সিল্করুট

তাঞ্জোরের বৃহদীশ্বর

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

বৃহদীশ্বর মন্দিরে ১ হাজার বছর পুরনো তামিল শিলালিপি। ছবি: ক্যারটি জ্যাজ/উইকিমিডিয়া কমনস

তামিলনাড়ুর জেলা শহর তাঞ্জোর, বর্তমান নাম তাঞ্জাভুর, হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে চোল সম্রাট বিজয়ালয় এখানে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এ শহরকে বিশ্বদরবারে চিনিয়েছে এখানকার বিখ্যাত এবং বিশাল শিব-মন্দির, বৃহদীশ্বর বা দ্য বিগ টেম্পল।

তাঞ্জোরে বৃহদীশ্বর মন্দির ছাড়া অন্য দ্রষ্টব্যও বেশ কয়েকটি আছে। যেমন নায়ক রাজাদের প্যালেস এবং মিউজিয়াম, তাঞ্জোরের বিখ্যাত ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলোর একটি আলাদা সংগ্রহশালা, সরস্বতী মহল লাইব্রেরি প্রভৃতি। কিন্তু শুধু সে দ্রষ্টব্যগুলোর টানে কেউ তাঞ্জাভুর আসেন না, আসেন বৃহদীশ্বর দেখতে।

বৃহদীশ্বরের প্রতিষ্ঠাতা চোল সম্রাট রাজরাজা। এর রাজত্বকাল ৯৮৫-১০১২ সাল। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ১০১০-এ। অর্থাৎ মাত্র ২০১০-এ সহস্রবর্ষ পূর্ণ হয়েছে এ মন্দিরের। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল আয়তাকার চত্বরের মধ্যমণি বৃহদীশ্বরের সুউচ্চ মন্দির হলেও চত্বরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আরো নানাবিধ আলাদা স্থাপত্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নন্দী-মণ্ডপ, বৃহন্ন্যায়কী মন্দির, নটরাজের মন্দির, চণ্ডীকেশ্বরের মন্দির, সুব্রহ্মণ্য মন্দির, গণেশের মন্দির ও কারুভুর দেভারের মন্দির। কারুভুর দেভার হলেন সম্রাট রাজরাজার গুরু। এ মন্দিরগুলোর সবই যে রাজরাজাই নির্মাণ করিয়েছিলেন, তা নয়। রাজরাজার অনেক পরে এগুলোর বেশির ভাগ তৈরি হয়েছিল। এমনকি চোল সাম্রাজ্যের পতনের পর পাণ্ড্য এবং নায়ক বংশীয় বা তারও পরের মারাঠা শাসকদের আমলেও বেশকিছু সংযোজন লক্ষ করা গেছে বৃহদীশ্বরের চত্বরে।

এখানকার মূল মন্দিরটির প্রধান তিনটি অংশ। প্রথমত, গর্ভগৃহকে বেষ্টন করে চতুষ্কোণ মন্দির ও তার ওপরের বিমান। দ্বিতীয়ত, তার সামনের একাধিক স্তম্ভবিশিষ্ট হলঘর বা মণ্ডপ এবং তৃতীয়ত, তারও সামনে প্রবেশপথ ও বারান্দা। পূর্বমুখী মন্দিরের সামনের উঠোনে আছে ধাতব ধ্বজস্তম্ভ এবং তারও পুবে উঁচু প্লিন্থওয়ালা, চারদিক খোলা মণ্ডপের নিচে কষ্টিপাথরে তৈরি শিবের বাহন নন্দীর ষণ্ডরূপী মূর্তি।

বৃহদীশ্বর দর্শনে আসা পর্যটক বা ভক্তকে কিন্তু নন্দীর মণ্ডপ পর্যন্ত পৌঁছতে পার হতে হয় দুটি প্রবেশ তোরণ। তোরণগুলোর ওপরে একাধিক দেবদেবী, ভৈরব, রক্ষ-যক্ষর মূর্তি বসানো গোপুরম। অবশ্য দক্ষিণের মন্দিরের গোপুরম বলতে চোখের সামনে যা ভেসে ওঠে, তেমন গোপুরম নয়। এগুলো অনেক নিচু আর ছড়ানো। প্রায় প্রত্যেক নামি দেব-দেবীর একাধিক সুন্দর মূর্তি এ গোপুরমগুলোর ওপরে দেখতে পাওয়া যায়।

মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দির বা শ্রীরঙ্গমের রঙ্গনাথস্বামীর মন্দিরের শোভা তাদের একাধিক গোপুরমে, বৃহদীশ্বরের শোভা গর্ভগৃহের ওপরের টাওয়ার বা বিমানে। নিচ থেকে ওপরে ছোট হতে থাকা পিরামিডের আকৃতির বিমানটিকে বিশেষজ্ঞরা বলেন দ্রাবিড় রীতিতে নির্মিত মন্দিরের সর্বোত্তম উদাহরণ। এ বিমান বা শিখর অলংকৃত হয়েছে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি ছাড়াও ছোট আকারের মন্দির, নকশা, হংস-ময়ূর-মকর-ষাঁড় প্রভৃতি প্রাণীর মূর্তি প্রভৃতি দিয়ে।

বিমানের একেবারে ওপরে যে অর্ধগোলাকার গম্বুজের মতো পাথরটি বসানো আছে, তার গায়েও অলংকরণ বা মূর্তি খোদাই করা। এটির ওজন নাকি ৮১ টনের সামান্য বেশি। শোনা যায়, এটিকে অত উঁচুতে তুলতে শিখরের চারদিক বালি দিয়ে ঢেকে ঢালু রাস্তা বানাতে হয়েছিল। রাস্তার ঢাল বিস্তৃত ছিল সাড়ে ছয় কিলোমিটার পূর্বদিকে সারাপাল্লম গ্রাম পর্যন্ত। সেখান থেকে একাধিক হাতি দিয়ে টানিয়ে ওপরে তুলতে হয়েছিল তিরুচিরাপল্লীর থেকে তৈরি করিয়ে আনা পাথরের গম্বুজটিকে।

বিশাল আকৃতির শিখর ও গম্বুজের ওজন বওয়ার জন্য স্বভাবতই গর্ভগৃহকে ঘিরে বানাতে হয়েছিল দুই সারি দেয়াল। আর গর্ভগৃহের শিবলিঙ্গ এতই উঁচু (প্রায় চার মিটার) সে অনুপাতে গর্ভগৃহের দেয়ালকেও উঁচু করতে হওয়ায় দেয়ালের মাঝ বরাবর দুটি সারির মাঝে একটি তল বা ফ্লোরও রাখতে হয়। ফলে গর্ভগৃহকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে একটি গলিপথের। পূর্বদিকে প্রবেশপথ। তাই এদিকে গলি বা অলিন্দ নেই।

ওপরতলার অলিন্দের ভেতরের দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে খোদিত মহাদেবের ৯৮টি মূর্তি। এগুলো সবক’টি নৃত্যরত এবং প্রতিটির ভঙ্গিমা আলাদা। বিদগ্ধজনরা বলেন, ‘‌এ ভঙ্গিগুলো নাট্যশাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে ১০৮ ভঙ্গিমা বা ‘করণ’-এর ভাস্কর্যরূপ। এখানে ১০টি মূর্তি কম। দেয়ালের উত্তর-পূর্বে ১০টি মূর্তির জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। এখানে পূর্বদিকে, যেদিকে অলিন্দ নেই, সেখান থেকে ওপরে দেখা যায় পিরামিডের আকারের বিমানের ভেতরের ফাঁপা অন্দরমহল। 

নিচের অলিন্দের বিশেষত্ব হলো হাজার বছরের পুরনো দেয়ালচিত্র। যদিও মারাঠা রাজত্বে এ ছবিগুলোর ওপর রঙ চাপিয়ে কিছু কেরাদানি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন সে যুগের শিল্পীরা, পরে সে আস্তরণ উঠিয়ে পুরনো ছবি কিছুটা উদ্ধার করা গেছে। প্রায়ান্ধকার সংকীর্ণ গলিপথে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করেছেন পুরাতত্ত্ব বিভাগ। কিন্তু তাদের বিশেষ অনুমতি ছাড়া ওখানে যাওয়া সম্ভব নয় সাধারণ পর্যটকের। অজন্তার শেষ ছবির ২৫০-৩০০ বছরের মধ্যে আঁকা ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মহাদেবের বিভিন্ন রূপ, সাধক সুন্দরার এমনকি সম্রাট রাজরাজার অবয়বও।

বৃহদীশ্বর গোপুরম বা শিখরে অজস্র দেবদেবীর মূর্তি ছাড়া সব মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পিলাস্টারের মাঝের একাধিক কুলুঙ্গিতে রয়েছে বিষ্ণু, দুর্গা, লক্ষ্মী, গণেশ, ভূদেবী, শ্রীদেবী, বীরভদ্র প্রমুখের মূর্তি এবং নানারূপে মহাদেবের মূর্তি। তাদের কোনোটির নাম ত্রিপুরান্তক, কেউ কালান্তক, কখনো তিনি অর্ধ নারীশ্বর, কখনো নটেশ, কোনো মূর্তিতে হরিহর রূপে কিংবা ভিক্ষাত্মমূর্তিতে বা নটরাজরূপে। গর্ভগৃহের বাইরের দেয়ালে পশ্চিম দিকে একটি বিশেষ মূর্তি হলো মহাদেবের লিঙ্গোদ্ভবমূর্তি। দেখা যায় শিবলিঙ্গের মধ্যে ডিম্বাকার খোলা পথে মহাদেব আবির্ভূত হচ্ছেন।

প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট রাজরাজা এ মন্দিরের নাম দিয়েছিলেন রাজরাজেশ্বরম-উদায়ার। মন্দিরের পোতা বা প্লিন্থের দেয়ালে তামিল লিপিতে লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন মন্দির তৈরির ইতিহাস। শুধু মন্দির নয়, সম্রাট প্রথম রাজরাজা ও তার পুত্র, বিখ্যাত সম্রাট রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকাল সম্পর্কিত বহু তথ্য এ লিপি থেকে জানতে পেরেছেন ইতিহাসবিদরা।

তাঞ্জাভুর বিখ্যাত এ অঞ্চলের উর্বর জমিতে ধান উৎপাদনের জন্য। বলা হয় ‘রাইসবোল অব তামিলনাড়ু’। পর্যটকদের পছন্দ এখানকার স্বর্ণ এবং রুপার গহনা আর শিল্পপ্রেমীদের আকর্ষণ করে তাঞ্জোরে তৈরি ব্রোঞ্জ বা অন্য ধাতুর মূর্তি বা শিল্পদ্রব্য। তাছাড়া তাঞ্জোর শৈলীর পৃথিবী বিখ্যাত চিত্রকলা তো আছেই।

পরিচ্ছন্ন শহর তাঞ্জোর। আরো পরিচ্ছন্ন বৃহদীশ্বর মন্দির। যেখানে সেখানে জল-কাদা-ফুল-পাতা-আবর্জনা নেই। পূজার ডালা বিক্রেতাদের চিৎকার, পাণ্ডা বা পূজারিদের জুলুম নেই। আসলে ‘পাণ্ডা’ ব্যাপারটাই নেই। দেব-দর্শনার্থীদের লাইনে চ্যাঁচামেচি-ঠ্যালাঠেলি নেই। খালি পায়ে প্রায় ঘণ্টা চারেক ঘুরে দেখতে হয়েছিল বৃহদীশ্বর ও চত্বরের অন্য মন্দিরগুলো। বিশ্বাস করুন, একটুও কাদা, ধুলো বা ময়লা লাগেনি পায়ে।

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত: নন-ফিকশন লেখক