সিল্করুট

জাহরাভির নকশা করা শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি

রবিউল হোসাইন


আবুল কাসিম আল জাহরাভি আধুনিক সার্জারির জনক হিসেবে পরিচিত। অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্র তিনি তৈরি করেছিলেন। পাশাপাশি পুরনো অনেক যন্ত্রকে অধিকতর উপযোগী রূপ দিয়েছিলেন। স্বরচিত কিতাব আত তাসরিফে তিনি ২০০টির অধিক সার্জিক্যাল উপকরণের সচিত্র বর্ণনা হাজির করেছেন। উপকরণগুলোর নির্মাণ প্রণালি ব্যবহারবিধিও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তার তৈরি নবায়িত অনেক উপকরণ এখনো আধুনিক শল্যচিকিৎসায় সফলভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। এসব উপকরণের মধ্যে দহন প্রক্রিয়ার (কটারাইজেশন) জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, স্কালপেল (ব্যবচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় ধাতুর তৈরি ধারালো উপকরণ), বিশেষ ধরনের কাঁচি, আঁকশি, স্পেকুলা, কিডনির পাথর অপসারণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উল্লেখযোগ্য। সন্তান প্রসবকে অধিকতর সহজ করার জন্য তিনি এক ধরনের ফরসেপ (সাঁড়াশি) তৈরি করেছিলেন। আল জাহরাভি একটি বিশেষ ধরনের কাঁচি তৈরি করেছিলেন। এর সাহায্যে রোগীকে ন্যূনতম কষ্ট না দিয়ে টনসিল সারাতে পারতেন তিনি। ফোড়া কাটার জন্য বিশেষ একটি ছুরি তৈরি করেছিলেন। তা দিয়ে এতটা মসৃণভাবে ফোড়া কাটা যেত যে রোগী কোনো ধরনের অস্বস্তি অনুভব করত না। এছাড়া শল্যচিকিৎসায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আংটা চিমটা তৈরি করেছিলেন তিনি।

জৈবচিকিৎসা প্রকৌশলেও অনবদ্য অবদান রেখেছেন আল জাহরাভি। তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লেখায় তুলে ধরা হলো

দন্ত চিকিৎসা

দাঁত কিংবা দাঁতের টুকরো টেনে বের করার জন্য আল জাহরাভি বিভিন্ন ধরনের সাঁড়াশি বা চিমটা ব্যবহার করতেন। দাঁতের গোড়া বের করার জন্য তিনি এক ধরনের চিমটা ব্যবহার করতেন। ইংরেজিতে ধরনের চিমটাকে বলা হয় টুইজার। ফেলে দেয়া দাঁতের স্থানে প্রাণীদের হাড়ের তৈরি দাঁতের ব্যবহার শুরু করেছিলেন তিনি। মুখবিবর দাঁতের চিকিৎসায় তিনি বিভিন্ন খনিজ পদার্থও ব্যবহার করতেন। পাইয়োরিয়ার চিকিৎসায় তিনি ক্ষার ব্যবহার করতেন। দাঁত সাদা করা, মাড়ি শক্ত করা পচনের চিকিৎসায় এক ধরনের ক্ষারীয় পাথর ব্যবহার করতেন আল জাহরাভি। দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়ির প্রদাহ, মুখের ক্ষত ইত্যাদির চিকিৎসায় তিনি ফিটকিরি ব্যবহার করতেন। পাশাপাশি টুথপেস্ট মাউথওয়াশ হিসেবেও ফিটকিরি ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন তিনি। মারকাসাইট নামক একধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যথা নিরামক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতে রোগীদের পরামর্শ দিতেন তিনি। মাড়ি শক্ত করতে হরিতাল বা পীতকের (একধরনের আকরিক রঞ্জক পদার্থ) ব্যবহার ছিল।

নাক, কান গলার চিকিৎসা

ফুলে যাওয়া টনসিল অপসারণের জন্য আল জাহরাভি এক প্রকার বাঁকানো স্কালপেল ব্যবহার করতেন। স্কালপেলের অবতল দিক ধারালো এবং উত্তল দিকটি ভোঁতা। বর্ধিত আলজিহ্বা কাটতেও স্কালপেল ব্যবহার করা যেত। গলার টিউমার কাটতেও এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

কানের ব্যথার চিকিৎসায় তিনি সুচালো কটারি (কটারাইজেশনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় লোহা কিংবা অন্য কোনো ধাতুর তৈরি দণ্ড) ব্যবহার করতেন। এর সাহায্যে বহিঃকর্ণের বিভিন্ন অংশ তিনি দগ্ধ করতেন। অনেক সময় কোনো পদার্থ  কানে প্রবেশ করে আর্দ্রতার কারণে তা ফুলে যায়। কান থেকে এসব পদার্থ অপসারণে তিনি নিপুণ একটি স্কালপেল ব্যবহার করতেন।

চোখের চিকিৎসা

চোখের ভেতরের কোনায় আটকে থাকা কোনো পদার্থ বের করতে তিনি স্কালপেল ব্যবহার করতেন। চোখের কর্নিয়ায় বেড়ে ওঠা পুরু আবরণ কাটতেও স্কালপেল ব্যবহূত হতো। চোখের ভেতরে জন্মানো রোম অপসারণ করতে তিনি চন্দ্রাকৃতির একটি ধাতব শলাকা তৈরি করেছিলেন।

মস্তিষ্কের চিকিৎসা

মাইগ্রেনের চিকিৎসায় আল জাহরাভি মস্তিষ্কের অস্থায়ী ধমনিগুলো বাঁকানো কাটার কাজে এক ধরনের আংটার ডগা ব্যবহার করতেন। এসব আংটায় এক, দুই অথবা তিনটি কাঁটা থাকত।

রক্তপাত বন্ধ ক্ষত সারাতে

নিরাপদে চোখে দহন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য তিনি চোখের পাতার নিচে ডিমের সাদা অংশে ভেজানো তুলা কিংবা সিলিয়াম নামক বিশেষ এক বীজ থেকে প্রাপ্ত আঠা ব্যবহার করতেন। কাটা ঠোঁটের চিকিৎসায় দহন প্রক্রিয়া শেষ করার পর তিনিই প্রথম প্লাস্টার ব্যবহার শুরু করেছিলেন। ক্ষত যেন তাড়াতাড়ি সারে এবং কাটা অংশ যেন নিখুঁতভাবে জোড়া লাগে, সে উদ্দেশ্যে প্লাস্টার করতেন তিনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যদি ক্ষত বাতাসের সংস্পর্শে আসে, তাহলে সেখানে পচন শুরু হতে পারে। প্লাস্টার বাতাসের সংস্পর্শে আসা থেকে ক্ষতস্থানকে রক্ষা করবে। নাকের পলিপ অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের পর তিনি নাসারন্ধ্রে একটি সিসার টিউব প্রবেশ করাতেন। টিউব এমন ওষুধে পূর্ণ থাকত যা ক্ষতকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলত। সার্জারির সময় রক্তপাত হলে তিনি ভিট্রিওল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। মুখগহ্বর জীবাণুমুক্ত করার জন্য তিনি রোগীদের লবণ ভিনেগার দিয়ে কুলি করার পরামর্শ দিতেন।

 

রবিউল হোসাইন: লেখক