সিল্করুট

কূটনীতিতে অবিবেচক হিরাম কক্স

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন


বার্মার রাজাকে লেখা জন শোরের চিঠি নিয়ে রেঙ্গুনে হাজির হলেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। এনবি এডমনস্টোন কর্তৃক বার্মার প্রধানমন্ত্রী রেঙ্গুনের প্রশাসককে লেখা আরো দুটি চিঠি তার সঙ্গে ছিল। জন শোর  তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা অঞ্চলের গভর্নর জেনারেল। এডমনস্টোন রাজনৈতিক সচিব। জন শোরের চিঠিতে কক্সের কাজের একটি তালিকা ছিল। ব্রিটিশদের সঙ্গে বার্মা রাজদরবারের সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছিল ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের মূল কাজ। পাশাপাশি বার্মা মুলুকে ফরাসিরা যেন প্রভাবশালী হতে না পারে, তা নিশ্চিত করাও তার বিশেষ দায়িত্ব ছিল। বার্মার বন্দরগুলোতে ফরাসি জাহাজের নোঙর করা পণ্য বিক্রি করা প্রতিরোধ করতে তাকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। হিরাম কক্সের বার্মা মিশন প্রসঙ্গে গবেষক জিপি রামচন্দ্রক্যাপ্টেন হিরাম কক্সেস মিশন টু বার্মা, ১৭৯৬-১৭৯৮, কেস অব ইরেশনাল বিহেভিয়র ইন ডিপ্লোমেসিশিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘দুটি সরকারের মধ্যে সমঝোতা বাড়ানো নিশ্চিত করার জন্য কক্সকে পাঠানো হয়েছিল। কলকাতার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ কক্সের মাধ্যমে করার জন্য রাজাকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বাণিজ্যিক ভূমিকার দিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। রাজাকে আরো অনুরোধ করা হয়েছিল, কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কক্সকে মূল্যায়ন শ্রদ্ধা করতে রাজকর্মচারীদের যেন তিনি নির্দেশ দেন।

বার্মায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের যাত্রা কীভাবে হলো, তার একটি প্রেক্ষাপট রামচন্দ্র তার নিবন্ধে হাজির করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৭৯৫ সালের শুরুতে জন শোর ক্যাপ্টেন মাইকেল সাইমসকে রেঙ্গুনে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শোরের মতে, বাণিজ্য সম্ভাবনা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একজন প্রতিনিধি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। দুটি সরকারের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগও সে নিশ্চিত করতে পারবে। ১৭৯৪ সালে তৈরি হওয়া সীমান্ত সংকটের সময় ব্রিটিশরা বার্মা রাজদরবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী সরকারের সঙ্গে নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক স্থাপন করা ব্রিটিশদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। রেঙ্গুনে ব্রিটিশদের একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করার ব্যাপারে বার্মা রাজদরবারের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন সাইমস। শোরের কাছে লেখা চিঠিতে বার্মা মন্ত্রিসভা এভাবে অনুমোদন প্রদান করে, “বাণিজ্যিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং যোগাযোগে মধ্যস্থতা করা হবে নিযুক্ত প্রতিনিধির কাজউল্লেখ্য, ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দূত হিসেবে ক্যাপ্টেন মাইকেল সাইমসকে বার্মায় পাঠানো হয়েছিল।

বার্মা সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর জন শোর বার্মায় একজন প্রতিনিধি পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করলেন। ১৭৯৬ সালের জুন মাসে প্রতিনিধি মনোনীত হলেন বেঙ্গল আর্মির সদস্য ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। তার বয়স তখন ৩৭ বছর। সে বছরের ২৭ জুন ১২ সেপ্টেম্বরে কোম্পানির কলকাতা প্রশাসন -সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এসব নীতিতে নানাভাবে প্রতিনিধির ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। বার্মা সরকারের দিক থেকে কোনো ধরনের সন্দেহ বা শত্রুতার সূত্রপাত যেন না হয়, সে লক্ষ্যে এমনটা করা হয়েছিল। কক্সের মর্যাদা ক্ষমতার বিবরণ দিতে গিয়ে রামচন্দ্র লিখেছেন, ‘কলকাতা প্রশাসন কক্সকে ভালো পদমর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু তারা এটি স্পষ্ট করেছিল যে তার মর্যাদা রাষ্ট্রদূতের সমান নয়। কক্স বার্মার মন্ত্রী প্রশাসকদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন, কিন্তু তাদের কাছ থেকে ফিরতি সাক্ষাতের দাবি জানাতে পারবেন না। তবে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নীতি কার্যকর হবে না।ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে আরো জানানো হয়েছিল যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ক্যাপ্টেন মাইকেল সাইমস যেসব সুবিধা পেতেন, হিরাম কক্স সেগুলো দবি করতে পারবেন না।

তবে হিরাম কক্স তাকে দেয়া সব নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছিলেন। বার্মায় তিনি স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন। কূটনীতির ক্ষেত্রে তার আচরণকে রামচন্দ্রঅযৌক্তিকবলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত এটি মনে হয় যে মিশনের সময় কক্স সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন না। বার্মায় তার আচরণ ছিল বাস্তবতাবিবর্জিত।অহেতুক সন্দেহ, অকারণে মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানো, পদমর্যাদার মোহ এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে রামচন্দ্র ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের ব্যক্তিত্বকেঅনেকাংশেই বিকারগ্রস্তবলে আখ্যায়িত করেছেন।

তবে বার্মার রাজার দিক থেকে ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে সন্তুষ্ট করতে কোনো ত্রুটি ছিল না। রামচন্দ্র লিখেছেন, ‘রাজা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।...তিনি কক্সকে রেঙ্গুনে আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করার নির্দেশ দিলেন। রাজার সম্ভবত জানা ছিল যে, কক্সের মন্ত্রীর মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা আছে। তিনি তাকে সে পদমর্যাদায় ভূষিত করলেন। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজা তাকে প্রধানমন্ত্রীর সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন। আরেকটি প্রতিবেদন অনুসারে, তাকে ইচ্ছ মতো বাসস্থান প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।

এত সম্মান সুবিধা পেয়েও মন ভরেনি ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের। নিজের খামখেয়ালিপনা বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি বার্মার মন্ত্রীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। এমনকি সাধারণ মানুষও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অবশেষে তা রূপ নিয়েছিল চরম তিক্ততায়। তা কতটা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছিল, রামচন্দ্রের লেখায় তা এভাবে উঠে এসেছে, ‘কক্স বিশ্বাস করতেন যে রেঙ্গুনে তিনি মারাত্মক বিপদে আছেন। তিনি ভেবেছিলেন যে তাকে বার্মা ত্যাগের অনুমতি দেয়া হবে না। এমনকি তাকে উদ্ধারকল্পে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে বলেছিলেন তিনি।...কক্স বার্মাকে শত্রু হিসেবে দেখার সুপারিশও করেছিলেন। অস্ত্র হাতে বর্মিদের মোকাবেলা করা ব্রিটিশদের কর্তব্য বলে তিনি লিখেছিলেন।মিশন পরিচালনায় ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে অবশেষে কক্সকে রেঙ্গুন থেকে প্রত্যাহার করে নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৯৮ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বার্মা ত্যাগ করেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স।

 মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক