সিল্করুট

সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার রাজনৈতিক টানাপড়েন

ফারিহা আজমিন

গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের প্রচলিত মুদ্রাছবি: ক্ল্যাসিক্যাল নিউমিসমেটিক গ্রুপ

ইতিহাসে হাজারো বছর ধরে মানুষ দেশ-দেশান্তর ভ্রমণের সঙ্গে রয়েছে। কেউ জ্ঞান অর্জনে, কেউ তীর্থযাত্রী বা ধর্ম পরিব্রাজক হয়ে। এমনই একজন সাত শতকের চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী, ভিক্ষু, পণ্ডিত, পর্যটক ও অনুবাদক হিউয়েন সাঙ বা জুয়ানজ্যাং। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উত্তর ভারতে এসেছিলেন হিউয়েন সাঙ। তিনি চৈনিক ও ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনামলেই তার আগমন ঘটে উত্তর ভারতে। তবে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য বলতে কিছু ছিল না। ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে উত্তর ভারত ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভাই রাজ্যবর্ধন বাংলার রাজা শশাঙ্কের হাতে নিহত হলে উত্তর ভারতের রাজা হিসেবে হর্ষবর্ধনকেই ঘোষণা করা হয়।

ভারতবর্ষ থেকে বাংলায় হিউয়েন সাঙ আনুমানিক ৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আসেন বলেই ধারণা করা হয়। বাংলার রাজা তখন শশাঙ্ক। এ সময়ে বাংলা ও ভারতবর্ষের নানা রাজনৈতিক টানাপড়েনের সাক্ষীও হয়েছেন হিউয়েন সাঙ। শশাঙ্কই বাংলার প্রথম সার্বভৌম নরপতি, যিনি নিজ প্রদেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে বহু অঞ্চলের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তবে রাজ্যবিস্তার করতে গিয়েই উত্তর ভারতের রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গেও হয়েছে বেশকিছু যুদ্ধ।

৬০৬ খ্রিস্টাব্দের আগেই শশাঙ্ক গৌড়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার রাজধানী কর্ণসুবর্ণ খুব সম্ভবত মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত ছিল। সে সময়ে শশাঙ্ক মেদিনীপুর, উৎকল ও গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত কোঙ্গোদ রাজ্যও জয় করেন। পশ্চিমের মগধও শশাঙ্কের অধীনে চলে আসে। পূর্বে বাংলার আর কোনো শাসক এরূপ সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছেন বলে ইতিহাসে নেই। তবে রাজা শশাঙ্ক এতেও সন্তুষ্ট হননি। তিনি গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরিদের দমন করতে সংকল্পবদ্ধ হন। সে সময়ে থানেশ্বরের রাজা ছিলেন প্রভাকর বর্ধন। তার কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিয়ে করেছিলেন মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা। এ সময়ে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মাও শশাঙ্কের ভয়ে থানেশ্বরের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলেন। শশাঙ্কও এসব শত্রুকে মোকাবেলায় মালবের রাজা দেবগুপ্তের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। শশাঙ্ক প্রথমে বারাণস অধিকার করে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তও মালব থেকে কনৌজের দিকে যাত্রা করেন। শশাঙ্কের পরবর্তী বিবরণগুলো মূলত হর্ষচরিত গ্রন্থ থেকে জানা যায়।

থানেশ্বরের রাজা প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন সিংহাসন আরোহণ করেন। এ সময়ে কনৌজ থেকে দূত এসে সংবাদ দিল মালবের রাজা কনৌজের রাজা গ্রহবর্মাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছে এবং গ্রহবর্মা নিহত হয়েছেন। তার স্ত্রীকেও কারাবন্দি করা হয়েছে এবং থানেশ্বর আক্রমণের প্রস্তুতি চলছে। এ নিদারুণ সংবাদে রাজ্যবর্ধন তার কনিষ্ঠ ভাই হর্ষবর্ধনের ওপর রাজসভার সব ভার অর্পণ করে সসৈন্যে দেবগুপ্তকে মোকাবেলায় এগিয়ে যান। গ্রন্থে বলা আছে এ সময়ে রাজ্যবর্ধন তার সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার অশ্ববাহিনী নিয়ে গিয়েছিলেন। পথেই মালবরাজ দেবগুপ্তকে পেয়ে তাকে পরাস্থ করেন এবং বন্দি করেন রাজ্যবর্ধন কিন্তু কনৌজ পৌঁছানর আগেই শশাঙ্কের হাতে তার মৃত্যু ঘটে।

হর্ষচরিতের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, দেবগুপ্ত কনৌজ জয় করে শশাঙ্কের জন্য অপেক্ষা না করেই থানেশ্বরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। তবে তিনি রাজ্যবর্ধনের হাতে বন্দি হন এবং পথেই রাজ্যবর্ধন নিহত হন শশাঙ্কের হাতে। শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর বিষয়টি ইতিহাসে বেশ কয়েকভাবে এসেছে।

হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’, হিউয়েন সাঙ লিখিত গ্রন্থ এবং হর্ষবর্ধনের শিলালিপি থেকে ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। বাণভট্টের লিখনে জানা যায়, মিথ্যা প্ররোচনায় রাজ্যবর্ধন ক্ষুব্ধ হয়ে একাই শশাঙ্কের বাড়ি পৌঁছে এবং সেখানেই নিহত হন। তবে কেন রাজ্যবর্ধন এতটা অসহায় পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন তা নিয়ে বাণভট্ট কিছু বলেননি। এছাড়া বেশকিছু লেখনীতে আবার এমনও তথ্য উঠে এসেছে, শশাঙ্ক তার কন্যার সঙ্গে রাজ্যবর্ধনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে একাকী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তাকে ছদ্মবেশে হত্যা করা হয়।

হিউয়েন সাঙ যেহেতু দীর্ঘ সময় উত্তর ভারতে ছিলেন এবং তারপর বাংলায় এসেছেন, তাই সেখানে তিনি হর্ষবর্ধনের আতিথেয়তা পেয়েছিলেন। তিনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের মন্ত্রীদের বলতেন, সীমান্ত রাজ্যে এত ধার্মিক রাজা থাকলে নিজ রাজ্যের উন্নতি সম্ভব নয়। ঈর্ষান্বিত হয়ে শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে নিজ রাজদরবারে ডেকে পাঠিয়েছেন এবং তাকে হত্যা করেন। তবে হিউয়েন সাঙয়ের এ বর্ণনা ইতিহাসে খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। রাজ্যবর্ধন সিংহাসন আরোহণ করার পর থেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার ধার্মিকতা বিচারের সুযোগ ছিল না শশাঙ্কের। অন্য একটি লেখায় হিউয়েন সাঙ লিখেছেন রাজ্যবর্ধনের মন্ত্রীদের ভুলেই রাজ্যবর্ধন শত্রুদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।

আবার হর্ষবর্ধনের শিলালিপিতে লিখিত হয়েছে, সত্য অনুরোধে রাজ্যবর্ধন শত্রু ভবনে প্রাণ হারিয়েছেন। এখানে শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতক কোনো কথা লেখা ছিল না। তিনটি বিবরণীতে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য লিখিত থাকলেও বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙ শশাঙ্কের ঘোর বিরোধী ছিলেন বলাই যায়। হিউয়েন সাঙ তার গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় শশাঙ্ককে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সেই সঙ্গে হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় বাণভট্টের লিখিত গ্রন্থে রাজ্যবর্ধন যদি নিজ মন্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রাণ হারিয়েও থাকেন বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যাবেন। তাই এ দুজনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর দায়ভার শশাঙ্কের ওপর দেয়া যায় না।

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। বাণভট্ট তার গ্রন্থে লিখেছেন, হর্ষ তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর শপথ নিয়েছিল, গৌড় দখল করতে না পারলে নিজেই আত্মাহুতি দেবেন। এ উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও পথেই ভগ্নী রাজ্যশ্রীর কারাবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সেনাপতি ভন্ডীকে যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে ভগ্নীকে উদ্ধারে চলে যান। পরবর্তী আলোচনা সম্পর্কে তেমন কিছুই আর লেখেননি বাণভট্ট। তবে এ বিষয়ে হিউয়েন সাঙ তার সফরনামায় লিখেছেন, শশাঙ্কের সঙ্গে হর্ষবর্ধন একাধারে ছয় বছর যুদ্ধ করেছেন এবং এভাবেই হর্ষবর্ধন সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন। কিন্তু এ তথ্যকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে, হর্ষবর্ধন দাক্ষিণাত্যের রাজা কুলকেশির কাছে পরাজিত হওয়ার বিষয়টি। আবার শশাঙ্ক মৃত্যুকাল পর্যন্ত মগধের অধিপতি ছিল এটি হিউয়েন সাঙের বর্ণনায়ই পাওয়া যায়। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের আগে নিজ স্থানের বোধিবৃক্ষ কেটে ফেলা এবং মন্দির থেকে বৌদ্ধ মূর্তি সরিয়ে ফেলার আদেশ দিলে শশাঙ্কের শরীরে পচন ধরে। কিছুকাল পরেই তার মৃত্যু ঘটে। সুতরাং হর্ষবর্ধনের সঙ্গে যুদ্ধ এবং পরাজয়ের বিষয়টি সত্য নয়। তবে প্রাচীন একটি বৌদ্ধগ্রন্থ আর্য্যমঞ্জুশ্রীতে পূর্বের রাজাদের বেশকিছু বিবরণ পাওয়া যায়। এর সীমাবদ্ধতা হলো কোনো রাজারই পুরো নাম সেখানে নেই। যেমন শশাঙ্ক ও হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ নিয়ে সেখানে বলা আছে রাজা সোম (শশাঙ্ক) তার শত্রু হকারাখ্য ও রকারাখ্য যথাক্রমে হর্ষবর্ধন ও রাজ্যবর্ধনের নাম।

পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং শশাঙ্কের ১৭ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা সমসাময়িক অন্য কোনো উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়। বরং অতিসম্প্রতি দক্ষিণ মেদিনীপুর হতে আবিষ্কৃত শশাঙ্কের শিলালিপিতে দণ্ডভুক্তি জনপদের অস্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে, যা মেদিনীপুর ও ওড়িশার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল। হর্ষবর্ধন প্রথম দিকে শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন মহান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহ অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন বলে কথিত আছে।

কনৌজের পর তিনি প্রয়াগেও অনুরূপ বিশাল বৌদ্ধ সংগীতির আয়োজন করেন। কনৌজ ও প্রয়াগের বৌদ্ধ সমাবেশে হিউয়েন সাঙ ও সীমান্তবর্তী সব রাজ্যের রাজা, মন্ত্রী, অভিজাত প্রমুখ অংশ নেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন শশাঙ্ককে শায়েস্তা করার জন্যই বোধিসত্ত্বের নির্দেশে হর্ষের জন্ম হয়েছে বলে হিউয়েন সাঙ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এভাবেই তার লিখিত গ্রন্থে তিনি রাজা হর্ষবর্ধনের প্রশংসা করেছেন, পাশাপাশি তার চীরশত্রু শশাঙ্কের কয়েকটি বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী কাজকর্মের বর্ণনাও দিয়েছেন। তবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি হর্ষবর্ধনের অনুরাগ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি বিদ্বেষ, নৃশংসভাবে দমন হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের হতাশ করে। বিপুলসংখ্যক হিন্দু পূর্ব ভারতে সে সময়ে অভিবাসন করেন। হিউয়েন সাঙ কামরূপে বেশকিছু শিক্ষিত ব্রাহ্মণের চলে যাওয়ার কথাও তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ভারতবর্ষ এবং বাংলার রাজনৈতি, ধর্মীয় নানা টানাপড়েনের সাক্ষী হয়েছিলেন চৈনিক এ বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাঙ।

ফারিহা আজমিন: লেখক