বিশেষ সংখ্যা

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ইসলামিয়া কলেজ


[বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় থাকতেন বেকার হোস্টেলে। তার জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪ নম্বর কক্ষ। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইসলামিয়া কলেজে অধ্যায়নের সময় তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান প্রবলভাবে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সে সময়ের ঘটনাবহুল দিনগুলো পরবর্তী সময়ে উঠে এসেছে তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। বইটি থেকে নির্বাচিত অংশ এখানে সংকলিত হলো]

‘পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা সমাবেশে যোগদান করি। মাদারীপুর যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের কাছে এখন প্রায়ই যাই। তিনিও আমাকে স্নেহ করেন। মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে আমাকে বোঝাত। যুদ্ধের সময় দেশের অবস্থা ভয়াবহ। এই সময় ফজলুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহ সাহেবের মনোমালিন্য হয়। হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের হুকুম মানতে রাজি না হওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে। মুসলিম লীগ ও ছাত্রকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। আমিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এই বৎসর আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলে থাকতাম। নাটোর ও বালুরঘাটে হক সাহেবের দলের সাথে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীদের দুইটা উপনির্বাচন হয়। আমিও দলবল নিয়ে সেখানে হাজির হলাম এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করলাম, শহীদ সাহেবের হুকুম মত।’ (পৃষ্ঠা-১৫)

...

‘ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেক সাহেব ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই ছিল। ওয়াসেক সাহেব ছাত্রদের রাজনৈতিক পিতা ছিলেন বললে অন্যায় হবে না। বহুদিন তিনি “অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের” সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করেছেন বোধ হয় পনেরো বছর পূর্বে। তবুও তিনি পদ ছাড়বেন না। কেউ তার মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই তিনি বলতেন, “কে হে তুমি? তুমি তো ছাত্রলীগের সদস্য বা কাউন্সিলার নও; বের হয়ে যাও সভা থেকে।” প্রথমে কেউই কিছু বলত না তাঁকে সম্মান করে। প্রথম গোলমাল হয় বোধ হয় ১৯৪১ বা ১৯৪২ চুঁচুড়া সম্মেলনে। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আমরা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলাম, শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে গোলমাল হল না।’ (পৃষ্ঠা-১৬)

...

‘এই সময় ইসলামিয়া কলেজে আমি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি। অফিসিয়াল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাদের পরাজিত করালাম। ইসলামিয়া কলেজই ছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। পরের বছরও ১৯৪৩ সালে ইলেকশনে আনোয়ার সাহেবের অফিসিয়াল ছাত্রলীগ পরাজিত হল। তারপর আর তিন বৎসর কেউই আমার মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ইলেকশন করে নাই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ইলেকশন হত। আমি ছাত্রনেতাদের নিয়ে আলোচনা করে যাদের ঠিক করে দিতাম তারাই নমিনেশন দাখিল করত, আর কেউ করত না। কারণ জানত, আমার মতের বিরুদ্ধে কারও জিতবার সম্ভাবনা ছিল না। জহিরুদ্দিন আমাকে সাহায্য করত। সে কলকাতার বাসিন্দা, ছাত্রদের উপর তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। নিঃস্বার্থ কর্মী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধাও করত। চমৎকার ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে বক্তৃতা করতে পারত। জহির পরে ইসলামিয়া কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তবুও আমার সাথে বন্ধুত্ব ছিল। কিছুদিনের জন্য সে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় রেডিওতে চাকরি নিয়ে চলে আসায় আমার খুবই অসুবিধা হয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা-১৬-১৭)

...

‘এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম। আমার আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। যেমন পিরোজপুরের নূরুদ্দিন আহমেদ—যিনি পরে পূর্ব বাংলার এমএলএ হন। নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন—যদিও তিনি আনোয়ার হোসেন সাহেবের দলে ছিলেন, আমার সাথে এদের গোলমাল ছিল, তবুও আমার ওকে ভাল লাগত। বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান সাহেব (বহু পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল হন) আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হোস্টেল রাজনীতি বা ইলেকশনে আমার যোগদান করার সময় ছিল না। তবে তিনি আমার সাথে পরামর্শ করতেন। প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. আই. এইচ. জুবেরী। তিনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। যেকোনো ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে সোজাসুজি আলাপ করতাম এবং সত্য কথা বলতাম। শিক্ষকরা আমাকে সকলেই স্নেহ করতেন। আমি দরকার হলে কলেজের অ্যাসেম্বলি হলের দরজা খুলে সভা শুরু করতাম। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখেও দেখতেন না। মুসলমান প্রফেসররা পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। হিন্দু ও ইউরোপিয়ান টিচাররা চুপ করে থাকতেন, কারণ সমস্ত ছাত্রই মুসলমান। সামান্য কিছু সংখ্যক ছাত্র পাকিস্তানবিরোধী ছিল, কিন্তু সাহস করে কথা বলত না।’ (পৃষ্ঠা- ১৮)

...

‘এই সময় ছাত্রদের মধ্যে বেশ শক্তিশালী দুইটা দল সৃষ্টি হল। আমি কলকাতায় এসেই খবর পেলাম, আমাদের দিল্লি যেতে হবে “অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে” যোগদান করতে। তোড়জোড় পড়ে গেল। যাঁরা যাবেন নিজের টাকায়ই যেতে হবে। আনোয়ার হোসেন সাহেব তাঁর দলবল থেকে কয়েকজনকে নিলেন। টাকাও বোধহয় জোগাড় করলেন। আমি ও ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মীর আশরাফউদ্দিন ঠিক করলাম, আমরাও যাব আমাদের নিজেদের টাকায়। আমাদের পূর্বেই ডেলিগেট করা হয়েছিল। মীর আশরাফউদ্দিন ওরফে মাখন, বাড়ি ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার কাজী কসবা গ্রামে। আমার খালাতো বোনের ছেলে, ওর বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। যথেষ্ট টাকা রেখে গেছেন। ওর বাবা তখনকার দিনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম,“আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করব।” তিনি বললেন, “খুব ভাল, দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমান নেতাদের।” আমরা দুইজন ও আনোয়ার সাহেবের দলের কয়েকজন একই ট্রেনে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে রওয়ানা করলাম।’ (পৃষ্ঠা- ২৪-২৫)

...

‘১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা ছিল—বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। কলকাতায় সম্মেলন হলে কেউ আমাদের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যাহোক, শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকেও ভালবাসতেন। আনোয়ার সাহেব অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ঢাকার ছাত্রলীগ ও আমাদের সাথের কেউ আনোয়ার সাহেবকে দেখতে পারত না। একমাত্র শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই ঢাকায় আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন। 

শাহ সাহেব চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন। বগুড়ায় তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আনোয়ার সাহেব কলকাতা ও ঢাকায় কনফারেন্স করতে সাহস না পেয়ে কুষ্টিয়ায় শাহ আজিজুর রহমানের নিজের জেলায় বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকলেন। এই সময় আনোয়ার সাহেব ও নূরুদ্দিনের দলের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভও দেখালেন। আমি বললাম, আমার পদের দরকার নাই, তবে সবার সাথে আলোচনা করা দরকার। নূরুদ্দিন সাহেবের দলও আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালায়। একপক্ষ আমাকে নিতেই হবে, কারণ আমার এমন শক্তি কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না যে ইলেকশনে কিছু করতে পারব। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। জহির সাহেব ছাত্র আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামান না, মুসলিম লীগেরই কাজ করেন।’ (পৃষ্ঠা- ২৮)

...

‘একদিন হক সাহেব আমাদের ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। দাওয়াত নিব কি নিব না এই নিয়ে দুই দল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, “কেন যাবো না নিশ্চয়ই যাবো। হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগে ফিরে আসতে। আমাদের আদর্শ যদি এত হালকা হয় যে, তাঁর কাছে গেলেই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাবো, তাহলে সে পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের না করাই উচিত।” আমি খুলনার একরামুল হককে সাথে নিলাম, যদিও সে ইসলামিয়ায় পড়ে না। তথাপি তার একটা প্রভাব আছে। আমাকে সে মিয়াভাই বলত। আমরা ছয়-সাতজন গিয়েছিলাম। শেরে বাংলা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন এবং বললেন, “আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নাই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র।” আমরাও আমাদের মতামত বললাম। একরামুল হক বলল “স্যার, আপনি মুসলিম লীগে থাকলে আর পাকিস্তান সমর্থন করলে আমরা বাংলার ছাত্ররা আপনার সাথে না থেকে অন্য কারও সাথে থাকতে পারি না। ‘পাকিস্তান’ না হলে মুসলমানদের কী হবে?” শেরে বাংলা বলেছিলেন, “১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম! জিন্নাহকে চিনত কে?” আমরা তাঁকে আবার অনুরোধ করে সালাম করে চলে আসলাম।’ (পৃষ্ঠা- ৩৬)

...

‘শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, কোন সংকীর্ণতার স্থান ছিল না তাঁর কাছে। কিন্তু অন্য নেতারা কয়েকদিন খুব হাসি তামাশা করেছেন আমাদের সাথে। আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেইজন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই। কারণ সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম। একদিন বললাম,“স্যার, কোনো ছাত্র রোগগ্রস্ত হলে যে কামরায় থাকে, সেই কামরাটা আমাকে দিয়ে দেন। সেটা অনেক বড় কামরা দশ-পনেরজন লোক থাকতে পারে।” বড় কামরাটায় একটা বিজলি পাখাও ছিল। নিজের কামরাটা তো থাকলই।’ তিনি বললেন, “ঠিক আছে, দখল করে নাও। কোনো ছাত্র যেন নালিশ না করে।” বললাম, “কেউই কিছু বলবে না। দু’একজন আমার বিরুদ্ধে থাকলেও সাহস পাবে না।” (পৃষ্ঠা-৩৭)

...

‘বেকার হোস্টেলে কতগুলি ফ্রি রুম ছিল গরিব ছাত্রদের জন্য। তখনকার দিনে সত্যিকার যার প্রয়োজন তাকেই তা দেওয়া হত। আজকালকার মত টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত না। ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলে এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে।’ (পৃষ্ঠা- ৩৭-৩৮)

...

‘এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছুদিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই গ্রুপের মধ্যে আপোস করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে, নতুবা তাদের ইলেকশন করতে দেওয়া হোক। পূর্বের দুই বৎসর নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করেছি। ইলেকশন আবার শুরু হলে আর বন্ধ করা যাবে না। মিছামিছি গোলমাল, লেখাপড়া নষ্ট, টাকা খরচ হতে থাকবে। আমি বাধ্য হয়ে রাজি হলাম এবং বলে দিলাম তিন মাসের বেশি আমি থাকব না। কারণ, পাকিস্তান ইস্যুর ওপর ইলেকশন আসছে, আমাকে বাইরে বাইরে কাজ করতে হবে। কলেজে আসতেও সময় পাব না। আমি তিন মাসের মধ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদক করে দেই।’ (পৃষ্ঠা- ৩৮)

...

‘১৫ আগস্ট কে কোথায়, কোন এরিয়ায় থাকবে ঠিক হয়ে গেল। ১৬ আগস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হবে। সমস্ত এরিয়া থেকে শোভাযাত্রা করে জনসাধারণ আসবে। কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে সকাল ১০টায় জড়ো হবে। আমার উপর ভার দেওয়া হল ইসলামিয়া কলেজে থাকতে। শুধু সকাল সাতটায় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে। আমি ও নূরুদ্দিন সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হলাম। পতাকা উত্তোলন করলাম। কেউই আমাদের বাধা দিল না। আমরা চলে আসার পরে পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমরা কলেজ স্ট্রিট থেকে বউবাজার হয়ে আবার ইসলামিয়া কলেজে ফিরে এলাম। কলেজের দরজা ও হল খুলে দিলাম। আর যদি আধা ঘণ্টা দেরি করে আমরা বউবাজার হয়ে আসতাম তবে আমার ও নূরুদ্দিনের লাশও আর কেউ খুঁজে পেত না। ভাবসাব যে খারাপ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যখন ফিরে আসি। নূরুদ্দিন আমাকে কলেজে রেখে লীগ অফিসে চলে গেল। বলে গেল, শীঘ্রই ফিরে আসবে।

বেকার হোস্টেল থেকে মাত্র কয়েকজন কর্মী এসে পৌঁছেছে। আমি ওদের সভাকক্ষ খুলে টেবিল চেয়ার ঠিক করতে বললাম। কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী মন্নুজান হোস্টেল থেকে ইসলামিয়া কলেজে এসে পৌঁছেছেন। এরা সকলেই মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে হাজেরা বেগম (এখন হাজেরা মাহমুদ আলী), হালিমা খাতুন (এখন নূরুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী), জয়নাব বেগম (এখন মিসেস জলিল), সাদেকা বেগম (এখন সাদেকা সামাদ) তাদের নাম আমার মনে আছে। এরা ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল কয়েকজন ছাত্র রক্তাক্ত দেহে কোনোমতে ছুটে এসে ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছেছে। কারও পিঠে ছোরার আঘাত, কারও মাথা ফেটে গেছে। কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ এ জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েরা এগিয়ে এসে বললেন, “যারা জখম হয়েছে, তাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। পানির বন্দোবস্ত করেন।” কোথায় এরা কাপড় পাবে ব্যান্ডেজ করতে? যার যার ওড়না ছিঁড়ে খাড়ি কেটে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল। কাছেই হোস্টেল, তাড়াতাড়ি খবর দিলাম। এদের ব্যান্ডেজ করেই একজন পরিচিত ডাক্তার ছিলেন তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলাম।’ (পৃষ্ঠা- ৬৩-৬৪)

...

‘এই সময় মনস্থির করলাম, আমাকে বিএ পরীক্ষা দিতে হবে। ড. জুবেরী আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, “তুমি যথেষ্ট কাজ করেছ পাকিস্তান অর্জন করার জন্য। তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না। তুমি যদি ওয়াদা কর যে এই কয়েক মাস লেখাপড়া করবা এবং কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবা এবং ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই এসে পরীক্ষা দিবা, তাহলে তোমাকে আমি অনুমতি দিব।” তখন টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি ওয়াদা করলাম, প্রফেসর তাহের জামিল, প্রফেসর সাইদুর রহমান এবং প্রফেসর নাজির আহমদের সামনে। আমি অনুমতি নিয়ে আমার এক বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী—তার নাম ছিল শেখ শাহাদাত হোসেন, ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেছে, এখন হাওড়ার উল্টোডাঙ্গায় চাকরি করে, ওর কাছে চলে গেলাম, সমস্ত বইপত্র নিয়ে।’ (পৃষ্ঠা- ৭১)