সিল্করুট

হিরাম কক্সের বার্মা ডায়েরি

হারুন রশীদ


অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে আরাকান রাজ্য দখল করে নিয়েছিলেন বার্মার রাজা বোধপায়া। বার্মিজ অত্যাচারে হাজার হাজার আরাকানি নাফ নদী পার হয়ে ব্রিটিশ অধিকৃত চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। সে রকম একটা সময়ে বার্মায় ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য তিনি কলকাতা থেকে জাহাজে চড়ে রেঙ্গুনে পৌঁছেন ১৭৯৬ সালের অক্টোবরে। তার সঙ্গে ছিল বার্মার রাজার প্রতি ভারতের গভর্নর জেনারেল জন শোরের লেখা চিঠি উপহার। বার্মার রাজধানী তখন রেঙ্গুনের কয়েকশ মাইল উত্তরে অমরাপুর। নদীপথে প্রায় দুই মাসের পথ। ক্যাপ্টেন কক্স রেঙ্গুন থেকে অমরাপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন ইরাবতী নদী হয়ে। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে রাজদর্শন হয়েছিল তার। সেইসব ঘটনার দিনলিপি ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল Journal of a Residence in the Burmhan Empire নামে। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ

অক্টোবর , ১৭৯৬ (রেঙ্গুন নদী)

জাহাজটা রেঙ্গুন নদীর কাছে পৌঁছার পর দেখা হয়ে গেল বার্মার রাজকীয় দোভাষীর সঙ্গে। তিনি একটা নৌকায় চড়ে আমার জন্য কিছু ফলমূল উপহার নিয়ে এসেছেন রেঙ্গুনের সাবুন্দার বা নগরপ্রধানের পক্ষ থেকে। তার কাছে শুনলাম নদীর প্রবেশপথে আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে একজন নাখান (বা সংবাদ বাহক) এবং একজন সেরচেডোগি (বা সংবাদ লেখক)

অক্টোবর , ১৭৯৬

আজ দুটো যুদ্ধ নৌকা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন নাখান এবং সেরচেডোগি। দুজনের সঙ্গে বেশ কয়েকজন সহকারীও আছে। প্রতিটি নৌকা দশটি দাঁড়ে চালিত। তাদের সঙ্গে একটা বাদক দলও ছিল, যাদের হাতে ব্যাগপাইপের মতো বাঁশি। এই বাদ্যকে বার্মিজ ভাষায় টমটম বলে। যাত্রীদের আসনগুলো সামনের দিকে ছই দেয়া একটা প্লাটফর্মের ওপর তৈরি করা। পেছনের অংশের উচ্চতা জলের স্তর থেকে অন্তত ছয় ফুট উঁচু। দাঁড়িরা বসেছে দুটো কাঠের পাটাতনের ওপর। দাঁড়গুলো ছোট ছোট। নৌকার পশ্চাদভাগ লেজের আকৃতি। তারা আমার জাহাজে উঠে সাধারণ সৌজন্য আলাপ পরিচয় সেরে চলে গেলেন।

অক্টোবর ১০, ১৭৯৬

শহরের কাছে পৌঁছার পর আমার ব্যক্তিগত সহকারী মি. বারনেটকে তীরে পাঠালাম নগরপ্রধানকে আমার আগমনবার্তা জানানোর জন্য। বললাম, কোম্পানির জাহাজ শহরে আগমন উপলক্ষে তেরোবার তোপধ্বনি করবে। নগরের পক্ষ থেকেও একই সংখ্যক তোপধ্বনি করা চাই। রাজার জন্য আনা উপহারসামগ্রী এবং আমার মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটি নৌকা লাগবে। নগরপ্রধান সাবুন্দার তাতে সম্মত হলেন এবং বললেন যে আমাকে বরণ করার জন্য রাজার গোডাউন অর্থাৎ কাস্টম হাউজকে প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সেই জায়গাটা হলো সাধারণ লোকের নৌকা তল্লাশির জায়গা, আমি চাই না সাধারণ লোকের মতো শহরে প্রবেশ করতে। আমি মি. বারনেটকে পাঠিয়ে জানালাম ওই ধরনের রিসেপশন আমি চাই না। তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতে পারে আমার জাহাজে অথবা আমার জন্য নির্ধারিত বাড়িতে। ক্যাপ্টেন সাইমেসের আগমনের সময় যে রকম ব্যবস্থা হয়েছিল, এখনো সে রকম ব্যবস্থা থাকা চাই। সাবুন্দার প্রথমে আমার প্রস্তাবে মৃদু আপত্তি জানালেও পরে কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলাপ করে সম্মতি দিলেন।

অক্টোবর ১১, ১৭৯৬

উপহারসামগ্রী নেয়ার জন্য সকালবেলা চল্লিশ দাঁড়ের দুটো যুদ্ধ নৌকা এল দুজন সরকারি কর্তাকে নিয়ে। আমি একজন নায়েক এবং ছয়জন সিপাহি দিয়ে মি. বারনেটকে পাঠালাম। নৌকাগুলো যখন জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হলো, তখন তোপধ্বনি করা হলো আমারসোয়ালোজাহাজ থেকে। সন্ধ্যার সময় আমার জিনিসপত্রগুলো তীরে পাঠিয়ে দিলাম। আমি পরদিন বারোটার সময় তীরে নামব।

অক্টোবর ১২, ১৭৯৬

দুপুর ১২টার সময় সোয়ালো জাহাজ থেকে নামার সময় ক্যাপ্টেন সিম্পসন তোপধ্বনির মাধ্যমে আমাকে বিদায় জানালেন। শহরের বাহিনী আমাকে পনেরোটা তোপধ্বনি দিয়ে সম্মান করল। তীরে আমাকে নেয়ার জন্য এসেছেন নগরপ্রধান বা সাবুন্দার মি. ঝানসে। তার সঙ্গে আছেন এই প্রদেশের শুল্ককর্তা বাবু সিং। আমি শহরের রাস্তা দিয়ে আমার জন্য নির্ধারিত আবাসস্থলের দিকে রওনা দিলাম। কাস্টম হাউজ পার হওয়ার সময় একদল বাদক আমার উদ্দেশে বাদ্য বাজনা বাজিয়ে শোনাল। আরো একদল স্বাগত নৃত্য পরিবেশন করল। আমি দশ মিনিট দাঁড়িয়ে নৃত্য উপভোগ করলাম।

অক্টোবর ১৩, ১৭৯৬

সকাল ১০টার দিকে মি. ঝানসে এবং বাবু সিং আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সৌজন্য বিনিময় শেষে আমরা কাজের কথায় আসলাম। আমি তাদের আমার পদবি, কোম্পানি আমাকে এখানে কেন পাঠিয়েছে ইত্যাদি সম্পর্কে বললাম। আমার কাজ শুরু করার জন্য রাজার অনুমতি প্রয়োজন সেজন্য আমি একটা পত্র পাঠাতে চাই রাজধানী অমরাপুরে। তারা বললেন, কোনো অসুবিধা নাই। আমার পত্র পাঠিয়ে দেবে বাহক মারফত।

নভেম্বর ১১, ১৭৯৬

আজ মি. ঝানসে দেখা করতে এলেন। তিনি জানালেন আগামীকাল সকালে তিনি রেঙ্গুন থেকে রাজধানী অমরাপুরের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। সন্ধ্যার সময় আমি একটা বার্মিজ নৃত্যের আসরে যোগ দিলাম। দশ বছর বয়সী একটা বালিকার নাচ দেখে খুব মুগ্ধ হলাম।

নভেম্বর ১৪, ১৭৯৬

এখানকার একটা বড় প্যাগোডা দেখতে গেলাম। আমার এখানকার গাইড পয়জার বাড়ি কাছেই। সে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখান থেকে প্যাগোডার দিকে গেলাম। ওখানে মি. বারনেট এবং আমার জন্য কার্পেট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করল। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত নানা বয়সী নারী-পুরুষ তাদের অর্ঘ্য দেবার জন্য আসে মন্দিরে। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এই মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে জুতো খুলতে হবে। কিন্তু আমি দেখলাম ইউরোপিয়ান আর নেটিভ খ্রিস্টানদের অনেকে এই নিয়ম ভঙ্গ করছে।

নভেম্বর ১৮, ১৭৯৬

সকালে জানা গেল, যে নৌকাটাকে আমার চিঠি নিয়ে অমরাপুরে পাঠানো হয়েছিল সেটা ফিরে এসেছে রাজার আদেশ নিয়ে। রাজা আদেশ করেছেন একটা নৌকা দিয়ে আমাকে যেন অবিলম্বে অমরাপুর পাঠিয়ে দেয়া হয়।

নভেম্বর ২০, ১৭৯৬

সেরচেডোগি এসে আমার কাছে জানতে চাইলেন অমরাপুর যাওয়ার জন্য আমার কয়টি নৌকা লাগবে। আমি বললাম আমার ছয়টি নৌকা লাগবে। একটা আমার ঘুমানোর জন্য, একটা খাবার নৌকা, একটা মি. বারনেটের জন্য, একটা চাকরবাকরের জন্য, একটা দোভাষীর জন্য আর একটা রান্নাবান্নার জন্য।

ডিসেম্বর , ১৭৯৬

ভোর পাঁচটায় জোয়ারের সময় রেঙ্গুন থেকে অমরাপুরের উদ্দেশে আমাদের নৌকা ছাড়ল। নদীটা এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে গেছে। নদীর প্রস্থ কোথাও ২৫০ গজ, আবার কোথাও ১০০ গজেরও কম। কিন্তু গভীরতা যথেষ্ট বেশি বলে এই নদীতে জাহাজ চলতেও কোনো সমস্যা হয় না। নদীর দুই তীরে সমভূমি। দুই দিকেই ফসলের ক্ষেত এবং ছড়ানো-ছিটানো ঘরবাড়ি। সন্ধ্যার দিকে আমরা পোয়ালাইন নামের একটা জায়গায় পৌঁছালাম। এখানে নদীটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা চলে গেছে দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, আরেকটা উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে।

ডিসেম্বর , ১৭৯৬

আজ আমরা নদীর যে অংশে প্রবেশ করলাম, ওই অংশের নাম স্থানীয় ভাষায় ইরাবতী। ওটার পূর্ব তীরে একটা শহর আছে, ওটার নাম ইয়োগুন। মোহনার কাছে ইরাবতী ৭০০ গজের মতো প্রশস্ত। এটা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে সমুদ্রে পড়েছে ব্রোগি নদীর মাধ্যমে।

ডিসেম্বর ২৩, ১৭৯৬

সকালবেলা আমরা প্রোন নামের একটা শহরের কাছে পৌঁছালাম। এখানে আমাদের ঘণ্টাখানেক দাঁড়াতে হলো কাস্টম হাউজের চৌকিতে। তারপর শহর ছাড়িয়ে আরেকটু সামনের একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। এখান থেকে নদীর পূর্ব দিকে একটা পার্বত্য ছড়া আছে। ওটা দিয়ে পূর্ব দিকের পার্বত্য এলাকা দিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাঠের চালান আসে। এখানে আমাদের যাত্রাবিরতি হবে।

ডিসেম্বর ২৪, ১৭৯৬

আজ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন এই শহরের এক রাজকুমারী। তার পরনে সিল্কের বাজু, সিল্কের লুঙ্গি আর কাঁধের ওপর একটা ওড়না। হাতে নানান মূল্যবান পাথরখচিত সোনার আংটি। চুলগুলো পরিপাটি করে খোঁপা করা। অবিবাহিতা এই নারীর পিতা এই নগরের শাসক। সঙ্গে এসেছেন আরো কয়েকজন কর্মকর্তার স্ত্রী। তিনি প্রথমে আমার নৌকায় উঠতে রাজি হননি। কিন্তু যখন গাইড সৈন্যটা সরে গেল, তখন তিনি নৌকায় উঠলেন। উঠে আমার কেবিনের দরোজার পাশে একটা কাঠের প্লাটফর্মে বসলেন। কথাবার্তায় তিনি খুব আন্তরিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাকে জানাতে বললেন। সঙ্গীদের চেয়ে তিনিই বেশি কথা বললেন এবং বারবার ক্ষমা চাইলেন তার অযাচিত নারীসুলভ কৌতূহলের জন্য। যাবার সময় আমি তাকে বেশ কয়েকটা বাঁশি, মসলা, গোলাপজল আর মিষ্টি উপহার দিলাম। ঘণ্টাখানেক গল্প করার পর তিনি ফিরে গেলেন। ফিরে যাবার পর তিনি আমার জন্য নানা ধরনের খাবারদাবার পাঠালেন। তার পিতাকে বললেন আমার জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করতে।

ডিসেম্বর ২৬, ১৭৯৬

দুপুরের দিকে আমরা ইরাবতী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত কোমা শহরের কাছে পৌঁছালাম। এই শহরটা কাঠের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। শহরে অসংখ্য ধর্মশালা মাথা উঁচু করে আছে। একটা দুর্গ আছে তিন মাইল ভেতরে ছোট একটা নদীর তীরে। সেই নদীটাই এখানে এসে ইরাবতীর সঙ্গে মিশেছে। এই নদীপথে আরাকান থেকে বড় বড় নৌকায় নানান পণ্যদ্রব্য আসে। এদিকে একটা উঁচু রাস্তাও দেখা গেল যেটা দিয়ে ঢাকা শহর পর্যন্ত বাণিজ্যিক পণ্য যায় গরুর গাড়িতে করে।

ডিসেম্বর ২৭, ১৭৯৬

আমরা পেত্রো নামক একটা শহরে থামলাম। এখানে অনেক লোকের বসবাস। চারপাশের জমিতে বেশ ভালো চাষাবাদ করা হয়েছে। এখানে প্রথমবারের মতো সেগুন গাছের দেখা পেলাম নদীতীরে। এখানকার পাহাড়ে প্রচুর সেগুন গাছ আছে। ভারতবর্ষে ধারণা করা হয় যে বার্মার সেগুন গাছগুলো শুধু সমভূমিতে জন্মায়। এখানে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ই তাদের আবাস।

জানুয়ারি , ১৭৯৭

আজ এখানকার সাধারণ শ্রমিকদের স্বাধীনচেতা চরিত্রের একটা দৃষ্টান্ত দেখলাম। আমার নৌকার মাঝিরা হঠাৎ করে দলবল নিয়ে তীরে নেমে গেল। নেমে গিয়ে বলল, লাইদাইঘী (নৌকার মালিক/কন্ট্রাকটর) তাদের বাকি টাকা মিটিয়ে না দিলে তারা আর এগোবে না। মাঝিরা এই যাত্রার জন্য রেঙ্গুন থেকে রওনা দেয়ার আগে ১৫ টিকাল (টাকা) অগ্রিম নিয়েছিল। রেঙ্গুন থেকে অমরাপুরের ভাড়া হলো ২৫ টিকাল। এখন বাকি পথ পাড়ি দেয়ার আগেই তারা ১০ টিকাল দাবি করছে। সাধারণত এই পথটা যেতে দুই মাসের বেশি লাগে না। লাইদাইঘী বললেন যে টাকা নিয়ে পুরোটা পথ ঠিকমতো যাবে তার নিশ্চয়তা কী? এটা নিয়ে দুই পক্ষে বাড়াবাড়ি চলতে লাগল। শেষমেশ একটা আপসরফা হলো নৌকা মালিকের ব্যক্তিগত গ্যারান্টির মাধ্যমে। খেয়াল করলাম, সরকারি কর্তারা এসব বিষয়ে নাক গলান না। পুরো বিতর্কের সময়টাতে তারা দর্শক হয়ে ছিলেন।

জানুয়ারি ২৪, ১৭৯৭

সকালবেলা আমরা চেগেইং নামের প্রাচীন আভা নগরীর কাছে পৌঁছালাম। এই নগরীর অবস্থান ইরাবতী নদীর পশ্চিম তীরে। এখান থেকে সামান্য গেলেই অমরাপুর।  দুপুরের আগেই আমরা অমরাপুরের কাছে পৌঁছালাম। অমরাপুরের অবস্থান নদীর পূর্ব তীরে। নদী থেকেই শহরের ঘরবাড়ি প্রাসাদ সবকিছু দেখা যাচ্ছে। এখানে নদীর প্রশস্ততা দুই মাইলের মতো। তবে মাঝখানের অংশগুলোর অধিকাংশই বালিয়াড়িতে পরিপূর্ণ দ্বীপে পরিণত হয়েছে। দ্বীপগুলো নদীকে একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত করেছে। সেই দ্বীপগুলোতে চাষাবাদ করা হয়েছে। আমাদের নৌকা নদীর উত্তর-পশ্চিম দিকের একটা শাখায় গিয়ে চেগেইং নগরের প্রান্তে নোঙর করল। তার উল্টোদিকে রাজধানী অমরাপুর। বর্মি গাইড জানাল, রাজার অনুমতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে হবে।

জানুয়ারি ২৫, ১৭৯৭ফেব্রুয়ারি , ১৭৯৭ (রাজদর্শন অভিজ্ঞতা

রাজার অনুমতি নেয়ার জন্য লোক পাঠানো হলো নগরীতে। জানা গেল রাজা এখন রাজধানীতে নেই। তিনি মেঘুন শহরে গেছেন একটা প্যাগোডা উদ্বোধন করতে। সেখান থেকে আগামী মাসের ১১ তারিখে পূর্ণিমার পর ফিরে আসবেন। সে পর্যন্ত আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে। অথচ এখানে আমার থাকার কোনো বন্দোবস্ত করা হয়নি। এতদিন এখানে বসে কী করব সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। এসব বিষয় নিয়ে অমরাপুরের ভাইসরয় বা মন্ত্রীর কাছে পত্র দিলাম। কিন্তু কয়েকদিন পার হওয়ার পরও কোনো জবাব পাওয়া গেল না। একটা বিষয় জেনে হতবাক হয়ে গেলাম। দু মাস আগে রাজার কাছে গভর্নর জেনারেলের দেয়া পত্রটা পাঠানো হয়েছিল, সেই পত্র এখনো খোলাই হয়নি। অথচ ওই পত্রে বার্মায় আমার নিয়োগ সম্পর্কে রাজাকে অবহিত করা হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে। সেই পত্র না দেখে রাজা আমাকে এখানে আসতে বলেছেন কেন, সেটা বোঝা গেল না। মন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজার অনুমতি না পেলে নগরে পা রাখাও সম্ভব না। অতএব আমাকে এই অপরিচিত জনপদে নৌকার মধ্যে আটকে থাকতে হবে অনুমতির আগ পর্যন্ত।

আমি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে চাইলাম। অথচ মন্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারেও টালবাহানা করছেন। বারবার একেকটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। এদের বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে গেছে। কেউ সত্যি বলছে না। আমি খুব বিরক্ত। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া এভাবে আটকে থাকাটা যন্ত্রণার। ঠিক করলাম রাজার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি না পেলে রেঙ্গুন ফিরে যাব। কিন্তু রেঙ্গুন ফিরে যেতেও রাজার অনুমতি লাগবে। রেঙ্গুনের সাবুন্দার মি. ঝানসে নানান অজুহাত দেখালেন এসব অব্যবস্থাপনার জন্য। অথচ দেখেশুনে মনে হচ্ছে এগুলো ইচ্ছাকৃত পরিকল্পিত অপমান।

অতঃপর আমি রাজার কাছে সরাসরি চিঠি লিখে সব জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিজের অবস্থান ঘোষণা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবার জন্য অনুরোধ করলাম। অনুরোধের পাশাপাশি চিঠিতে খানিকটা হুমকির সুরও ছিল। এই চিঠি রাজার কাছে পাঠানো সহজ নয়। সরকারি কর্তারা কেউ এমন চিঠি রাজার কাছে পাঠাতে রাজি নয়। অবশেষে একজন দোভাষীকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করালাম। তবু চিঠিটা আদৌ পৌঁছাবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল।

কিন্তু কথা রেখেছে সেই দোভাষী। রাজার কাছে চিঠি পৌঁছানো সম্ভব হলো। রাজার হাতে চিঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফল পাওয়া গেল। রাজার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের আয়োজন করলেন দ্রুততার সঙ্গে। ফেব্রুয়ারির তারিখে আমার রাজদর্শনের দিন ধার্য করা হলো।

তারিখ সকালে রাজার জন্য উপঢৌকন, গভর্নর জেনারেলের চিঠি সবকিছু সাজিয়ে নিয়ে রাজকীয় অভ্যর্থনা কেন্দ্রে পৌঁছালাম সদলবলে। কিন্তু প্রবেশপথে পৌঁছানোর পর বলা হলো, আমার সঙ্গে মাত্র দুজনকে প্রবেশাধিকার দেয়া হবে। বাকিদের বাইরে থাকতে হবে। অগত্যা সবাইকে বাইরে রেখে মি. বারনেটকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করতে গেলাম। কিন্তু প্রবেশপথে আবারো বাধা। আমাকে টুপি জুতো সব খুলে ফেলতে হবে। অতএব জুতো খুলে টুপি খুলে প্রবেশ করলাম। বিশাল একটা হলঘর। মাঝখানে কার্পেট পাতা হয়েছে। বেশ দূরে রাজার আসন পাতা। আমি কার্পেটের ওপর পদ্মাসনে বসলাম। কিন্তু গাইড আপত্তি করল। বলল পা পেছনে রেখে বসতে হবে। অভ্যস্ত না থাকায় হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনোমতে বসলাম বেকায়দা অবস্থায়।

দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর রাজার আগমন সংবাদ এল। মহামান্য রাজা বেরিয়ে এলেন অন্তঃপুর থেকে। তার রাজকীয় পোশাক আশাকের ছিরি দেখে কিছুটা বেসামাল মনে হলো। তার জন্য রাখা নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলেন। যেটা আমার কাছ থেকে ১০০ ফুট দূরে। আসন গ্রহণের পর সামনের দিকে তাকিয়ে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিতে লাগলেন,

আমার সাথে দেখা করতে এসেছে কে? তার পদ-পদবি কী? তার পাশেরজন কে? এই রেসিডেন্টের দায়িত্বে কে আছে?’ প্রশ্নবাণে উপস্থিত সভাসদরা তটস্থ হয়ে আছেন।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বুকের বামদিকে হাত রেখে কুর্নিশ করে জানালাম, আমিই রেসিডেন্ট। আমার পরিচয় পাওয়ার পর তিনি হেসে দিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ আমি খুব ভালো করে জানি ইউরোপিয়ানরা বুকের বাম দিকে হাত দিয়ে কুর্নিশ করে।তারপর তিনি আমার পরিচয় পদবি জেনে সামান্য কুশল বিনিময় করে তার সভাসদদের সঙ্গে আলাপ করলেন।

মিনিট বিশেক পর তিনি মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবহাওয়া তো খুব গরম হে। আমি আর বসতে পারছি না এখানে। তোমরা অতিথির আপ্যায়ন করো। আমি গেলাম।

আর কোনো কথা কিংবা সৌজন্য বিনিময় ছাড়াই তিনি সটান উঠে চলে গেলেন অন্তঃপুরে। দুই মাস দুই সপ্তাহের অপেক্ষার পর রাজদর্শন হলো মাত্র ২০ মিনিট।

তিনি চলে যাওয়ার পর আমাকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। মিষ্টান্নপর্ব শেষে থালা হাতে এগিয়ে এলেন একজন। সেই থালায় সাজানো আছে কয়েকটি সবুজ পাতা, আর গুটিকয়েক অজানা বস্তু। জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কী? বলল, ‘ হলো পান আর ওটা হলো সুপুরি

আমি পান-সুপুরি কিছুই চিনি না। কিন্তু আপ্যায়নের অংশ হিসেবে বস্তু দুটো তুলে নিয়ে পকেটে পুরলাম। তারপর নৌকার দিকে পা বাড়ালাম। (সংক্ষেপিত)

হারুন রশীদ: সভ্যতা ইতিহাস অনুসন্ধানী লেখক