সিল্করুট

দক্ষ প্রশাসন আর উচ্চকাঙ্ক্ষা গড়েছিল চোল সাম্রাজ্য

এস এম রশিদ

বৃহদীশ্বর মন্দিরে রাজরাজ চোলের শিলালিপি। ছবি: নিত্য বিনোদ/উইকিমিডিয়া কমনস

সুদূর অতীতে শুরুটা কুয়াশায় ঢাকা, তারপর মধ্যযুগে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নিয়ে দক্ষিণ ভারতে মাথা তোলে চোল রাজবংশ। তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণাংশকে তারা ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছিল তিনটি শতাব্দীজুড়ে। সময়টা মোটামুটি ৮৫০ থেকে ১২০০ শতক। চোলদের শাসনে এ অঞ্চল একক শাসনের অধীনে আসে। পূর্বাংশের মানুষ এ চোলদের ক্ষমতার আঁচ পেয়েছিল যখন প্রথম রাজেন্দ্র গঙ্গা অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তদের দূত গিয়েছিল চীনেও। চোলদের বিভিন্ন যুদ্ধে তাদের সহায়ক ছিল পূর্বাংশের চালুক্যরা। বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে এ দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হয়েছিল। অন্যদিকে পশ্চিমাংশের চালুক্যদের সঙ্গে আবার দুজনেরই শত্রুতা ছিল। বারো শতকে যুদ্ধে উভয় পক্ষই ক্ষয়ে গিয়েছিল।

চোলদের বড় কৃতিত্ব ছিল দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করা। একদিকে ছিল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন, অন্যদিকে অঞ্চলগুলোকে দেয়া হয়েছিল পর্যাপ্ত স্বায়ত্তশাসন। প্রশাসন ছিল বিস্তৃত, জটিল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় ছিল এখনকার মতো বিভিন্ন ধাপ, গ্রেড। প্রশাসনের কর্মকর্তারা সমাজে ছিলেন এক ভিন্ন শ্রেণী। আর তারা নিজেরা ছিলেন দুই ভাগে বিভক্ত—উচ্চপদস্থ (পেরুনদানাম) ও নিম্নপদস্থ (সিরুদানাম)। কর্মকর্তাদের পদটি ছিল বংশানুক্রমিক। বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে তফাত ছিল না। কর্মকর্তাদের পুরস্কার ছিল জমি, যুদ্ধ জয়ের সম্পদ ও সম্মানিক পদবি। তাঞ্জোর, গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম, দারাসুরাম, ত্রিভুবনীর বড় বড় মন্দিরের পাশাপাশি চোল সাম্রাজ্যে তৈরি হয়েছিল অসংখ্যা ছোট আকারের মন্দির। সাম্রাজ্যের শক্তি নির্দেশে এ স্থাপনাগুলো এখনো টিকে আছে। চিত্রকর্ম, সংগীত, নৃত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছিল। তবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল সাহিত্য।

চোলদের স্বর্ণযুগের সূচনা ৮৫০ সালে যেদিন বিজয়ালয় চোল তাঞ্জোর দখল করেছিলেন। শহর দখল করে সেখানে তিনি দেবী নিশুমভাসুদিনির (দুর্গা) মন্দির স্থাপন করেন। পল্লব ও পাণ্ড্যরা যখন নিজেদের মধ্য যুদ্ধে ব্যস্ত, তখনই অনেকটা নীরবে উত্থান হয়েছিল বিজয়ালয়ের। 

চোলদের গৌরব আসমান ছুঁয়েছিল অরুমোলিভারমানের অভিষেকের মাধ্যমে। নিজেকে রাজরাজ চোল নামে ঘোষণা করে তিনি সিংহাসনে বসেন ৯৮৫ সালে। চোল শাসন সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোয় পৌঁছে তার ত্রিশ বছরের শাসনামলে। তার শাসনামলে চোল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়, পাশাপাশি দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার অধীন আসে। গড়ে ওঠে শক্তিশালী সেনা ও নৌবাহিনী। তিনি পাণ্ড্য, কেরালার রাজা ও শ্রীলংকা আক্রমণ করেন। তার নৌবাহিনীর আক্রমণে শ্রীলংকা উত্তরাংশ চোলদের পতাকার তলে আসে। সেখানকার শাসক পঞ্চম মহিন্দ্র পালিয়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে চলে যান। নিজের শাসনের শেষভাগে রাজরাজ চোল মালদ্বীপকেও তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ১০১৪ সালে তার মৃত্যুতে চোলদের স্বর্ণযুগের সেরা সময়ের অবসান ঘটে। মৃত্যুর দুই বছর আগে তিনি পুত্র রাজেন্দ্রকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে গিয়েছিলেন। 

