেখা করত এবং আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করত। বিহারের ঠিক দক্ষিণ অংশে ভিক্ষুদের উপাসনালয়ের জন্য একটি মন্দির বা এ-জাতীয় কিছু নির্মাণ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের বিবরণের ওপর ভিত্তি করেই এ বৌদ্ধবিহারে একাধিকবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়। ১৯৭৩-৭৬ ও ১৯৮৪ সালেও খননকাজ করা হয়। এছাড়া ২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর এখানে আবারো খনন শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সর্বশেষ এ খননকালে অন্য একটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়, যা দশম-একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এ বৌদ্ধ মন্দিরের ভিত্তিভাগের দুই মিটার নিচে আরো একটি স্থাপত্য কাঠামোর (ইটের দেয়াল) নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রায় দেড় হাজার আগে নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া একই সময়ে নির্মিত বৌদ্ধবিহারের নিচে অর্থাৎ এ কাঠামো দ্বারা আবৃত একটি বৌদ্ধ ভিক্ষু কক্ষের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ উন্মোচিত হয়। মূলত বলা হয়, এ খনন থেকেই সর্বশেষ প্রাথমিক প্রমাণ হয় যে চাইনিজ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের দেখা সে বৌদ্ধ ভিক্ষু কক্ষের, যা বগুড়ার ভাসু বিহার নামে পরিচিত। ওই সময়ে খননকালে বেশকিছু প্রাচীনকালের পোড়ামাটির সিলিং ও এনবিপিডব্লিউ পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত সিলিংয়ের ওপর উৎকীর্ণ লিপির ধরন (ব্রাহ্মী হরফ) ও এনবিপিডব্লিউ প্রাপ্তিতে অনুমান করা হচ্ছে এখানে বসতি আরো বহু আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব যুগে শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এখানে সমৃদ্ধ বসতি গড়ে উঠেছিল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, স্থানীয়রা বিহারকে নরপতির ধাপ বলে। ভাসু বিহারে প্রথম খনন করা হয় ১৯৭৩-৭৪ সালে। ওই সময়ে খননে পাওয়া যায় মাঝারি সংঘরাম আকৃতির নিদর্শন, মন্দিরে যাওয়ার রাস্তার সন্ধান। ধারণা করা হয় পাওয়া নিদর্শনগুলো সম্রাট অশোকের সময়কালের। সংঘরাম বলা হয় যেখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে ধর্মচর্চা, শিক্ষাগ্রহণ করা হয়। ভাসু বিহারে ওই সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করত। তারা ধর্মচর্চা করত। ভাসু বিহারে ২৬টি কক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। কক্ষের সঙ্গে বেশ বড় আকৃতির বারান্দাও দেখা যায়, যা এখনো বর্তমান। যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধর্মশিক্ষা অর্জন করতে বসবাস করত। কথিত আছে, ভাসু বিহারে গৌতম বুদ্ধের পদচারণা ছিল। এ পদচারণাকে স্মৃতি করে রাখতে ভাসু বিহারে একটি ইটের স্তূপ তৈরি করেছিলেন সম্রাট অশোক। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, গৌতম বুদ্ধের সম্মানে সম্রাট অশোক স্তূপটি নির্মাণ করেছিলেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম সে স্তূপটিকে হিউয়েন সাঙ বর্ণিত অশোকস্তূপ হিসেবে শনাক্ত করেন। সে ভাসু বিহারে আবারো খননে পাওয়া যায় হাজার বছর আগের ইটের তৈরি দেয়াল, মন্দিরের প্রবেশপথ, পাল আমলের শেষ দিকে নির্মিত ইটের অবকাঠামো। এছাড়া পাওয়া গেছে মৃৎপাত্রের অনেক টুকরো। ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারিতে শুরু হয় একটি খনন কার্যক্রম। সে সময়ে খননে পাওয়া ইটের অবকাঠামো প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো বলে দাবি করেছিলেন খনন দলের প্রধান এবং ওই সময়ের আঞ্চলিক পরিচালক (ছিলেন) নাহিদ সুলতানা। তিনি সে সময় জানান, খনন এলাকায় আরো পাওয়া যায় একটি গর্ত, যেখানে একত্রে ছিল মৃৎপাত্রের টুকরা এবং মাটির পাতিলের ভগ্নাংশ মন্দিরের সামনের অংশে খননে পাওয়া অবকাঠামোর কিছু অংশ, সম্ভবত মন্দিরে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা হতো। পাওয়া গেছে, পাল আমলের শেষদিকে নির্মিত ইটের অবকাঠামো। এছাড়া পাওয়া গেছে মৃৎপাত্রের অনেক টুকরা। ১৯৭৩ সালে প্রথম এ সাইটে খনন করে। তখন পাওয়া যায় ব্রোঞ্জের তৈরি বেশ কয়েকটি মূর্তিসহ নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। গত কয়েক বছর খননে পাওয়া গেছে হরফ সংবলিত নামা ধরনের সিল, মাটির মূর্তি ও পোড়ামাটির ফলকসহ নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। দুই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা ওই জনপদ এখন টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে ভ্রমণে আসেন। বিভিন্ন বেসরকারি ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা সফরে এসে খুঁটে খুঁটে খোঁজার চেষ্টা করে সে সময়ের কথা। কিন্তু বর্তমানে ভাসু বিহারের নিরাপত্তার কোনো বিধান নেই। সরকারি সম্পদ হলেও কিছু কাজ করার পর সেটি এখন খোলা মাঠের প্রান্তরে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে। কত শত বছর ধরে পড়ে আছে অযত্নে। নিরাপত্তার বিধান না থাকায় এর মাটির নিচে চাপা পড়া মূল্যবান জিনিসপত্র লুণ্ঠন যে হয়নি তা অস্বীকার কে করবে? উদ্যোগ নিলে আধুনিক পর্যটন স্পট হয়ে উঠতে পারে সারা দেশসহ এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। বিহারের সংরক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। মহাস্থানগড় যেমন আজও হয়ে ওঠেনি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র, তেমনি ভাসু বিহারও সম্ভাবনাময় হয়েও থেকে গেছে অযত্নে অবহেলায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর, তারপর হাজার বছর। এইচ আলিম: সাংবাদিক