সিল্করুট

হাজার বছরের প্রাচীন শহর

সগদীয় সাম্রাজ্যের একটি ম্যুরাল ছবি: কোরিয়া ডটনেট

সমরখন্দ সম্পর্কে উক্তিটি করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিজেতা সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তিনি দুনিয়ার বহু অঞ্চল জয় করেছেন। তার চেয়ে বেশি দেখেছেন। তাই সমরখন্দ সম্পর্কে তার এ উক্তিই শহরটির অনিন্দ্যসৌন্দর্য প্রকাশে যথেষ্ট। পৃথিবীর নানা প্রান্তের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত আলেকজান্ডারের চোখও সমরখন্দের শোভা দেখে ঝলসে গিয়েছিল। হার মানিয়েছিল তার সমস্ত কল্পনাকে। তাহলে সমরখন্দ দেখে সাধারণ দর্শনার্থীদের কী অনুভূতি হতে পারে, একবার ভেবে দেখুন! তাই সমরখন্দ প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।

বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি সমরখন্দ। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো। রোম ও এথেন্সের সমবয়সী। বর্তমানে এটি উজবেকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি শহর।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ সালে সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সমরখন্দ জয় করেছিলেন। তারপর এ শহরই হয়ে ওঠে সমগ্র মধ্য এশিয়ায় আলেকজান্ডারের সমর অভিযানের প্রধান সামরিক কেন্দ্র। আর এখানেই ঘটে যায় আলেকজান্ডারের জীবনের অন্যতম একটি দুর্ঘটনা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে অনুষ্ঠিত গ্রেনিকাসের যুদ্ধে মেসিডোনিয়ার সম্রাটের জীবন বাঁচিয়েছিলেন সেনাপতি ক্লেইটাস। কিন্তু সমরখন্দে তার সঙ্গে এক পানের আসরে সম্রাটের বচসা বাধে। এক পর্যায়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্লেইটাসকে হত্যা করেন আলেকজান্ডার। দিগ্বিজয়ী সম্রাটের জীবনে এটি একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। আর সে অধ্যায় রচিত হয়েছে একাধারে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সমরখন্দে। গ্রিকদের কাছে শহরটি মারাকান্দা নামে পরিচিত ছিল। গ্রিক সূত্রানুসারে, সম্রাট আলেকজান্ডার অরিপিয়াস নামের একজনকে সমরখন্দের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। আলেকজান্ডারের বাহিনীর অভিযানকালে এ শহরের স্থাপনাগুলোর কিছুটা হানি হয়েছিল। কিন্তু হেলেনিক সভ্যতার প্রভাবে সমরখন্দ দ্রুত তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পায় এবং তার সমৃদ্ধি আরো বেড়ে যায়। সে সময় স্থাপত্যকৌশলেও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাণের ক্ষেত্রে আয়তাকার ইটের জায়গা নিয়েছিল বর্গাকার ইট। স্থানীয় কারিগররা গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।


আলেকাজান্ডার দ্য গ্রেটের অভিযানের আরো ২০০ বছর আগে সমরখন্দ জয় করেছিলেন আরেক বিশ্ববিজেতা সাইরাস দ্য গ্রেট। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে তিনি সমরখন্দকে আকিমেনিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্রথম পারস্য সাম্রাজ্য আকিমেনিড। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে সাইরাস এ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দারিয়ুস দ্য গ্রেটের শাসনামলে সগদিয়ানা সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় সমরখন্দ। আমু দরিয়া ও সির দরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন এ পারস্য সাম্রাজ্য। বর্তমান উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান নিয়ে গঠিত ছিল সগদিয়ানা সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যের অধিবাসী মানুষের সাধারণ ভাষা ‘সগদীয় ভাষা’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে ভাষাটির কোনো প্রচলন নেই। এটি একটি মৃত ভাষা। কিন্তু সমরখন্দ নামটি এসেছে এ সগদীয় ভাষা থেকেই। সগদীয় শব্দ ‘সমর’ ও ‘খন্দ’-এর মেলবন্ধনে তৈরি শহরটির নাম। সমর অর্থ পাথর। আর খন্দ অর্থ দুর্গ। সমরখন্দ শব্দের অর্থ পাথরের দুর্গ। বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর তাসখন্দের নামের অর্থও একই। তুর্কি শব্দ ‘তাস’ অর্থ পাথর। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে সমরখন্দে সগদিয়ানা সাম্রাজ্যের কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রাচীন সগদীয় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সগদীয় শাসনামলে সমরখন্দের ইতিহাস সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে তখন থেকেই ব্যাবিলনীয়, আসিরীয় ও পারসীয় পর্যটকরা চীন যাওয়ার পথে সমরখন্দ ভ্রমণ করতেন। শহরটি প্রাচীন সিল্ক রোডের সংলগ্ন ছিল। ফলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও প্রাচ্যের মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছিল সমরখন্দ।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর সিলিউসিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় সমরখন্দ। একপর্যায়ে এ সাম্রাজ্যের অধীন ব্যাক্ট্রিয়ার প্রশাসক ডিওডোটাস নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। তিনি গ্রেকো-ব্যাক্ট্রীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমরখন্দকে এ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। 