রাজেন্দ্র পিতার যোগ্য সন্তান ছিলেন। তার আমলে পুরো ভারতের সবচেয়ে বিস্তৃত ও সম্মানিত হিন্দু স্টেট ছিল এই চোল সাম্রাজ্য। নিজের শাসনের শুরুর দিকেই তিনি (১০১৮ সাল) পুত্র প্রথম রাজাধিরাজকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। রাজেন্দ্র পিতার অনুসরণে শ্রীলংকা আক্রমণ করেন এবং সেখানে চোলদের আধিপত্য নিশ্চিত হয়। পঞ্চম মহিন্দ্রকে বন্দি করে চোল সাম্রাজ্যে নিয়ে আসা হয়। এখানেই ১২ বছর পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পাণ্ড্য ও কেরালার অনেক ছোট রাজ্য রাজেন্দ্র দখল করে নেন। পুত্রকে এ অঞ্চলগুলো দেখাশোনা করতে ভাইসরয় হিসেবে নিয়োগ দেন। মাদুরা ছিল ভাইসরয়ের আবাস।

১০২০ সালে রাজেন্দ্র পুরনো শত্রু পশ্চিমের চালুক্যদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। যুদ্ধের ফল মোটামুটি তার পক্ষে আসে। এরপর বিলম্ব না করে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পূর্ব দিগন্তে চোখ দেন রাজেন্দ্র। সুমাত্রার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বড় নৌবহর প্রেরণ করেন। মালয় উপসাগরে এ শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য ছিল অপ্রতিরোধ্য এক নৌ-শক্তি। ভারত থেকে চীনের সাগরপথ এরাই নিয়ন্ত্রণ করত। রাজরাজার সময় চোল ও শ্রীবিজয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু রাজেন্দ্রর আমলে সম্পর্ক যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এর কারণ নিয়ে ইতিহাসবিদেরা একমত নন। তবে দুটো বিষয়ের একটি এক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে তারা মনে করেন। ঘটনাটি ছিল এ রকম—১০১৬ ও ১০৩৩-এর চীনে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক দূত পাঠান রাজেন্দ্র। আর তিনি শ্রীবিজয় আক্রমণ করেন ১০২৫ সালে। অনেকে বলেন চীনের সঙ্গে রাজেন্দ্রর সম্পর্ক তৈরির চেষ্টাকে শ্রীবিজয় ভালোভাবে নেয়নি। তাই দুপক্ষের শত্রুতা তৈরি হয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন স্রেফ দিগ্‌বিজয়ের বাসনাতেই রাজেন্দ্র শ্রীবিজয় আক্রমণ করেন। কারণ যা-ই হোক রাজেন্দ্র শ্রীবিজয়ে সাফল্য পান। সেখানকার রাজাকে বন্দি করা হয়, রাজধানীর পতন হয়। চোলদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার শর্তে ক্ষমতা স্থানীয়দের হাতে দেয়া হয়। সুমাত্রায় পাওয়া তামিল লিপিতে জানা যায় ১০৮৮ সালেও চোল ও শ্রীবিজয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। 

রাজেন্দ্রর শেষ দিনগুলোয় পশ্চিমের চালুক্যসহ কেরালা, শ্রীলংকায় বিদ্রোহী মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠে। ১১১৫ সাল পর্যন্ত চোল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তৃতি অটুট ছিল। এর মধ্যে হারাতে হয়েছিল শুধু শ্রীলংকা। চোল শাসক তখন কুলোত্তুঙ্গ। উত্তরে কনৌজ, ইন্দো-চীনে কম্বোজার সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ঝামেলা শুরু হয় মহীশুর ও ভেঙ্গিতে। চালুক্যদের সিংহাসনে বসেন বিক্রমাদিত্য। কুলোত্তুঙ্গ ও বিক্রমাদিত্য উভয়ই নিজেদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে শত্রুতা ভুলে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ দেন। কুলোত্তুঙ্গ চোলদের সেরা শাসকদের একজন হিসেবে বিবেচিত। তিনি অহেতুক যুদ্ধ এড়ানোর নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এর সুফল পরবর্তী চোল শাসকরা পেয়েছিল। কুলোত্তুঙ্গর পর বিক্রম চোল, দ্বিতীয় কুলোত্তুঙ্গ, দ্বিতীয় রাজরাজের আমল শান্তিপূর্ণই ছিল। এরপর ত্রয়োদশ শতাব্দী শুরু হতে হতে চোলদের সূর্য তাদের উঁচু মন্দিরগুলোর চূড়াকে আর আলো দিতে পারছিল না। আর সব সাম্রাজ্যের মতো চোলদের শাসনও কালের ইতিহাসে হারিয়ে গিয়ে গ্রন্থের পাতায় ঠাঁই নিল।

লেখার শেষ প্রান্তে চোলদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে দুকথা বলা যায়। বিচার হতো তিনটি কাঠামোয়—রাজকীয় দরবার, গ্রামের আদালত ও বিভিন্ন বর্ণের পঞ্চায়েতে। রাজদ্রোহের বিচার করতেন স্বয়ং রাজা। সাধারণ অপরাধের সাজা ছিল জরিমানা ও কারাদণ্ড। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চীনা লেখক চাউ জু-কুয়া লিখেছেন, সাধারণ অপরাধের জন্য অপরাধীকে কাঠের কাঠামোয় বেঁধে ৫০ থেকে ১০০ বেত্রাঘাত করা হতো। আর ভয়ানক অপরাধের জন্য শিরশ্ছেদ করা হতো অথবা হাতির পায়ের তলায় পিষে মৃত্যু নিশ্চিত করা হতো।

এস এম রশিদ: লেখক