বিশেষ সংখ্যা

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের অভিবাসনের ইতিহাস

ফজল হাসান


শীতের শুরুতে শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে বেঁচে থাকার প্রবল তাগিদে পরিযায়ী পাখিরা দল বেঁধে হাজার হাজার মাইল খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়ে যায় কোনো উষ্ণ এলাকায়। শীত ফুরোলেই তারা আবার একইভাবে দল বেঁধে একই পথে ফিরে আসে আপন কুলায়। হয়তো সে যাওয়া-আসার পথ সবাই পেরোতে পারে না। তবুও পাখিদের সাময়িক অভিবাসন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

মানুষ তো আর পাখি নয়। তাই বৈরী আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ স্বল্পকালীন অভিবাসনে যায় না। মানুষের চাহিদা প্রচুর এবং আকাঙ্ক্ষা সীমাহীন। তাই দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশান্তরী হয়ে অভিবাসনে যাওয়ার পেছনে তাদের একাধিক কারণ থাকে। বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, মানুষের অভিবাসনের নেপথ্যে মূলত দুটি কারণ কাজ করে: অনেকেই তাদের জন্মভূমি ছেড়ে চলে যায় পছন্দ অনুযায়ী দেশে (যেমন দক্ষ অভিবাসী) এবং বাকিরা অভিবাসনে যেতে বাধ্য হয় (যেমন মানবিক অভিবাসী)

বর্তমান লেখায় অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের অভিবাসনের ইতিহাস আলোকপাত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের অভিবাসনের ইতিহাসকে দুটি পৃথক অংশে ভাগ করা হয়েছে: বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে (অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারত) এবং স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়। এছাড়া রয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী জনসংখ্যা, তাদের ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য এবং বসতি স্থাপনের প্রাথমিক সমস্যা অভিজ্ঞতা। এখন বাংলাদেশীদের অভিবাসনের সম্ভাব্য কারণ এবং অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের ইতিহাস পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশীদের অভিবাসনের কারণ

বাংলাদেশীরা বিভিন্ন কারণে পরবাসী হন। সাধারণত এসব কারণের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক (যেমন দারিদ্র্য থেকে মুক্তি কিংবা উন্নত জীবনের গভীর প্রত্যাশা), নির্যাতন (বিশেষ করে যুদ্ধ, গণহত্যা কিংবা জাতিগত বিভেদ), রাজনৈতিক (যেমন একনায়কতন্ত্র সরকারের হাত থেকে মুক্তি অথবা ভিন্নমতের জন্য অযথা ধরপাকড়ের ভয়, এমনকি জেল কিংবা দৈহিক নির্যাতন), ধর্মীয় (অনেক সময় নিজেদের ধর্ম পালন করার বৈরী পরিবেশ), প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন বন্যা, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক ঝড়-তুফান, জলোচ্ছ্বাস) ব্যক্তিগত (যেমন নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বসবাস, কখনো বা নিজস্ব অনুভূতি কিংবা ভাবপ্রবণতা) তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুশিক্ষার অসুস্থ পরিবেশ, চাকরির অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, এমনকি চাহিদার অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা অভিবাসনের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশীরা আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে প্রবাসী হন। এদের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। আবার অনেকের প্রবাসে আসার পেছনে রয়েছে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজনের মুখে হাসি ফোটানো। সালমা বিনতে শফিকের পিএইচডি (শিরোনাম: সেটলমেন্ট এক্সপেরিয়েন্স অব বাংলাদেশী মাইগ্রেন্টস ইন অস্ট্রেলিয়া) গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অভিবাসনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রধান নির্ধারক। নিজ দেশে তুলনামূলকভাবে উচ্চ জীবনযাত্রার মান বজায় থাকা সত্ত্বেও দক্ষ বাংলাদেশীরা সে পরিস্থিতি এড়াতে এবং তাদের সন্তানদের জন্য ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের বেকারত্বের অভিশাপ এবং অপমানের হাত থেকে মুক্তি পেতে অনেক দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ধনী নির্বিশেষে উচ্চশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, এমনকি অশিক্ষিত যুবকরা বিভিন্ন ফন্দিফিকির করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। কম শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বাংলাদেশীরা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জাপানসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে পাড়ি দেন।

তবে যেকোনো কারণেই হোক না কেন, খণ্ডকালীন অভিবাসীদের, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এশিয়ার অনেক দেশে ছড়িয়ে থাকা অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই টিকে আছে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি। অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির পেছনে এসব প্রবাসী বাংলাদেশীর অবদান অনেক।

অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের ইতিহাস পদ্ধতি

অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় অভিবাসীদের বাসভূমি বা ল্যান্ড অব মাল্টিকালচারাল সোসাইটি। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জেমস কুক অস্ট্রেলিয়ায় অবতরণের পর থেকে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে বহিরাগতদের আগমন শুরু হয়। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন কুক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ অভিযাত্রী, নাবিক মানচিত্রবিদ। তিনি ১৭৭০ সালের ২৩ এপ্রিলইনডেভ্যারনামের জাহাজবহর নিয়ে অধুনা সিডনির বোটানি বে-তে নোঙর করেন। তাকে অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

যাহোক, প্রথমে ব্রিটেনের বিভিন্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দিয়ে শুরু হয় অভিবাসন। ১৭৮৮-১৮৬৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬০ হাজার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির আগমন ঘটে। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড আয়ারল্যান্ড থেকে সাধারণ নাগরিক এসে বসতি স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে গ্রিস ইতালি থেকে অভিবাসীরা আগমন করে। উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশীরা আসা আরম্ভ করে ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে

অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী অভিবাসন কর্মসূচি মূলত তিন শ্রেনিতে ভাগ করা যায়। যেমন পারিবারিক পুনর্মিলন, দক্ষ অভিবাসন এবং মানবিক কারণ। তবে অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অস্থায়ী অভিবাসীদের বেশির ভাগই দক্ষ কর্মী (সাব-ক্লাস ৪৫৭ ভিসায়), বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আগমন করে। স্থায়ী অভিবাসন কর্মসূচির বিপরীতে যার জন্য বার্ষিক কোটা প্রযোজ্য হয়, অস্থায়ী অভিবাসনের কোটা উন্মুক্ত এবং অস্থায়ী অভিবাসনের সংখ্যা প্রায় প্রতি বছর চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় আসতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সংখ্যা এবং স্থানীয় শ্রমবাজারের ঘাটতির জন্য বিদেশী কর্মীর সংখ্যা প্রতি বছর ওঠানামা করে।

যাহোক, সাম্প্রতিক কয়েক দশক অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসনকর্মসূচি মানবিক পারিবারিক কারণের বিপরীতে দক্ষ কর্মীর চাহিদাকে প্রভাবিত করেছে।

অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালিদের আগমন: প্রাক-স্বাধীনতা

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। তার আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি ১৭৬৫-১৯৪৭ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের অংশ ছিল। ১৯৪৭-এর ভারত বিভাজনের পর বাংলাদেশ অঞ্চল পূর্ব বাংলা (১৯৪৭-৫৬) এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান (১৯৫৬-৭১) নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাই এই লেখায় স্বাধীনতা লাভের আগে বাংলাদেশীদেরবাঙালিহিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিদের ইতিহাস ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক এবং সাংবাদিক আকিদুল ইসলাম তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ১৭৯৭-এর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা থেকে একটি জাহাজ নিয়ে স্কটিশ ব্যবসায়ী উইলিয়াম ক্লার্ক ১২ জন বাঙালি চার জন ব্রিটিশ নাগরিকসহ অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে এবং ঝড়ঝাপটা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মাত্র তিনজন (একজন বাঙালি, একজন ব্রিটিশ এবং উইলিয়াম ক্লার্ক) সিডনির মাটিতে পা রাখতে পেরেছিলেন। আকিদুল ইসলামের ভাষায়, ‘ওই বাঙালি সম্পর্কে ইতিহাসে আর কোনো তথ্য না থাকলেও প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে তার দীপ্ত পদচিহ্ন প্রতিটি বাঙালির কাছে গর্বের।তবে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণ কেন্দ্র পুলিশ বিভাগের রেকর্ড থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আকিদুল ইসলাম আমাদের সময় ডট কমে প্রকাশিত অন্য এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিদের ইতিহাস ১৬০ বছরের। ১৮৬০- ব্রিটিশ অধ্যুষিত অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজে করে প্রচুর বাঙালি অস্ট্রেলিয়া আসেন

কথা সর্বজনস্বীকৃত, কলকাতার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। প্রসঙ্গে সিডনিভিত্তিক বাঙালি উদ্যোক্তা ইন্দ্রনীল হালদার ২০১৯ সালে প্রকাশিত তার এক লেখায় অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের ২০১৬ সালের মন্তব্য উল্লেখ করেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সম্ভবত ১৭৯৮ থেকে শুরু হয়েছিল, যখন স্কটিশ বংশোদ্ভূত রবার্ট ক্যাম্পবেল কলকাতায় সফলভাবে আমদানি-রফতানি ব্যবসা চালানোর পরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করতে এসেছিলেন

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুগে হাজার হাজার বাঙালি ভারত ছেড়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পাড়ি জমায়। কলকাতা বন্দর এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অবিচ্ছিন্ন সামুদ্রিক সংযোগের ফলে ভারতীয়রাও অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল। উইলিয়াম ব্রাউন কলকাতা থেকে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে ভারতীয় গৃহকর্মী শ্রমিকদের নিয়ে এসেছিলেন। ধারণা করা হয়, এই ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন বাঙালি, অর্থাৎ বাংলার অধিবাসী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের দিনগুলোয় এবং পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলেছেন। এছাড়া মিউজিয়ামস ভিক্টোরিয়ার তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ব্রিটিশ-শাসিত অখণ্ড ভারতের অন্যতম প্রদেশ বাংলা থেকে প্রথম দিকের অভিবাসীরা উনিশ শতকের শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন। তারা সংখ্যায় ছিলেন অল্প এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ ভারতীয় কর্মকর্তাদের চাকর বা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

অতীতে অবিভক্ত ভারতের কলকাতা থেকে শুধু বাঙালিরাই অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনে যায়নি, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশও গিয়েছে। যেমন ক্রিকেটার ব্রান্সবি বিউচ্যাম্প কুপার। তার জন্ম তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায়, ১৮৪৪ সালের ১৫ মার্চ। তিনি পৃথিবীর প্রথম ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃত অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নেমেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান উইকেটরক্ষক। উল্লেখ্য, সম্প্রতি আকিদুল ইসলাম ব্রান্সবি বিউচ্যাম্প কুপার সম্পর্কে দ্য ডেইলি স্টারে নিবন্ধ লিখেছেন।

যাহোক, প্রাক-স্বাধীনতা আমলে তত্কালীন বাঙালিদের অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস কবে থেকে শুরু হয়েছিল, নিশ্চিতভাবে তা বলা মুশকিল। তবে ২০০৯ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের ব্রোকেন হিলের এক আদিবাসী গ্রামের মসজিদে পাওয়া গিয়েছিল একটি বাংলা পুঁথি গ্রন্থ, যার প্রকাশকাল ১৮৯৪। প্রসঙ্গে কলকাতারসংবাদ প্রতিদিনপত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত গবেষক, যিনি সিডনি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করেছেন, সামিয়া খাতুনের লেখার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি লিখেছেন, ‘২০০৯-এর জুলাইয়ে সেই মসজিদ দেখতে গিয়ে, একটা ভাঙা তাকে বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে চোখে পড়ে গেল এক বই। ধুলোভরা পাতা উল্টে দেখি, বাংলায় লেখা। কে যেন ইংরেজিতে প্রথম পাতায় লিখে রেখেছে দ্য হোলি কোরআন। অস্ট্রেলিয়ার এক ইতিহাসের বইতেও লেখা আছে, মসজিদে একটা কোরলান রাখা আছে। কিন্তু পড়ে দেখি, বইটা আসলে কোরলান নয়, ৫০০ পাতার বাংলা কাব্য। ১৩০১ বাংলা সালে ছাপা বটতলার বই। বটতলার প্রকাশক কাজী সফিউদ্দীনের কেতাব কাছাছল আম্বিয়া। কলকাতার চিত্পুর রোডে ছাপা।

উল্লেখ্য, কাছাছল আম্বিয়া বা কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থটি কাজী সফিউদ্দীন আরবি থেকে পুঁথির ছন্দে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। বাংলায় অনূদিত গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। এখানে বলা প্রয়োজন, ব্রোকেন হিল এলাকার যে মসজিদে পুঁথি গ্রন্থটি পাওয়া গিয়েছে, তা ছিল আফগান উটচালকদের নির্মিত। ধারণা করা হয়, সে সময় সেখানে অনেক বাঙালির বসতি ছিল। কেননা পুঁথি সাধারণত সম্মিলিতভাবে পাঠ করা হয়।

ডক্টর সামিয়া খাতুন বিভিন্ন নথি থেকে সংগৃহীত তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করা বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালির অস্তিত্বের কথা এবং কাছাছল আম্বিয়ার আবিষ্কার তার গবেষণা গ্রন্থঅস্ট্রেলিয়ানামা সংযুক্ত করেছেন, যা ২০১৯ সালে প্রকাশ হয়েছে। এছাড়াদ্য ডেইলি স্টার’- প্রকাশিত এক নিবন্ধে জনাব আকিদুল ইসলামও তত্কালীন সময়ের বাঙালি অভিবাসীদের উপস্থিতি তুলে ধরেছেন। তাদের দুজনের লেখা থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো:

আঠারো শতকে দুজন ব্যবসায়ী তত্কালীন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে নিয়মিত উট আনতেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই জাহাজের সব নাবিক কর্মচারী ছিলেন পূর্ববঙ্গের বাঙালি। তাদের মধ্যে অনেকে আদিবাসী মহিলাদের বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় থেকে যান এবং মূল স্রোতে মিশে যান।

১৮৮০-তে এক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ীর স্মৃতিকথায়দেরভায়েস’(অর্থাৎ দরবেশ) নামে একজন বাঙালির নাম পাওয়া গিয়েছে। তিনি মেলবোর্নে টক আচার বিক্রি করতেন।

১৮৯০ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পোর্ট হেডল্যান্ডে একজন কলকাতার বাবুর্চি (রাঁধুনি) বাস করতেন। তার নাম ছিল আব্দুল আজিজ।

১৯০৪-০৫ সালের মধ্যে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরের অদূরে ফ্রিম্যান্টল নদীবন্দরে আনুমানিক ৩০ জন বাঙালির কাপড়ের ব্যবসা ছিল।

১৯৩০-এর দশকে কলকাতার এক রিকশাওয়ালা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার খনির এলাকা পিলবারার মরুভূমিতে উটের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

প্রায় ১৫০ বছর আগে এক বাঙালি ব্রোকেন হিল এলাকায় একটি সার্কাস দলের সদস্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

যাহোক, ডক্টর সামিয়া খাতুনের ধারণা অনুযায়ী কাছাছল আম্বিয়া শিরোনামের বটতলার বইটি নিশ্চয়ই এসব বাঙালির মধ্যে কারোর হাত ধরেই পৌঁছেছে দুর্গম ব্রোকেন হিল এলাকায়।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের আগমন: স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজনৈতিক মুক্তি এবং পোশাক টেক্সটাইল শিল্পের বিকাশ সত্ত্বেও বাংলাদেশীরা নিম্নমানের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তাই অনেকে উন্নত জীবনের আশায় অন্যান্য উন্নত দেশের অভিবাসী হয়েছেন। তবে কথা সত্যি, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারীরা অস্ট্রেলিয়ায় অপেক্ষাকৃত নতুন অভিবাসী।

বিভিন্ন সূত্রের ওপর ভিত্তি করে সিডনি প্রবাসী . কাইউম পারভেজ এক সেমিনারে উল্লেখ করে বলেছেন, ১৯৬২ সালে পদ্মাপাড়ের বাঙালি হিসেবে প্রথম অভিবাসী হয়েছিলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মাসুদুল করিম চৌধুরী। তবে তিনি আলমগীর চৌধুরী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ষাট দশকের শুরুর দিকে একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলা চট্টগ্রামের এক মিশনারি স্কুলে শিক্ষক হয়ে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গেই আলমগীর চৌধুরীর পরিচয় হয়েছিল। তারপর তাদের মাঝে প্রণয় এবং অবশেষে বিয়ে। জনাব চৌধুরী জাহাজে করে প্রথম এসেছিলেন পার্থের ফ্রি ম্যান্টেল নদীবন্দরে। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রিসবেনে ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন সিডনিতে। বলা হয়, তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালি ক্যাপ্টেন কুক। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন জেমস কুক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রধান ইংরেজ অভিযাত্রী, নাবিক মানচিত্রবিদ। তিনি ১৭৭০ সালের ২৩ এপ্রিলইনডেভ্যারনামের জাহাজবহর নিয়ে অধুনা সিডনির বোটানি বে-তে নোঙর করেন। তাকে অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

এছাড়া ১৯৬২-৭০ সালের মধ্যে মাত্র কয়েকজন ছাত্র স্থায়ী অভিবাসী হয়ে সিডনিতে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে নজরুল ইসলাম ১৯৭০- প্রথম সরাসরি অভিবাসন ভিসা এবং চাকরি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গমন করেন। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় তিনি এবং স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশী ছাত্র মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি অস্ট্রেলীয়দের সমর্থন আদায় করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তখন তারা গড়ে তুলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি সংগঠনবাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়া নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সে সময়ে স্বাধীনতার পক্ষে গুটি কয়েকজন বাংলাদেশীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আকিদুল ইসলাম সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ‘তারা অস্ট্রেলিয়ার শপিং সেন্টার, ফেরিঘাট, ট্রেন স্টেশন এবং বাস স্টপেজে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন টাঙিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্য। সে সময় পুরো অস্ট্রেলিয়ার মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। এরই প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য অন্যান্য উন্নত দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আরেক শ্রেনির বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে থেকে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তখন তারা ছিলেন ক্যানবেরায় অবস্থিত তত্কালীন পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং কর্মচারী। তারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব খারিজ করে অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী জনসংখ্যা

স্বাধীনতার পরে অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস ১৯৭৬ সালের আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশীদের আলাদাভাবে গণনা করা শুরু করে। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি পাঁচ বছর পর পর আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। জনসংখ্যার আদমশুমারিতে স্থায়ী বাসিন্দা এবং অস্থায়ী ভিসাধারীরা (যেমন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী শ্রমিক এবং পর্যটক) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাহোক, সেই ১৯৭৬-এর আদমশুমারি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪১৩ জন। পরবর্তী আদমশুমারিতে (১৯৮১- অনুষ্ঠিত) সংখ্যাটি দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়, যদিও তা এক হাজারেরও কম। হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া নীতি শেষ হয় ১৯৭৪-, তার পর থেকে বাংলাদেশীদের অভিবাসন ক্রমেই বৃদ্ধি পায় এবং বেশির ভাগই দক্ষ অভিবাসী হিসেবে আসেন। তবে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এবং বিশেষ করে ১৯৯০-এর গোড়ার দিক থেকে বাংলাদেশীদের দৃশ্যপট ব্যাপকভাবে বদলে যেতে শুরু করে। কথা সত্যি, ১৯৯১-২০০১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগমনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে (গড়ে প্রতি বছর ৩২ দশমিক শতাংশ) মূলত তার অন্যতম কারণ ছিল উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ এবং দক্ষ কর্মীর স্থায়ী অভিবাসন।

পরবর্তী দশকেও, অর্থাৎ ২০০১-১১ পর্যন্ত, বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা গড়ে প্রতি বছর ১৮ দশমিক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দশকে যদিও কেউ কেউ দক্ষ এবং পারিবারিক অভিবাসনের কোটায় এসেছিলেন, তবে অন্যরা মানবিক কর্মসূচির অধীনে আগমন করেছেন। সরকারি সূত্রে জানা যায়, ২০০৬-১১ পর্যন্ত সাধারণ দক্ষ অভিবাসন (জেনারেল স্কিলড মাইগ্রেশন) প্রোগ্রামের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশটি উৎস দেশের মধ্যে একটি ছিল।

২০২১-এর আদমশুমারিতে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী ৫১ হাজারেরও বেশি নথিভুক্ত হয়েছে, যেখানে ২০১৬- ৪১ হাজার ২৩৩ জন এবং ২০১১- ২৭ হাজার ৮০৮ জন বাংলাদেশী ছিল। সুতরাং দেখা যায়, বিগত দশক অর্থাৎ ২০১১-২১- অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসী: ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত, যারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কিংবা অন্য যেকোনো কারণে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী হয়েছেন, তাদের বৈশিষ্ট্য জানা প্রয়োজন। তাই তাদের বিভিন্ন ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্য ২০১৬ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা দেশভিত্তিক ২০২১-এর আদমশুমারির বিস্তারিত পরিসংখ্যান এখনো প্রকাশ হয়নি।

উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার আদমশুমারিতে বিভিন্ন ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক বিভাজন (জিওগ্রাফিক ডিস্ট্রিবিউশন), বয়স লিঙ্গ (এইজ অ্যান্ড জেন্ডার), বাড়িতে কথ্য ভাষা (ল্যাঙ্গুয়েজ স্পোকেন অ্যাট হোম), আগমনের বছর (ইয়ার অব অ্যারাইভ্যাল), গড় আয় (মিডিয়াম ইনকাম), শিক্ষাগত যোগ্যতা (এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন) এবং চাকরি (এমপ্লয়মেন্ট) উল্লেখযোগ্য।

আগেই বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৬-এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ২৩৩ জন

ভৌগোলিক বিভাজন: ২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগ (প্রায় ৫৯ শতাংশ) নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনিসহ বিভিন্ন শহরে বসতি স্থাপন করেছে। তারপর রয়েছে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্ন অন্যান্য শহর (১৯ শতাংশ), কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ব্রিসবেন অন্যান্য শহর ( দশমিক শতাংশ) এবং ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের রাজধানী পার্থ অন্যান্য শহর ( দশমিক শতাংশ) বাকি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীরা অন্যান্য রাজ্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে।

বয়স লিঙ্গ: বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় কম বয়সী। ২০১৬-এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী জনসংখ্যার গড় বয়স ছিল ৩৪ বছর, যা অন্যান্য দেশে জন্মগ্রহণকারীদের তুলনায় ১০ বছর কম এবং পুরো অস্ট্রেলীয়দের তুলনায় চার বছর কম। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫ শতাংশ) বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের বয়স ২৫-৪৪ বছর। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে ২২ হাজার ৮৫০ জন পুরুষ (৫৫ দশমিক শতাংশ) এবং ১৮ হাজার ৩৮৩ জন মহিলা (৪৪ দশমিক শতাংশ) অন্যভাবে বলা যায়, লিঙ্গ অনুপাত প্রতি ১২৪ জন পুরুষের বিপরীতে ছিল ১০০ জন নারী।

বাড়িতে কথ্য ভাষা: বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ বাড়িতে কথ্য ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে। অন্যদিকে ইংরেজি ব্যবহার করে ( দশমিক শতাংশ) এবং রোহিঙ্গা ( দশমিক ৩৭ শতাংশ)

আগমনের বছর: ২০১৬-এর আদমশুমারি অনুযায়ী ২৭ দশমিক শতাংশ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীর আগমন ঘটে ২০০৭-১১-এর মধ্যে এবং ২৮ দশমিক শতাংশ ২০১২-১৬-এর মধ্যে।

গড় আয়: তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের গড় আয় কম। ২০১৬-এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশীদের সাপ্তাহিক গড় আয় ছিল ৬০২ ডলার। অন্যদিকে বিদেশে জন্মগ্রহণকারীদের গড় আয় ছিল ৬১৫ ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণকারীদের ৬৮৮ ডলার।

শিক্ষাগত যোগ্যতা: গোটা অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীরা (১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী) উচ্চশিক্ষিত। প্রায় ৭৯ শতাংশ বাংলাদেশীদের স্কুল পরবর্তী (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত) পড়াশোনা করেছে, যা অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গড়ের (৬০ দশমিক শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি।

চাকরি: ২০১৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারীদের মধ্যে (যাদের বয়স ১৫ বছর বা তার বেশি) শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৭৪ দশমিক শতাংশ এবং বেকারত্বের হার ছিল ১০ দশমিক শতাংশ। শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত প্রায় ৪৫ শতাংশ চাকরি করেন দক্ষ ব্যবস্থাপনা, পেশাদার বা কারিগরি পেশায়।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী অভিবাসীদের বসতি স্থাপনের প্রাথমিক সমস্যা এবং অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশী অভিবাসীরা প্রাথমিক পর্যায়ে বসতি স্থাপন বা ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য যেসব সম্ভাব্য বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হন, সালমা বিনতে শফিক তার গবেষণায় সেসব চিহ্নিত করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের প্রাক-আগমনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক পটভূমি, শিক্ষা ইংরেজি ভাষা দক্ষতা। এছাড়া সামাজিক পুঁজি, বাংলাদেশী কাজের যোগ্যতা, শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি, অভিবাসীদের প্রতি স্থানীয়দের মনোভাব সরকারি নীতিগুলোর মতো অভিবাসনের পরবর্তী বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশী অভিবাসীরা তাদের জাতিগত সম্প্রদায়ের সঙ্গে দৃঢ বন্ধন বজায় রাখে। তাই নতুন পরিবেশে তাদের সেতুবন্ধের সদিচ্ছা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি, পেশাগত দক্ষতা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাওয়া, বর্ণবাদ বৈষম্যের অভিজ্ঞতা সবই অভিবাসীদের মধ্যে মানসিক দুর্দশার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যার জন্য তারা, বিশেষ করে প্রথম প্রজন্ম, প্রায়ই অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হন। কেননা তাদের মাঝে কাজ করে কালচারাল শক বা সমাজ-সংস্কৃতির ধাক্কা।

বাংলাদেশী অভিবাসীদের বসতি স্থাপনের প্রথম দিকে দেখা গিয়েছে অনেকেই হোম সিকনেস নামক অদৃশ্য ঘেরাটোপে আটকে থাকেন। কেননা তারা প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে আসার সময় স্যুটকেসের মধ্যে কাপড়চোপড় অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ফাঁকা জায়গায় ভরে নিয়ে আসেন ছেড়ে আসা পরিবেশের আবেগ এবং স্মৃতির সোনালি পালক। যারা পড়ালেখার জন্য অভিবাসী হন, তাদের বেলায় হয়তো ততটা আবেগ কাজ করে না। কেননা আসার পর পরই নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর সঙ্গে পড়াশোনার চাপ এত বেশি আঁঁকড়ে ধরে যে আবেগে আপ্লুত হওয়ার সুযোগ তেমন একটা থাকে না। এছাড়া তারা জানেন পড়াশোনা শেষ করে ফিরে যাবেন মাতৃভূমিতে।

যাহোক, একপর্যায়ে হাতের মুঠোয় সবকিছু চলে এলেও পরবাসীরা মনের মধ্যে দেশ ছাড়ার জমাট বাঁধা কষ্ট আর হাহাকার নিয়ে বেঁচে থাকে। তারা বুকের ভেতর নীল বেদনা নিয়ে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের আমার ভেতরে বাঘ কবিতার ভাষায় বলে, ‘কেবল বেদনা অনন্ত হয়, আমি বেদনায় বেঁচে থাকিকিংবা দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়ের দিনকাল কবিতার শেষ দুলাইনের মতোকেবল বেঁচে থাকব বলে আমরা অর্ধমৃত বেঁচে আছি তার পরও তারা চায় আগামীতে স্মৃতিসুধায় ভরা থাক হূদয়ের পাত্রখানি।

শেষকথা

যদিও স্বাধীনতার পর থেকে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড়, তবে এখনো বাংলাদেশীরা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী ক্ষুদ্রতম অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনে বাংলাদেশীরা পিছিয়ে থাকার একাধিক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে দেশের মানুষের অস্বচ্ছ ধারণা কিংবা আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধবের মুখে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন বা উচ্চতর পড়াশোনা করার খবর না শোনা এবং অনেক দূরের অজানা-অচেনা দেশ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি। যাহোক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বেকারদের তুলনায় কাজের সংখ্যা বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামীতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে অভিবাসী এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাই বিভিন্ন রাজ্য সরকার কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে।

সবশেষে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী, বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা (হাসপাতালের নার্স পেশা) এবং প্রাইমারি হাইস্কুলের শিক্ষক যদি বাংলাদেশী উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হন এবং নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পারেন, তবে আশা করা যায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশী স্থায়ী এবং অস্থায়ী অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়বে।

তথ্যসূত্র

Department of Immigration and Citizenship (2014), Australia’s Migration Trends 2012-13, Economic Analysis Unit, Commonwealth of Australia, Canberra.

Indranil Halder (2019), Australia’s Bengal connect! How a Bengali poetry book landed in 19th- century Australian mosque, GetBengal Newspaper, 11 December, 2019.

Joyce Westrip and Peggy Holroyde (2010), Colonial Cousins: A Surprising History of Connections Between India and Australia, Wakefield Press, South Australia.

Museums Victoria (2017), Immigration History from Bangladesh to Victoria

Salma Bint Shafiq (2016), Settlement Experiences of Bangladeshi Migrants in Australia, PhD thesis, Swinburne University of Technology, Melbourne.

আকিদুল ইসলাম (২০২১), এখন লিখছি ইতিহাস গ্রন্থ, আমাদের সময় ডট কম, ১৫ জুলাই ২০২১।

আকিদুল ইসলাম (২০২১), ইতিহাসের দুঃসাহসিক মহাকাব্য: ২২৪ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালির পদচিহ্ন, দ্য ডেইলি স্টার, সেপ্টেম্বর ২০২১।

আকিদুল ইসলাম (২০২১গ), অস্ট্রেলিয়ার মসজিদে ১২৭ বছরের প্রাচীন বাংলা পুঁথি, দ্য ডেইলি স্টার, অক্টোবর ২০২১।

আকিদুল ইসলাম (২০২২), ৭০ বছরেও অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশীদের প্রতিনিধিত্ব নেই, দ্য ডেইলি স্টার, ২০ আগস্ট ২০২২।

আকিদুল ইসলাম (২০২২), পৃথিবীর প্রথম টেস্ট ম্যাচে খেলেছিলেন ঢাকায় জন্ম নেয়া এক ক্রিকেটার, দ্য ডেইলি স্টার, ৩১ আগস্ট ২০২২।

কাইউম পারভেজ (২০১৪), সিডনিতে বাংলা ভাষা সাহিত্য সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ এবং একুশে একাডেমির ভূমিকা, একুশে একাডেমি, অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধ, ২৬ অক্টোবর ২০১৪।

দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় (২০০৭), কবিতার শিরোনাম: দিনকাল, -পত্রিকা, কলকাতা, ৩১ অক্টোবর ২০০৭।

সামিয়া খাতুন (২০১০), মরুভূমিতে বাংলা কাব্য, সংবাদ প্রতিদিন, কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর ২০১০।

 

ফজল হাসান: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, লেখক অনুবাদক