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কুশান সাম্রাজ্য। বর্তমান উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ সুবিশাল সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসকের নাম সম্রাট কনিষ্ক। কুশানদের হাতে গ্রেকো-ব্যাক্ট্রীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সমরখন্দ তখন কুশান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এ পর্যন্ত অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির কেন্দ্র ছিল সমরখন্দ। কিন্তু তিন শতকে সগদিয়ানার নিয়ন্ত্রণ হারায় কুশানরা। তার পর থেকে সমরখন্দের গুরুত্ব কমতে থাকে। পাঁচ শতক পর্যন্ত সমরখন্দ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ সময়ে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি সাম্রাজ্যের অধীন ছিল সমরখন্দ। সে তালিকায় প্রথমে আসবে পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের নাম। সাসানীয় শাসনামলে সমরখন্দসহ সমগ্র মধ্য এশিয়ায় পারস্য ধর্ম মনিবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ৩৫০-৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে জায়োনাইট নামে একটি যাযাবর জাতি সমরখন্দ শাসন করেছিল। সমরখন্দ থেকে পাওয়া চার শতকের কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জায়োনাইটদের শাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ৪৫৭-৫০৯ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দ কিদারা হুন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর সমরখন্দ হেফথালাইট সাম্রাজ্যের অধীনে যায়। তারপর তুর্কি যাযাবর জাতি গোকতুর্ক পারস্যের সাসানীয়দের সঙ্গে জোট বেঁধে ৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বুখারার যুদ্ধে হেফথালাইটদের পরাজিত করলে সমরখন্দ তাদের দখলে চলে যায়।

সাত শতকে চীনের ট্যাং সাম্রাজ্য সিল্ক রোড পুনরায় খুলে দিলে সমরখন্দ পুনরুজ্জীবিত হয়। সমরখন্দ আবার ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে শহরটির সম্পদ। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সমরখন্দে ছয় থেকে আট শতকে নির্মিত বহু অভিজাত অট্টালিকার নিদর্শন পাওয়া গেছে।

ট্যাং সাম্রাজ্যের কাছ থেকে সমরখন্দ আরবদের দখলে আসে। ৭১০ সালে উমাইয়া সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে তারা সমরখন্দ জয় করেছিল। কুতাইবা ইবনে মুসলিম সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। শহরের অধিকংশ অধিবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তারপর ইসলামী ও আরব সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয় সমরখন্দ। এক পর্যায়ে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইসলামী জগতের শাসনক্ষমতা দখল করে আব্বাসীয়রা। সমরখন্দ তখন আব্বাসীয়দের দখলে আসে। আব্বাসীয় সেনাপতি আবু মুসলিম তার বাসস্থান হিসেবে সমরখন্দকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি সমরখন্দের চারপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সুরক্ষাপ্রাচীর তৈরি করিয়েছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে, আব্বাসীয়রা দুজন চীনা বন্দির কাছ থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া জেনে নিয়েছিল। সে জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সমরখন্দে ইসলামী জগতের প্রথম কাগজ কল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

৮৭৫-৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সামানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সমরখন্দ। সামানীয়দের পরাজিত করে ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে তুর্কি কারাখানি সম্প্রদায় সমরখন্দের শাসনক্ষমতা দখল করে। ১১ শতকে কারাখানি শাসকদের তত্ত্বাবধানে সমরখন্দের বিখ্যাত শাহ-ই-জিন্দা মেমোরিয়াল কমপ্লেক্সটি তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী ২০০ বছর ধরে সেলজুক ও খোরেজমশাহর মতো কয়েকটি তুর্কি বংশের মাধ্যমে সমরখন্দ শাসিত হয়েছিল।

প্রাচীন যুগে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে নানা উত্থান-পতন নিয়ে সমরখন্দ অস্তিত্বশীল ছিল। অনেক শাসক এসেছে, গেছে; সমরখন্দ কিন্তু টিকে আছে আপন মহিমায়।


মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক