আলোকপাত

জনগণের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয়

ড. শহীদুল জাহীদ

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যপরিধি সীমাহীন নয়। মোটা দাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছয়টি লক্ষ্য অর্জনের জন্য মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে থাকে। লক্ষ্যগুলো যথাক্রমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা, সহনীয় মূল্যস্তর তথা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সুদের হার স্থিতিশীল রাখা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা। উল্লিখিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের নিমিত্তে বাংলাদেশ ব্যাংক এ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। মুদ্রানীতিপ্রয়োজন বোধে সম্প্রসারণ অথবা সংকোচনশীল হতে পারে। বলে রাখা ভালো, মুদ্রানীতি যে ধরনেরই হোক না কেন তার মুখ্য উদ্দেশ্য আবর্তিত হয় উল্লিখিত ছয়টি লক্ষ্যকে ঘিরেই। 

বাংলাদেশের অর্থনীতি এক দুর্দশাগ্রস্ত সময় অতিক্রম করছে। প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে চলা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়েছে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গঠিত হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। উপদেষ্টা পরিষদ দায়িত্ব গ্রহণের পরই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগ হয়। গা ঢাকা দেন আগের গভর্নর। কিছুদিন পর বেশ কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের পর এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার শেষ নেই। সম্ভবত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত। দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে বিগত সরকার ব্যাংক লুটে মরিয়া হয়ে ওঠে। ব্যাংক থেকে অর্থ লুট করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, লুটকৃত অর্থ বিদেশে পাচারে তারা নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় এবং নতুন নতুন পদ্ধতি বের করে। কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট হ্যাক করে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশের ব্যাংকে পাচার করে, কখনো নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের কোষাগার খালি করে আমানতকারীদের পথে বসানোর জোগাড় করে। আমানতকারীদের উদ্ধারে সরকার জনগণের অর্থ ব্যাংকে কখনো মূলধন হিসেবে আবার কখনো তারল্য সহায়তা হিসেবে সরবরাহ করে। 

এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়েই বিদ্যমান ব্যাংক ব্যবস্থা সংস্কারের সংকল্প ব্যক্ত করেন, যা জনমনে আশার আলো সঞ্চার করে। সঠিকভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করে। দুর্দশাগ্রস্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া উন্মুক্ত না হলেও যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো আসলেই সমস্যা জর্জরিত। এ কথা বলার কারণ হলো চিহ্নিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই যে শুধু দুর্দশাগ্রস্ত তা অনেকেই বিশ্বাস করে না। অনেকে মনে করে, এসবের বাইরে থাকা আরো কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সমস্যা জর্জরিত থাকতে পারে। কারণ তাদের অনেকেরই বর্তমান ব্যাংকিং কার্যক্রমের মান স্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে কয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে তাদের অধিকাংশই ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংক। এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম বেশ জনপ্রিয়। দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষ ইসলামী ব্যাংকিং করতে ভালোবাসেন হয় ইসলামী শরিয়াহ বিশ্বাসের কারণে অথবা ইসলামী ব্যাংকের প্রতি তুলনামূলক বেশি আস্থার কারণে। সে কারণেই অনেক প্রচলিত ধারার বাণিজ্যিক ব্যাংকও ইসলামী ব্যাংকিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং সেবা প্রচলন করে, ইসলামী ব্যাংকিং শাখা অথবা উইন্ডো ব্যবস্থাপনা করে। অনেক উদ্যোক্তা ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকের লাইসেন্স গ্রহণ করে। ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু সুবিধা প্রদান করে। তুলনামূলক কম নগদ সঞ্চিতি রক্ষা অন্যতম সুবিধা হিসেবে পরিগণিত। উদাহরণস্বরূপ বর্তমানে প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি যেখানে ১৭ শতাংশ সেখানে ইসলামী ব্যাংকের জন্য তা মাত্র ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ১০০ টাকা নতুন আমানত পেলে তা থেকে ১৭ টাকা বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি রেখে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা ঋণদান করতে পারবে। এ ৮৩ টাকা ঋণ দিয়ে ১০ শতাংশ হারে সুদ পাবে বছর শেষে ৮ টাকা ৩০ পয়সা। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক সমপরিমাণ তথা ১০০ টাকা আমানত গ্রহণ করে বিনিয়োগ করতে পারবে সর্বোচ্চ ৯০ দশমিক ৫ টাকা। ১০ শতাংশ লাভে তাদের আয় দাঁড়াবে বছরান্তে ৯ টাকা ৫ পয়সা। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় বেশি মুনাফাজনক। তুলনামূলক লাভজনক হওয়ার কারণে অনেক উদ্যোক্তা ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আগ্রহী হন। কিন্তু অসৎ মালিক পক্ষ শুধু অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনেই থেমে থাকেনি। ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা ব্যাংক লুট করতে থাকেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ ছিল তাদের বারণ করা, বিরত রাখা অথবা ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নিবন্ধের শুরুতেই যে কথা বলা—নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখভাল, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। যে কাজে বাংলাদেশ ব্যাংক নিতান্তই ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব দৃশ্যত আন্তরিকভাবেই ব্যাংক খাতে সংস্কার করতে চায়। কিন্তু এরই মধ্যে তাদের বেশকিছু অতিকথন জনমনে আশার আলো সঞ্চারের বিপরীতে হতাশা ও অনাস্থার জন্ম দিয়েছে। প্রথমেই বলা হলো, আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানত বীমার পরিমাণ ১ লাখ থেকে দ্বিগুণ করে ২ লাখ করল। ছোট ছোট আমানতকারীরা আশ্বস্ত হলের। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের ব্যাংকিং কার্যক্রম বলতে গেলে অনেকদিন ধরে বন্ধই আছে। তাদের চেক ক্লিয়ারিং হচ্ছে না, বন্ধ রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যে সহায়তা কার্যক্রম। রেমিট্যান্স প্রবাহ শূন্যের কোটায়। নতুন বিনিয়োগ বন্ধ। ঋণ আদায় নেই বললেই চলে। কারণ যারা ঋণ নিয়েছে তারা হয় রাঘববোয়াল এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে অথবা বেনামে নেয়া ঋণ হিসাবের খাতা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে অনলাইন লেনদেন। অনাস্থায় নতুন কোনো আমানত আসছে না বলেই চলে। এখন এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা চেক, ডিমান্ড ড্রাফট ইত্যাদি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। কোনো কোনো শাখায় ব্যাংক কর্মচারীদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছেন, ভাংচুর হচ্ছে, টাকা ফেরত না পেয়ে কষ্ট ও ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আমানতকারীদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা হুমকির মুখে। তারা তাদের খরচ মেটানো এবং ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলল, তারল্য সংকটে থাকা এ ধরনের ব্যাংকে আপৎকালীন তারল্য সহায়তা দেবে। তারা সরাসরি টাকা ধার দেবে না। তাতে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে এবং মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবনে কষ্ট তৈরি করবে। বরং বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের পক্ষে গ্যারান্টি পত্র দেবে যে গ্যারান্টি পত্র দেখিয়ে তারল্যে উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক থেকে ওইসব ব্যাংক নগদ তারল্য সহায়তা পাবে। আপৎকালীন এ তারল্য সহায়তা স্বল্পমেয়াদি হবে এবং এর বিপরীতে সুদ বা মুনাফা দিতে হবে। জনগণ সরল বিশ্বাসে আস্থা রাখলেও এ ধরনের বন্দোবস্ত এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বেশকিছু পদ্ধতিগত জটিলতা বাংলাদেশ ব্যাংক ভেবে দেখেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই জানে যে ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক তথা সুদি ব্যাংক থেকে ধার/কর্জ করতে পারে না। এটি তাদের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংক অন্য কোনো ইসলামী ব্যাংক থেকে কর্জ করতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে নিকট অতীতের সবচেয়ে সফল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি নিজেই এখন একটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক। অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের অবস্থাও সঙ্গিন। প্রয়োজন ছিল ইসলামী অর্থবাজার তথা ইসলামী মানি মার্কেট ব্যবস্থা প্রচলন করা যা আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই আমলে নেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নেতৃত্বের উচিত হবে ইসলামী মানি মার্কেট প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও উদ্যোগ নেয়া। গ্যারান্টিপত্র ইস্যু করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের তারল্য সংকট সমাধানের চিন্তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। প্রথম আলো আয়োজিত সাম্প্রতিক গোলটেবিল বৈঠকে গভর্নরের আহ্বান উদ্বৃত্ত তারল্য থাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে এরই মধ্যে সমস্যায় থাকা ব্যাংকে তারল্য সহায়তা ঋণ দিলে তা খেলাপি হতে পারে। সেই খেলাপি ঋণ উদ্ধারে নিয়ন্ত্রক ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া তাদের জন্য বিব্রতকর। অন্যদিকে বিদেশী অডিট সংস্থা যখন দেখবে যে এসব সচ্ছল ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক তথা মন্দ গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে তখন ওইসব সচ্ছল প্রতিষ্ঠানেরও আন্তর্জাতিক রেটিং খারাপ হতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের কথায় তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীরা আস্থা রাখতে পারছেন না।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রাখঢাক না রেখেই বলে বেড়াচ্ছে যে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে একত্রিত করে এক বা একাধিক বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। সে লক্ষ্যে তারা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী তথা মূলধন সরবরাহকারী খুঁজছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র রয়েছেন কিন্তু ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী তথা গভর্নর নিজেই এসব বলে বেড়াচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কোন আইন বলে এসব ব্যাংকের একীভূতকরণ করতে চায়? বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ও তফসিলি মর্যাদা দেয়। কিন্তু একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের জন্য আইন দরকার। শুধু তা-ই নয়, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে তা দেখার জন্য আলাদা আইন ও আদালত রয়েছে। সুতরাং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই যে অভিপ্রায় তার ভিত্তি কী? আমরা কি ধরে নেব একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের জন্য নতুন আইন করা হবে? সেখানে সংকটে থাকা ব্যাংকের দায়দেনার ভার কে নেবে? লোকবলের কী হবে? আমানত, বিনিয়োগ ও অন্যান্য পরিসম্পদের মূল্যায়ন তথা ভ্যালুয়েশন কীভাবে হবে? কাদের মাধ্যমে হবে? 

কথা হচ্ছে, বিগত সরকারের সময়ও আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ ধরনের আলোচনা শুনেছি। সদ্য বিদায়ী গভর্নর এমনকি ঘোষণাও দিয়েছিলেন কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংকের একীভূতকরণ হবে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিচ্ছায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। নানা মহল থেকেও এর বিপক্ষে প্রশ্ন উঠেছিল। সুতরাং আগের সরকারের ব্যর্থ প্রশ্ন এখন আবার নতুন করে আসার কারণ কী? 

তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব আসার পরই বলেছিলেন যে ব্যাংক লুটপাটকারীরা ছাড় পাবে না। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এ রকম দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং যতই দিন যাচ্ছে জনগণের আমানত তথা ব্যাংক লুটেরা ব্যবসায়ীরা হালে পানি পাওয়া শুরু করেছে। পর্ষদ ভেঙে দেয়া ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক তো বটেই, কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় দেউলিয়াগ্রস্ত যেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা মালিকদের অন্যায় আবদার মিটিয়েছেন, নামে বেনামে ঋণ দিয়ে নিজেরাও লাভবান হয়েছেন, পিএলসি তথা জনগণের প্রতিষ্ঠানকে খাদের কিনারায় নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি করেছেন, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের ঘুম হারাম করে পথে বসানোর জোগাড় করেছেন, তারা কীভাবে বহাল তবিয়তে থাকেন? আজ যদি সংস্কারের মাধ্যমে এসব ব্যাংকের শাখা সংকোচন করা হয় সেক্ষেত্রে বহু জনবল ছাঁটাই করতে হবে। ছাঁটাই হওয়া কর্মচারীরা পরিবার নিয়ে পথে বসবেন। সেক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপকরা আগেই আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে আক্ষরিক অর্থেই তাদের বিচারের মুখোমুখি করা।

চতুর্থত, যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বা তার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কার্যপরিধি তাতে ব্যত্যয় হয়েছে দিনের পর দিন। একটি ব্যাংকের স্থায়ী তারল্য সংকট রাতারাতি সৃষ্টি হয় না। বিধিবদ্ধ রিজার্ভে নমনীয়তাই শুধু দেখানো হয়নি, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে পাহাড়সমান ঘাটতি। বিধিবদ্ধ রিজার্ভের ঘাটতি পূরণে ওইসব ব্যাংককে সতর্ক না করে বরং টাকা ছাপিয়ে ধার দিয়ে তাদের চলতি হিসাবের ঘাটতিকে বাড়তে দেয়া হয়েছে। সেই টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার দেখভাল করেছে কি? নাকি অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে? সেক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। 

সর্বোপরি বাংলাদেশী টাকার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের কথায় আত্মতুষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে টাকার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষত মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ক্রলিং পেগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। বর্তমান পদ্ধতিটি পুরোপুরি ভাসমান তথা বাজারের চাহিদা ও জোগান দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে না। আবার নিকট অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি এবং তার মূল্য পরিশোধ তথা ব্যালান্স অব ট্রেড এবং ব্যালান্স অব পেমেন্টের তথ্যে বড় বিভ্রাট দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে নিকট অতীতে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যারা অস্বাভাবিক লাভ করেছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে বেকায়দায় ফেলেছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

হালে ব্যাংক খাতে সংস্কারের জন্য একটি কমিশন করা হয়েছে। তাদের কর্মপরিধি সীমাহীন না করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তাবের আলোকে সংস্কারকে এগিয়ে নিতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কথার চেয়ে কাজে বেশি মনোযোগ দেয়া। ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং কষ্ট লাঘবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। 

ড. শহীদুল জাহীদ: অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন